'ডোন্ট লুক আপ' এর গল্পকে অনেক ন্যারেশন স্টাইলেই দেখানো যেতে পারতো। খুব আবেগী গল্পে দেখানো যেতে পারতো, খুব সাসপেন্সের মধ্যেও দেখানো যেতে পারতো। সেসব না করে অ্যাডাম ম্যাকে বেছে নিলেন, ঠাট্টা-তামাশার বয়ান৷ এবং গল্প জমে গেলো সেখানেই। এ গ্রহের মানুষের এখন যে ছন্নছাড়া দশা, তা নিয়ে দুঃখ, কষ্ট, অনুশোচনার বদলে স্যাটায়ার, ডার্ক কমেডি, মেটাফোর ব্যবহার করাই যে বেশি সমীচীন, তা লাইট কন্টেন্ট, টিকটক কিংবা মিমস-প্রিয় জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই তো বুঝতে পারার কথা!

একদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে শুনতে পেলেন- আগামীকাল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, কী করবেন আপনি? ফেসবুকে  স্ট্যাটাস দেবেন? একটা ইউটিউব ভ্লগ করবেন? নাকি, খবরটাকে গুজব ভেবে ওপাশ ফিরে আবার নিদ্রাদেবীর কোলে নিজেকে সঁপে দেবেন? আচ্ছা, একদিন কম হয়ে যাচ্ছে। ধরুন, আপনার হাতে আর ছয়মাস সময় আছে। ছয় মাস পরে কোনো এক বিশালাকার গ্রহ এসে আছড়ে পড়বে পৃথিবীতে, পৃথিবী বিলুপ্ত হবে। এই শেষ ছয় মাসে আপনি কী করবেন? কী করার আছে আপনার? আপনার কি একটু হলেও দমবন্ধ লাগবে? 

'ডোন্ট লুক আপ' এর গল্প এরকম এক টালমাটাল সময় নিয়েই৷ মহাকাশ-বিজ্ঞানী ডঃ ম্যান্ডি ও তার পিএইচডি স্টুডেন্ট কেট গবেষণা করছিলেন মহাকাশ নিয়ে। গবেষণার এক পর্যায়ে তারা দেখতে পান- প্রবল বেগে একটা গ্রহপিণ্ড ছুটে আসছে পৃথিবীর দিকে। এই গ্রহপিণ্ডের আকৃতি এতটাই বড়, এটা পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে নিমেষেই কমলালেবু এই গোলক পুরোপুরি ধূলিসাৎ হয়ে যাবে৷ এবং এই গ্রহপিণ্ড যে পৃথিবীতে আঘাত করবেই, তাও শতভাগ সত্যি৷ পাশাপাশি, তারা গবেষণা করে বের করলেন, এই বিপর্যয় আসবে আর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে! দিশেহারা এই দুজন বিজ্ঞানী ছুটলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওরলিনের কাছে। তার সাহায্য চাইলেন। ম্যাডাম প্রেসিডেন্ট সাহায্য করলেন কী না, সেটা সিনেমাতে দেখা সমীচীন। এখানে খোলাসা করছি না৷ এবং এই চাঞ্চল্যকর সংবাদ নিয়ে মিডিয়ার জাগলিং কিংবা বল লোফালুফি কিরকম হলো, সেটাও এখানে বলছি না। সিনেমায় দ্রষ্টব্য!

মুগ্ধ করেছেন ডিক্যাপ্রিও!

যদিও 'ডোন্ট লুক আপ'কে কমেডি, সাইফাই, ফিকশন... বহু কিছুই বলা হচ্ছে। কিন্তু আদতে এই সিনেমা পুরোপুরি এবং অকৃত্রিম এক পলিটিক্যাল থ্রিলার৷ কোনো একটা সংবাদ কিভাবে রাজনীতির মোড়কে পরিবেশিত হয় মানুষের কাছে, কিভাবে রাজনীতি যা খাওয়ায়, সেটাই সোনামুখ করে মানুষ খেয়ে নেয়, সোশ্যাল মিডিয়া-মিমস-মিডিয়া সার্কাস কিভাবে ভেতরে ভেতরে অন্তঃসারশূন্য করে দিচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীবকে, এবং কিভাবে ক্রমশই ফ্যানাটিক হয়ে উঠছে পৃথিবীবাসী, পুঁজিবাদ ও বস্তুবাদের পেইন কিলারে কিভাবে সাময়িক সুখ পাচ্ছে অনেকেই... সেসব নিয়েই আড়াই ঘন্টার এই ব্রিলিয়ান্ট পটবয়লার! 

