দিলীপ কুমার: দ্য আল্টিমেট ট্র্যাজেডি কিং!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সময়ের পরিক্রমায় পাকিস্তানে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ ইউসুফ খান হয়ে গেলেন দিলীপ কুমার, পরিণত হলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় আইকনে। যে সময়টাতে হিন্দী সিনেমা দর্শকদের মনে জায়গা করে নিচ্ছিলো, সেই সময়ে পুরো ভারতবর্ষে সবচেয়ে মননশীল একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি...
বলিউডের আল্টিমেট 'ট্রাজেডি কিং' নামেই পরিচিত তিনি। বলিউডের সর্বকালের সেরা অভিনেতা হিসেবেও গন্য করা হয় তাকে। তিনি শাহজাদা সেলিম, তিনিই সবার প্রিয় দীলিপ কুমার। যে সময়টাতে হিন্দী সিনেমা দর্শকদের মনে আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছিলো সেই সময়টাতে পুরো ভারতবর্ষে সবচেয়ে মননশীল একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। আজ ৯৮ বছর বয়সে চলে গেলেন তিনি না ফেরার দেশে।
১৯২২ সালে পাকিস্তানের খাইবার অঞ্চলে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নাম রাখা হয়েছিল মুহাম্মদ ইউসুফ খান। কিন্তু ভারতীয় সিনেমা জগতে তিনি দীলিপ কুমার নামেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর পিতা লালা গোলাম সারওয়ার একজন ফলের ব্যবসায়ী ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি ভারতের মহারাস্ট্র প্রদেশ এবং পাকিস্তানের পেশোয়ারে ফলের ব্যবসা জমিয়ে তুলেছিলেন।
দীলিপ কুমার মহারাষ্ট্রের নাসিকে দেওলিয়ার বার্নস স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে তার বাবা ১২ সদস্যর পরিবার নিয়ে মুম্বাই সেই সময় বোম্বে শহরে পাড়ি জমান। রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে পুনেতে ১৯৪০ সালে দিলীপ কুমার একজন ক্যান্টিন মালিক এবং একজন শুষ্ক ফল সরবরাহকারী হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তবে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজের জমানো টাকা নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে।
১৯৪৩ সালে বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সেই সময়কার অন্যতম সেরা প্রযোজনা সংস্থা 'বম্বে টকিজ' এর মালিকানাধীন অভিনেত্রী দেবিকা রানী ও তার স্বামী হিমাংশু রাই পুনের সামরিক ক্যান্টিনে দিলীপ কুমারের সাথে ভাগ্যক্রমে পরিচয় হয়। এবং প্রথম পরিচয়ের দিনই সাধারন একজন যুবক ইউসুফ খানের মাঝে একজন তারকার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান তারা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৪ সালের 'জোয়ার ভাটা' চলচ্চিত্রটির জন্য তাকে প্রধান চরিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এই চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ের মাধ্যমে বলিউড শিল্পে প্রবেশ করেন ইউসুফ খান।
প্রখ্যাত হিন্দি লেখক ভগবতি চরণ বর্মা তাকে স্ক্রীন নেম দিলীপ কুমার রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কারন তখনকার সময়ে মুসলমান নাম নিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বেশ কস্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। এভাবেই খুব সাধারন একজন যুবক ইউসুফ খান থেকে হিন্দি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি দিলীপ কুমারের পথচলা শুরু হয়।

দিলীপ কুমার ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে ছয় দশকের অধিক সময় ধরে বিচরণ করেছেন এবং অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি ছায়াছবিতে। তিনি বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্রময় ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, রোমান্টিক ধাঁচের চলচ্চিত্র হিসেবে ১৯৪৯ সালের ‘আন্দাজ’, ১৯৫২ সালের বেপরোয়া বা হঠকারী এবং চালবাজ চরিত্রে ‘আন’, ১৯৫৫ সালে ক্লাসিক চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’, ১৯৫৫ সালের কমেডি চলচ্চিত্র ‘আজাদ’, ১৯৬০ সালে ঐতিহাসিক ‘মুঘল-ই-আজম’, এবং ১৯৬১ সালের সামাজিক ঘরানার চলচ্চিত্র ‘গঙ্গা যমুনা’ এসব সুপারহিট সিনেমার মধ্যে দিয়ে দিলীপ কুমার সফলতার শিখরে পৌছে গিয়েছিলেন তার অভিনয় দক্ষতা এবং অসাধারন নায়কোচিত সৌন্দর্যের মাধ্যমে। অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন সাথে সমালোচকদেরও সন্তুষ্ট করেছে।
আরেক ভারতীয় কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের মতে দীলিপ কুমার ছিলেন একজন কমপ্লিট গুণী অভিনেতা। তাকে ওই সময়ে দাঁড়িয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রের ‘মেথড এক্টর’ এর খেতাব দেন সত্যজিৎ রায়। বলিউডের প্রথম স্টার বা তারকা অভিনেতাও তিনি। দিলীপ কুমার বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন যেমন, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু এবং পুশতু ভাষা। তিনিই প্রথম অভিনেতা, যিনি ১ লাখ রুপি পারিশ্রমিক নিতে শুরু করেন সিনেমা পিছু।
তাঁর জনপ্রিয়তা পঞ্চাশের দশকে এত বেশি ছিলো যে, ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লিনের সিনেমায় কাজ করার অফারও এসেছিলো। ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ সিনেমায় শেরিফ আলির রোলের জন্য তাঁকে নিতে চেয়েছিলেন ডেভিড লিন। কিন্তু সেই অফার ফিরিয়ে দেন দিলীপ কুমার, কারন টানা দুই মাসের শিডিউল দেয়া সেই সময় তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।
দিলীপ কুমার এর প্রথম চলচ্চিত্র 'জোয়ার ভাটা' তাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌছাতে সাহায্য না করলেও পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে সেই সময়কার জনপ্রিয় অভিনেত্রী এবং গায়িকা 'নুর জাহানের' বিপরীতে 'জঙ্গু' বক্স অফিসে তার প্রথম ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রসহ ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর ক্যারিয়ারে পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসাসফল চলচ্চিত্র ছিল 'শহীদ'। একটি ত্রিভূজ প্রেমের গল্পে রাজ কাপুর এবং নার্গিসের পাশাপাশি অভিনয় করেন তিনি। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। জনপ্রিয় পরিচালক মেহবুব খানের সাথে তার অভিনয় করা সিনেমাগুলো আলোচিত এবং ব্যবসাসফল হিসেবে বক্স অফিসে সাড়া জাগিয়েছিল সেই সময়।
একটা সময়ে এসে বিয়োগান্তক ভূমিকায় অভিনয় শুরু করেন তিনি। জোগান, দিদার, দাগ, দেবদাস, ইহুদী, মধুমতি সহ বেশ কিছু কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তবে ১৯৫৪ সালে মেহবুব খানের 'অমর' সিনেমায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটি তাকে 'ট্রাজেডি কিং' হিসাবে সিনেমা পর্দায় প্রতিষ্ঠিত করেন। 'দাগ' সিনেমার জন্য প্রথম অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেছিলেন দিলীপ কুমার।
অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করলেও তার অভিনয় জীবনের সবচেয়ে সফল এবং ঐতিহাসিক সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয় 'মুঘল ই আজম' কে। ভারতীয় সিনেমা ইতিহাসে কে,আসিফের পরিচালনায় এই সিনেমা আজ একটি ক্ল্যাসিক হিসেবেই গন্য করা হয়। সেই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বিশাল ক্যানভাসের এই রোমান্টিক সিনেমায় তার সাথে জুটি বেধে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের সবচেয়ে লাস্যময়ী অভিনেত্রী মধুবালা।
দিলীপ কুমারের জীবনে প্রেম এবং বিচ্ছেদ এই শব্দ দুটির সাথেও মধুবালার নামটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। তাদের প্রেম, বন্ধুত্ব এবং পারিবারিক কারনে বিচ্ছেদ কোন হিন্দি সিনেমার গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। জুটি হিসেবে হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে সেরা পাচটি জুটির একটি তাদের জুটি। তবে নার্গিস, মিনা কুমারী, বৈজয়ন্তীমালার সাথেও তার জুটি সুপারহিট ছিল। বিশেষ করে বৈজয়ন্তী মালার সাথে বেশিরভাগ সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।

মধুবালার সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পরে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন হিন্দি সিনেমার আরেক সুন্দরী এবং জনপ্রিয় নায়িকা সায়রা বানু কে। তাদের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য ২২ বছরের। বিয়ের সময় অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন যে, এই বিয়ে টিকবে না। কিন্তু একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান নিয়ে সুখেই দীলিপ কুমার নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সংসার করেছেন সায়রা বানুর সাথেই।
দিলীপ কুমারকে ব্যাপকভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একজন ভারতীয় অভিনেতা হিসেবে সর্বোচ্চসংখ্যক পুরস্কার বিজয়ী হওয়ার জন্য গিনেস বিশ্ব রেকর্ড ঝুলিতে নিজের জায়গা দখল করে নেন। তিনি তার অভিনয় জীবনে ৮ বার ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরষ্কার সহ ১৯ বার ফিল্মফেয়ার মনোনয়ন পেয়েছেন।
১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৯৪ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ন ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার প্রদান করা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে তাকে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ এ সম্মানিত করা হয়।
দিলীপ কুমারকে গত মঙ্গলবার শ্বাসকষ্টের সমস্যার কারনে মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল করা হয়েছিলো। তারপর একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। এমনকি দু-একদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো তার। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বুধবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তবে তিনি অমর হয়ে রইবেন তার অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ট্র্যাজেডি কিং হিসেবে তার ভক্তদের মনে রয়ে যাবেন তিনি অনন্তকাল।