
মহানগর' এর 'ওসি হারুন'কে কি ভালো লেগেছিলো আপনার? যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে তাকে এখন ভুলে যান। 'দৌড়' এর 'রুহুল আমিন' এর যে শর্ট টেম্পার, রূডনেস, অ্যাগ্রেসন আর ভালনেরাবিলিটি... এই লেভেলের ধারেকাছে কোনো পারফরম্যান্স সাম্প্রতিক সময়ে দেখিনি। আবার কবে দেখবো, জানিনা...
আল্লাহ, পাগল হয়ে যাবো তো আল্লাহ...
মোশাররফ করিম যখন উন্মাসিক হাসি দিয়ে এরকম ডায়লগ দেন, তখন আক্ষরিক অর্থেই পাগল হওয়ার উপক্রম হয় আমাদের। একজন মানুষ এরকম অসাধারণ অভিনয় করে কিভাবে? ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে ইমোশন চেঞ্জ করা এরকম 'ছেলের হাতের মোয়া' মনে হয় কেন? একটা ওয়েব সিরিজের নয়টা পর্ব জুড়ে 'দ্যাখ, অভিনয় কাকে বলে!' পারফরম্যান্স দেয়া কি এতটাই সহজ? মোশাররফ করিমের যে লেভেল, সে লেভেল সম্পর্কে তিনি নিজেই কি অবগত?
হইচই এর নতুন ওয়েব সিরিজ 'দৌড়' দেখা শেষ করা মাত্রই উপরের প্রশ্নগুলো একের পর এক এসে আক্রমণ করলো। 'দৌড়' নিয়ে কথা বলা তো যাবেই। কিন্তু এক মোশাররফ করিম যেভাবে অভিনয় করলেন এখানে, এরপর সত্যি বলতে, আলাদা করে কিছুই আর ম্যাটার করে না! কতটা ভালো অভিনয় করেছেন তিনি, জানতে চান? আচ্ছা, আপনাকে আমি পালটা প্রশ্ন করি- 'মহানগর' এর 'ওসি হারুন'কে কি ভালো লেগেছিলো আপনার? যদি ভালো লেগে থাকে, তাহলে তাকে এখন ভুলে যান। 'দৌড়' এর 'রুহুল আমিন' এর যে শর্ট টেম্পার, রূডনেস, অ্যাগ্রেসন আর ভালনেরাবিলিটি... এই লেভেলের ধারেকাছে কোনো পারফরম্যান্স সাম্প্রতিক সময়ে দেখিনি। আবার কবে দেখবো, জানিনা।
বিস্তারিত কথাবার্তায় যাচ্ছি। এর আগে 'দৌড়' এর গল্প দিয়ে শুরু করি। এই গল্পটা প্রথমে ছিলো একটা গাড়ি চুরির গল্প। রুহুল আমিন নামের এক শিল্পপতির গাড়ি চুরি করে চারজন। চোরাই গাড়ি নিয়ে শুরু হয় তাদের অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু এই গল্প বেশিক্ষণ থাকেনা। গাড়ি চুরির গল্প থেকে আচমকা এই গল্প রূপান্তরিত হয় চারজন গাড়িচোরের গল্পে। সেখান থেকে আবার গোত্তা খেয়ে এই গল্প হয়ে যায় রুহুল আমিনের ম্যানেজার 'আকমল' এর গল্প। এবং সেখান থেকেও দৌড়ে এসে শেষমেষ এ গল্প থিতু হয় 'রুহুল আমিন' এর কাছে। হয়ে যায় রুহুল আমিনের গল্প। রুহুল আমিনের জীবনের গল্প। যিনি নিজেই বলেন।
আমার জীবন তো কোনোদিন সিম্পল হইবোনা। আমার জীবন মারামারির জীবন। কাটাকাটির জীবন।
এই 'রুহুল আমিন'রূপী মোশাররফ করিমকে প্রথমে দেখি- শর্ট টেম্পারড একজন মানুষ হিসেবে। বিনা কারণে খিস্তিখেউড়, ধস্তাধস্তি, অধঃস্তন কর্মচারীর বাড়িতে গিয়ে হামলা, মোবাইল ভাংচুর... বহুকিছু। যিনি কিছু হলেই দাতমুখ খিঁচিয়ে শাসানি দেন-
দাঁত ফেলে দেবো!
ক্রমশ জানা যায়, তার আছে অন্য অতীতও। এসবের মাঝখানেই জানা যায়, সে তার সন্তানকে কতটা ভালোবাসে! সে সন্তান যখন নিখোঁজ, সে সময়ে 'পায়ের নীচের মাটি টলে ওঠা' বাবা হিসেবে সে কতটা আগ্রাসী, সেটাও আসে 'দৌড়' এর প্রচণ্ড অস্থিতিশীল টাইমলাইনে।
আবার, এখানে দেখি 'আকমল' এর গল্পও। রুহুল আমিনের কোম্পানি 'অহনা কন্সট্রাকশনস' এর ম্যানেজার সে। কিন্তু তার কাজ শুধুমাত্র ম্যানেজারিতেই সীমাবদ্ধ না। জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ... সবই করতে হয় তাকে। বস 'রুহুল আমিন' মাঝেমধ্যেই তার কলার চেপে ধরেন, মাঝেমধ্যেই তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। তবে এসবের কোনো কিছুতেই 'আকমল' বিচলিত হয় না। বসের সাথে ছায়ার মতই লেগে থাকা তার নিয়তি। সেটাই মনোযোগ দিয়ে করে সে।
'আকমল' নামের এই 'গ্রে' ক্যারেক্টারে যেভাবে ঢুকে বসেন ইন্তেখাব দিনার, করেন সূক্ষ্ম অভিনয়, বারে বারে চমকাই। চরিত্রের প্রয়োজনে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো এমনই 'কনফিউজিং' জায়গায় থাকেন, নাকানিচোবানি খেতে হয়। মোশাররফ করিমের সাথে পাল্লা দিয়েই চলে তার অভিনয়-বাজি।

ডিবি অফিসার 'তারিক আনাম খান'ও বা কম কি? আপোষ করবেন না, অন্যায় মানবেন না বলে প্রমোশন হয়না তার। তবু সে ভয় পায়না। তার কাজ সত্য বের করা, সেটাই সে করে। টাফ গাই, নো ননসেন্স ইনভেস্টিগেশন... 'তারিক আনাম খান'কে কেন 'অ্যাক্টিং ইন্সটিটিউশন' বলা হয়, তার এক ঝলক এই ওয়েব সিরিজেই লেগে থাকে, পার্মানেন্ট মার্কারের মত।
এই যে তিন মানুষ, রুহুল আমিন, আকমল অথবা ডিবি অফিসার... এদের যে ক্যারেক্টার আর্ক, সেটা এতটাই অনবদ্য, বারবার চমকাতে হয়। পাশাপাশি, বাদবাকি অভিনেতারাও নিজ নিজ জায়গা থেকে সটান। যদিও দুয়েকজনের অভিনয় নিয়ে আক্ষেপ আছে, অসন্তোষ আছে। তবে, তারা বাদে, বাকিরা কেউ চোখ ফেরাতে দেয়না। কেউ 'আহাউহু' করার লেশমাত্র সুযোগও দেয় না। চরিত্র বুঝে ঠিকঠাকই অভিনয় করে যায় সবাই।
এটা ঠিক, 'দৌড়' অনেক জায়গায় থমকেছে, ডাবিং এ সমস্যা আছে, সিজিআই এর কাজ ভালোনা, অনেক প্রশ্নের উত্তর দ্বিতীয় সিজনের জন্যে রেখেও দেয়া হয়েছে। সেসব নিয়ে আপত্তি আছে, আছে আক্ষেপও। তবুও, সেসব মাথায় রেখেই বলছি- এই ওয়েব সিরিজ মাস্টওয়াচ। আর কারো জন্যে না হলেও তিন মানুষের জন্যে মাস্টওয়াচ; তারিক আনাম খান, ইন্তেখাব দিনার এবং মোশাররফ করিম। আর, যদি শর্টকাট করি, শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র 'মোশাররফ করিমের জন্যে এই ওয়েব সিরিজ মাস্টওয়াচ। যিনি 'রুহুল আমিন' হয়ে বেশ আক্ষেপ নিয়েই এই ওয়েব সিরিজে বলেন-
আমার... আমার জীবনটা দৌড়ের জীবন। নাইলে দ্যাহেন না, সবসময়ই কেডা জানি, আমার সামনে ১০০ মিটার দৌড়ের একটা লাল ফিতা ঝুলাইয়া রাহে।
এই 'লাল ফিতা' লক্ষ্যে রুহুল আমিনের যে প্রচণ্ড খ্যাপাটে 'দৌড়', সেটা চাইলে আপনি না দেখতেই পারেন। কিন্তু, সেক্ষেত্রে, আফসোসটাও আপনার!
রেকোমেন্ডেড।