এ সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, হলিউডি মুভি থেকে হোয়াইট হাউজ... কটাক্ষের হাত থেকে কাউকেই রেয়াত করেনি সে। যেমন- ডঃ র‍্যান্ডি এবং কেট যখন মিডিয়ার কাছে এই খবরটা দিচ্ছে, উপস্থাপক তখন খুবই সস্তা কৌতুক করে সংবাদের গুরুত্ব কমিয়ে দিচ্ছেন, মিডিয়ার কাছে এনভায়রনমেন্টের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সেলিব্রেটির ব্যক্তিগত জীবন, একই সংবাদ যখন একজন বিজ্ঞানী দিচ্ছেন কেউ বিশ্বাস করছেন না, কিন্তু যখন একজন রাজনীতিবিদ সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে দিচ্ছে, সেটা সবাই অধোবদনে মেনে নিচ্ছে। কটাক্ষ-বাণে বিদ্ধ হয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষকে আমরা যখনই সিনেমার পর্দায় দেখেছি, দেখেছি তিনি প্রচণ্ড সময়ানুবর্তী একজন মানুষ। কিন্তু এ সিনেমায় এসে সে ন্যারেটিভ ভেঙ্গে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি- তিনি প্রচণ্ড দায়িত্বজ্ঞানহীন এক মানুষ। পাঁচ মিনিটের কথা বলে যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষকে বসিয়ে রাখছেন। নিজের নোংরামো ঢাকতে মিথ্যে সংবাদ ব্যবহার করছেন৷ আরেকটা বিষয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে মেরিল স্ট্রিপকে, একজন নারীকে। আমেরিকার মানু্ষজন তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কবে যে কোনো নারীকে আনবে, সে ভীষণ প্রশ্নবিদ্ধ এক বিষয়। এখানেও খানিকটা বিদ্রুপ রইলো। মেরিল স্ট্রিপ তার উন্মাষিক আচরণে ক্ষণেক্ষণে মনে করালেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। এখানেও নির্মাতা বিদ্রুপ করতে ছাড়লেন না মোটেও। 

দুই বিজ্ঞানী ও এক ভবঘুরে!

গুরুত্বপূর্ণ কোনো খবরের চেয়ে ফেসবুকে শাড়ি-চুড়ি-মোবাইলের বিজ্ঞাপন দেখতেই যে বেশি পছন্দ করি আমরা, কোনো একটা সংবাদ নিয়ে যতটা না ভাবি  তারচেয়েও বেশি ভাবি স্ন্যাপচ্যাটের ফিল্টার নিয়ে, সেলিব্রেটির ব্রেকআপের সংবাদ আমাদেরকে দিশেহারা করে অথচ আমরা ভুলে যাই, আমাদেরও জীবন সংকটাপন্ন, একটু তলিয়ে না দেখে ভাসাভাসা ভেসে চলি ক্রমশ...'ডোন্ট লুক আপ' সেসব কিছুই খুব হালকা চালে বলে যায় ক্রমশ। 'ডোন্ট লুক আপ' নামটাও তো মেটাফোরিক্যাল। সিনেমার এক পর্যায়ে দেখা যায়, পলিটিশিয়ানরা বলছে- "ডোন্ট লুক আপ। লুক ডাউন।" এ যেন আমাদের গোটা পৃথিবীরই প্রতিচ্ছবি। যেন প্রশাসন বলছে- খবরদার মাথা তুলবে না। চোখে চোখ রাখবে না। নীচে তাকাও। আমরা যা বলছি মেনে নাও। যেন 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমার সেই লাইনগুলোই শুনি- 

যায় যদি যাক প্রাণ
হীরকের রাজা ভগবান।

ইতিহাসবিদ ইওভাল নো হারারি বলেছিলেন-

আমরা এখন এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, যেখানে আমরা আর আলাদা কোনো সত্তা নই। আমরা স্রেফ কিছু সংখ্যা। 

কথাটা যে কতটা সত্যি, তা 'ডোন্ট লুক আপ'এই উঠে আসে অনেকটা। এ সিনেমার যে গল্প, তা অনেক ন্যারেশন স্টাইলেই দেখানো যেতে পারতো। খুব আবেগী গল্পে দেখানো যেতে পারতো, খুব সাসপেন্সের মধ্যেও দেখানো যেতে পারতো। সেসব না করে অ্যাডাম ম্যাকে বেছে নিলেন, ঠাট্টা-তামাশার বয়ান৷ এবং গল্প জমে গেলো সেখানেই। এ গ্রহের মানুষের এখন যে ছন্নছাড়া দশা, তা নিয়ে দুঃখ, কষ্ট, অনুশোচনার বদলে স্যাটায়ার, ডার্ক কমেডি, মেটাফোর ব্যবহার করাই যে বেশি সমীচীন, তা লাইট কন্টেন্ট, টিকটক কিংবা মিমস-প্রিয় জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এভাবেই গল্প, গল্প বয়ান, সিচুয়েশনাল কমেডি, ক্যারেক্টার...প্রতিটি দিকেই যেভাবে সাটল ও লাউড সব কমেডি রাখলেন ম্যাকে, সে হিসেবে বছর শেষে তাই 'ডোন্ট লুক আপ'কে 'অন্যতম শ্রেষ্ঠ পলিটিক্যাল স্যাটায়ার ফিল্ম' বলা ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা