দহন: ফরীদির দুর্দান্ত অভিনয়ের এক মাস্টারপিস সিনেমা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশের শিল্পসংস্কৃতির হাইট বলতে যদি কিছু বলতে পারি, সেটা অবশ্যই সত্তর এবং আশির দশকের এই সময়। সে সময়েরই এক মাস্টারপিস 'দহন' দেখলাম, যা একইসাথে মুগ্ধ করলো, করলো হতাশও!
একটা জিনিস খেয়াল করলে হয়তো অনেকেই একমত হবেন- সত্তর এবং আশির দশকের এদেশীয় সিনেমাগুলোর যে মান ছিলো, তা নিয়ে গর্ব করার মতন অজস্র কারণ আছে৷ সে সময়ের অভিনেতারা প্রায় প্রত্যেকেই মঞ্চে ঝানু হয়ে এরপর পর্দায় এসেছেন। তাদের হোমওয়ার্ক যে কতটা পাকাপোক্ত ছিলো, সেটারই নজির পাওয়া যেতো সিনেমার পর্দায়। আমাদের শিল্পসংস্কৃতির হাইট বলতে যদি কিছু বলতে পারি, সেটা অবশ্যই সত্তর এবং আশির দশকের এই সময়কেই বলতে হবে। সে সময়েরই এক সিনেমা 'দহন' দেখলাম। এবং দেখার পরে একইসাথে মুগ্ধতা ও হতাশা নামক দুই ভিন্নরকম অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হলাম। কেন, সেটাই খোলাসা করি বরং।
'দহন' নাম নিয়ে একাধিক সিনেমা আছে। তবে আমি যে 'দহন' এর কথা বলছি, সেটা ১৯৮৫ সালের সিনেমা। যদি পরিচালক শেখ নিয়ামত আলীর নাম না দেখে কেউ এই সিনেমা দেখতে বসেন, তাহলে সিনেমাটিকে সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত কোনো সিনেমা ভাবলে, তা মোটেও অপরাধ হবে না। মোটেও অতিশয়োক্তি করছি না। যে দুর্দান্ত স্টাইলে সুন্দর এক গল্পকে এভাবে এক্সিকিউট করা হয়েছে...মুগ্ধ হয়েছি রীতিমতো!
সিনেমার মূল গল্পকে 'আউট অব দ্য বক্স' তা বলা যাবে না৷ বরং বলা যেতে পারে, এ গল্পের সাথে আমরা সবাই-ই কম-বেশি পরিচিত। জীবনযুদ্ধের তীব্র কষাঘাতে যুঝতে থাকা এক যুবক এবং তার সাথে শাখা-প্রশাখায় সংযুক্ত কিছু মানুষের গল্প নিয়েই 'দহন।' যুবকটির পরিবারে মা আছে, অবিবাহিত বোন আছে, পাগলাটে অথর্ব মামা আছেন৷ এই যুবকটি ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। অথচ সে বেকার। একটা টিউশনি করিয়ে এবং টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং সাংবাদিকতা করে খেয়ে না খেয়ে, কায়ক্লেশে কাটে তার দিন৷ কাজের সন্ধানে এদিক সেদিক ঘুরপাক খেয়ে যাপিত জীবনের চোখ-রাঙানি থেকে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন থাকে সে নিয়মিত।
তার এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর কাছ থেকে সে ব্যবসা করার জন্যে কিছু টাকা আনে। সে টাকা সে আবার লগ্নি করে এমন এক ব্যবসার পেছনে, যে ব্যবসায় লাভ তো আসেই না, মাঝখান দিয়ে বন্ধুর দেয়া পুরো টাকাটাই গচ্ছা যায়৷ শত চেষ্টাতেও ভাগ্যের চাকা ঘোরেনা তার। মাটি কামড়ে পড়ে থাকে আঁটোসাটো হয়ে।

এ গল্পে শুধুমাত্র যে এই বেকার যুবকটিরই সংকট দেখবে দর্শক, তা নয়। সংকট রয়েছে অনেকেরই। গল্পে আমরা এক নিঃসন্তান বিত্তশালী দম্পতিকে দেখতে পাবো, হীরে আর জহরতে আগাগোড়া মোড়া জীবনেও সন্তানের অভাব যাদের ক্রমশ ব্যথিত করে রাখছে। এখানে এক নিঃসঙ্গ ইঞ্জিনিয়ারের অতীত হওয়া ব্যর্থ প্রেমের সংকট দেখতে পাবো৷ পাবো এক মেয়েকেও যাকে তার প্রেমিক বলেছিলো, বিয়ে করবে একদিন৷ পরে আর বিয়ে করেনি। করেছে প্রতারণা।
এরকম অজস্র মানুষের নানাবিধ সংকট মিলেমিশে সৃষ্টি হয় যে জমাটি ট্রাজিক গল্প, তারই পর্দার নাম 'দহন।'

সিনেমার বেকার যুবক চরিত্রে অভিনয় করলেন হুমায়ূন ফরীদি। কী তুখোড় অভিনয়! মধ্যবিত্ত বেকার তরুণ নিয়মিত সমাজের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে হিমশিম খেতে খেতে কিভাবে তড়পাচ্ছে, সেটা ফরীদি যেভাবে তুলে আনলেন অভিনয়ে, তা অনবদ্য। ভাবতে অবাক তো লাগেই, এই ফরীদিকে দিয়েই আমরা কি কি সব করিয়েছি যাবজ্জীবন।
যাই হোক, ফরীদি ছাড়াও বুলবুল আহম্মেদ, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান নূর, ববিতা, শর্মিলী আহমেদ, প্রবীর মিত্র, ফকরুল হাসান বৈরাগী... এরাও যার যার অংশে অসাধারণ। ভুল ধরার সুযোগই নেই সেরকম। অভিনেতাদের মধ্যে একজনের নাম বলিনি। আবুল খায়ের৷ 'পাগলাটে মামা'র চরিত্রে কি অভিনয়ই না করলেন! এই অভিনয় আমার চোখে লেগে থাকবে অনেকদিন। থাকতে বাধ্য। এই অভিনয়ের জন্যে তিনি 'শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা'র জাতীয় পুরস্কারও পান। দুর্দান্ত এক পারফরম্যান্স দিয়ে মনেই ঢুকে গেলেন মানুষটি৷
লেখার শুরুতেই বলেছি, এ সিনেমা দেখে মনে হচ্ছিলো, সত্যজিৎ এর কোনো সিনেমা দেখছি। এটা মনে হওয়ার পেছনে কারণ আছে। আমরা যদি সত্যজিৎ এর সিনেমা একটু খেয়াল করি, প্রত্যেক সিনেমায় তিনি চরিত্রগুলো নিয়ে যেভাবে গভীরভাবে ভাবেন এবং সেই ভাবনাকে তুলে আনেন পর্দায়, এ সিনেমার ক্ষেত্রেও সেই ট্রিটমেন্ট দেখেছি৷ যেমন- গল্পের মূখ্য চরিত্র 'মুনির' এর কথা বলা যেতে পারে, যে বেকার, অথচ তার ভেতরেও এক ইস্পাত-দৃঢ় মানসিকতা আছে। মানবিকতা আছে। পরিবারের চুলোয় ভাত ওঠেনি। অথচ সে হয়তো অনাহারে থাকা কাউকে টাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে। টিউশনের যে মেয়ে তাকে মনপ্রাণ সব দিয়ে বসে আছে, তাকেও সে ভালোবাসতে পারছে না। ঘরে ভাত নেই, মুড়ি খাচ্ছে। খেতে খেতে জানাচ্ছে, মাঝেমধ্যে মুড়ি খাওয়া খারাপ না৷ জীবন তাকে নানাভাবে ভাঙ্গতে চাইছে। সে ভেঙ্গেও যাচ্ছে হয়তো, কিন্তু মচকাচ্ছে না। সে স্বীকার করছে না তার পরাজয়। যুদ্ধ জারি রেখেই দহনের এক জীবন পার করে যাচ্ছে এই মানুষটি।

এরকম টানাপোড়েন আছে প্রত্যেক চরিত্রের। কেউ এখানে ন্যাকা ন্যাকা যাত্রাপালা মার্কা সংলাপ বলছে না, কারো মুখে একতাল মেকাপ নেই। বঙ্কিমীয় ভাষাতেও কেউ কথোপকথনে মগ্ন না। এমনকি খানিকটা প্রেমালাপ দেখালেও সেখানে বার্নার্ড শ, শরৎচন্দ্র'রা আসছেন ক্ষণেক্ষণে। একটা রূঢ় সমাজ দেখাচ্ছেন পরিচালক। সে সমাজের নর্দমার কটু গন্ধ তিনি মোটেও ঢাকার চেষ্টা করছেন না। এমন এক গল্প দেখাচ্ছেন, যেটা প্রচণ্ড সাফোকেটিং, কিন্তু তাও দেখে যেতে হচ্ছে, কারণ, জীবন এরকমই হয়। সিনেমাকে এইভাবে জীবনের সাথে মিশিয়ে দিতে সত্যজিৎ রায় পারতেন। যেটা এখানেও মিশেছে। তাই এই তুলনার অবতরণিকা।
বাংলাদেশের সিনেমার এই হাইট দেখলে সত্যি বলতে আক্ষেপ লাগে। আমাদের সেই সময়, সেই সিনেমা, সেই দর্শকেরা আজ কোথায়? হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিনে তাঁর এই সিনেমা দেখে আমি তাই মোটেও স্বস্তি পাই না। বরং আচ্ছন্ন হই এক বিশাল হতাশাবোধে। কতদূরে যাওয়ার ছিলো আমাদের। কতটা প্রমিজিং ছিলো এই ইন্ডাস্ট্রি। অথচ, কতখানি পিছিয়ে এলাম আজ! কতটা ক্লেদাক্ত আজ এই সংস্কৃতিজগত। অধঃপতন নানাভাবে হতে পারে, নানা প্রকারে হতে পারে। কিন্তু এতটা ব্যবধান রেখে হতে যে পারে, তা বাংলাদেশি সিনেমার সেকাল ও একালের পার্থক্য দেখলেই বুঝতে পারবেন সচেতন যে কেউ।
যেটা আবার একবার বুঝলাম আজ। 'দহন' বোঝালো।