'ডানকি'র অ্যানাউন্সমেন্ট ভিডিও হয়তো বেশ উইটি, কিন্তু যে বিষয়কে নিয়ে এ সিনেমা, সে বিষয় বিস্তর বিষাদগ্রস্ত। যদি কেউ ইউটিউবে 'ডানকি ফ্লাইট' লিখে সার্চ করেন, এমন কিছু ভিডিও পাবেন, গা শিউরে উঠবে নিশ্চিত। এবং ঠিক সে কারণেই তাই দেখার বিষয়, রাজু-শাহরুখ জুটি এই নির্মম বিষয়কে কিভাবে অ্যাড্রেস করেন! কিভাবে পর্দায় তুলে আনেন তৃণমূল মানুষদের যাপিত এ বেদনাকে!

যদি সবগুলো উপাদান ঠিকঠাক ক্লিক করে, যদি বড়সড় কোনো অঘটন না হয়, তাহলে আগামী বছর যে শাহরুখ খানের বছরই হতে যাচ্ছে, তা একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। বছরের শুরুতে 'পাঠান' এবং বছর-শেষে 'ডানকি'...প্রত্যাবর্তনের আয়োজনও বেশ রাজকীয়।যদিও এটাও নিশ্চিত, 'পাঠান' যেরকমই হোক না কেন, বেশিরভাগ দর্শকেরই আগ্রহ থাকবে 'ডানকি'র দিকে। কারণ, রাজু-শাহরুখ কোলাবোরেশন এর আগে বহুবার ভেস্তে গিয়েছে, এবং প্রতিবারই যারপরনাই হতাশ হয়েছে সবাই। হতাশার সে গেঁরো যে অবশেষে কাটছে, এহেন বিস্ময়কর বিষয় যে মানুষকে আগ্রহী করবে, তা বলাই বাহুল্য।

তবে, যে সময়ে তারা একসূত্রে এলেন, সে সময়টা বড় অদ্ভুত। শাহরুখ খান নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। হিরানিও অনেকদিন ধরেই বানাচ্ছেন না কিছু। এবং ঠিক সে কারণেই, এই সিনেমা দুজনের জন্যেই বিস্তর গুরুত্বপূর্ণ। 'ডানকি' সফল হবে কী না, শাহরুখ খানের দ্বিতীয় ইনিংসের 'অপরাজিত শতক' হয়ে জ্বলজ্বল করবে কি না এ সিনেমা, তা হয়তো জানা যাবে সিনেমা মুক্তির পরেই। কিন্তু সর্ষেক্ষেতের মধ্যে দু'বাহু উদ্বেল করে দাঁড়িয়ে থাকা চিরাচরিত 'শাহরুখ'ও যে থাকবেন না এ সিনেমায়, তাকে যে বেশ ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়েই নেবেন রাজকুমার হিরানি, 'ডানকি'র অ্যানাউন্সমেন্ট ভিডিও সেটাও বেশ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে গিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সেটাও।

'ডানকি' কি ফেরাবে শাহরুখের ভাগ্য?

তবে এই অ্যানাউন্সমেন্ট ভিডিওতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়,  সেটি সিনেমার নাম। যে নাম- 'ডানকি।' সবারই জানা, 'ডানকি'র প্রচলিত অর্থ গাধা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বোধ ব্যক্তি। কিন্তু এই ভিডিওতে যেভাবে ধূ-ধূ মরুভুমি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো এ নাম, এবং সে নামের পাশ দিয়ে পিলপিল করে হেটে যেতে লাগলো একদল বিক্ষিপ্ত ইতস্তত মানুষ, তাতে বোঝা গেলো, এ ডানকি অন্য ডানকি। যে 'ডানকি'র অর্থ খোঁজার জন্যে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না৷ ইউটিউবে গিয়ে, সার্চবারে 'ডানকি ইউএসএ' লিখে সার্চ দিলে চলে আসা অজস্র ভিডিওর মধ্যে যেকোনো একটি দেখলেই বুঝতে পারা যাবে, এ নামের মাহাত্ম্য। 

'ডানকি' কিংবা 'ডানকি ফ্লাইট' বলতে সোজা ভাষায় বোঝায়, অন্যায় পথে বিদেশে ঢোকা। অর্থাৎ, প্রচলিত পথে ভিসার আবেদন করে, ভিসা পেয়ে, সীমান্ত পার হয়ে কোনো দেশে ঢোকার যে প্রক্রিয়া, সেটাকে উপেক্ষা করে অপ্রচলিত পথে, কোনো দেশের সরকারকে না জানিয়ে সে দেশের সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে, সে দেশের সীমানায় অনুপ্রবেশকেই বলা হয় 'ডানকি ফ্লাইট' কিংবা 'গেম মারা।' যেসব মানুষ এভাবে চোরাই পথে অন্য দেশে ঢুকতে চান, তাদের অধিকাংশই মূলত সমাজের নিম্নস্তর থেকে আসা মানুষ। যারা মনে করেন, কোনোভাবে বিদেশে যেতে পারলেই পাল্টাবে ভাগ্য, কাটবে পরিবারের দীনতা। বাংলাদেশে যেমন নোয়াখালী, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, শরীয়তপুর, সৈয়দপুরের মানুষজন এভাবে বিদেশে যেতে বেশি আগ্রহী, ভারতের উত্তরাঞ্চলের কিংবা পাঞ্জাবের মানুষও ঠিক তেমন। এবং মূলত এরাই 'ডানকি ফ্লাইট' নামের অদ্ভুত সংগ্রামের মূল কুশীলব! 

'অদ্ভুত সংগ্রাম' এই টার্ম বেশ ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করেছি। কারণ, অন্যায়পথে অন্য দেশে ঢোকার এই যে চিন্তা, এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুইসাইডাল। জীবনরসের সর্বস্বটুকু শুষেও নেয় এ যাত্রা। কিভাবে শুষে নেয়, সে বর্ণনা একটু পরেই দিচ্ছি। এর আগে বরং বলে নিই, অন্য কিছু বিষয়। এই যে 'ডানকি ফ্লাইট, যেটা নিয়েই এত কথাবার্তা, এটা মূলত একটা কোডনেম। মানব-পাচারকারী দালালদের কোডনেম। খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব এলাকাতে ভিসা অফিস আছে, সেসব ভিসা অফিসের আশেপাশে এমনকিছু গুপ্ত প্রতিষ্ঠান আছে, যে প্রতিষ্ঠানের সবাই-ই মূলত মানব-পাচারকারী দালাল। মূলত এরাই ভিসা করতে আসা মানুষদের মধ্য থেকে তৃণমূল, অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, যেকোনোমূল্যে বিদেশে যাওয়ার জন্যে মরিয়া মানুষদের আলাদাভাবে টার্গেট করে। এই দালালেরা তাদেরকে প্রস্তাব দেয়, অল্পখরচে বিদেশ পাঠানোর। তারা প্রস্তাব দেয় 'ডানকি ফ্লাইট' এর। অনেক মানুষই লোভনীয় এ প্রস্তাবে রাজি হয়। যারা রাজি হয়, তাদের থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয় প্রথমে। এরপর দালালদের আন্তর্জাতিক চক্র তাদেরকে পাঠায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেসব অঞ্চলের জঙ্গলে, পাহাড়ে, নদীপথে আগে থেকে সংগ্রামরত রিফিউজিদের সাথে এই মানুষদের যুক্ত করা হয়। শুরু হয় বিদেশগামী মানুষদের বেঁচে থাকার, বিদেশে যাওয়ার অদ্ভুত সংগ্রাম! 

অদ্ভুত সংগ্রাম! 

অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৫ সালে সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার পথে পড়েছিলো সংকটে৷ এদের মধ্যে যাত্রাপথেই মারা গিয়েছিলো অনেকে। ট্রলারের ইঞ্জিনের গরমে সিদ্ধ হয়ে পাটাতনের নীচে দলা পাকিয়ে মরে ছিলো অনেকে। খাবারের অভাবে মরে, পঁচে-গলে গিয়েছিলো অগুণতি লাশ। নানা স্থানে উদ্ধার করা হয়েছিলো একাধিক গণকবরও। এরা সবাই-ই ছিলেন 'ডানকি ফ্লাইট' এর যাত্রী। লিবিয়ার মিজদায় মানব পাচারকারীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলো ২৬ হতভাগ্য বাংলাদেশি, যারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে 'ডানকি ফ্লাইট' এর মাধ্যমে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো!  মেসিডোনিয়ায় গ্রিস সীমান্তের কাছে পুলিশ একটি ট্রাক থেকে ২১১ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করে বর্ণনাতীত অত্যাচার করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো স্ব স্ব দেশে। সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার পথে অভিবাসন-প্রত্যাশী মানুষের সাগরে ডুবে মারা যাওয়ার খবর আমরা পেপারে নিয়মিতই পড়েছি। তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকায় ভাসমান অর্ধমৃত তৃণমূল মানুষদের হাহাকার দেখে আমাদের অনেকেরই চোখ হয়তো ভিজেছে ক্ষণেক্ষণে। এবং বলার অপেক্ষা রাখেনা মোটেও, এরা সবাই-ই 'ডানকি ফ্লাইট' এর হতভাগ্য মানুষ! 

যদিও গুজব চাউর, হিরানীর 'ডানকি' মূলত পাঞ্জাবের এক যুবকের চোরাইপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে 'কানাডা'য় প্রবেশের সংগ্রামে সীমাবদ্ধ, কিন্তু শুনলে অবাক হবেন- এই 'ডানকি ফ্লাইট' এর মাধ্যমে যে দেশের মানুষেরা বিদেশে ঢোকার চেষ্টা বেশি করেন, সেসব দেশের তালিকার শীর্ষের দিকে আছে বাংলাদেশ! সিরিয়া, আফগানিস্তান, মরক্কো, মালি, আইভরি কোস্ট, গায়ানার মত অস্থিতিশীল দেশের মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের মানুষও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন বিদেশে প্রবেশের! বিশেষ করে- ইউরোপে প্রবেশের। কারণ, এই মানুষেরা শুনেছেন- ইউরোপে কাজের পারিশ্রমিক ভালো। শ্রমিকদের সাথে ব্যবহারও ভালো করা হয়। খুব সহজেই এসব দেশে টিকে থাকা যায়। তাই তারা পাখির চোখ বানিয়েছেন ইউরোপকেই।

কিন্তু, এভাবে ইউরোপে ঢোকার সমীকরণ যে পুরোটাই অসম এক লড়াই, সেটাও ধ্রুবসত্যি।  'ডানকি ফ্লাইট' এর মাধ্যমে চোরাইপথে ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় বসনিয়ার জঙ্গলে দিনানিপাত করা কিছু মানুষকে উপজীব্য করে বানানো এক রিপোর্ট দেখছিলাম, আর শিউরে উঠছিলাম৷ দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পলিথিনের তাবুতে থাকা, বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে মাটিতে কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে বসবাস, খাবারের কষ্ট, মাঝেমধ্যে পুলিশের রেইড, অকথ্য নির্যাতন, স্থানীয় ছিনতাইকারীদের বর্বর নৃশংসতা, কোনোভাবে বর্ডার পার হয়ে অন্য দেশে পৌঁছেও সে দেশের পুলিশের কাছে ধরা পড়ে প্রচুর নির্যাতনের শিকার হয়ে সহায়সম্বল  হারিয়ে আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসা... বর্ণনাতীত দুর্ভোগ। 

এত দুর্ভোগের পরেও এই নির্যাতিত মানুষেরা দেশে ফেরেন না। ফিরতে চানও না। কিভাবে ফিরবেন? 'হাতের পাঁচ' বিক্রি করে, জমিজিরেত বন্ধক দিয়ে এসেছেন ভাগ্য পরিবর্তনে, পরিবারের সবাই হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে যার দিকে, সে মানুষটি কোন মুখেই বা আর ফিরবে দেশে? তাই তারা ফেরেন না। ভাগ্যের 'নো ম্যানস ল্যান্ড' এ আটকে থেকে বারবার চেষ্টা করেন সীমান্ত পার হওয়ার। বারবার ধরা পড়েন। বুকে-পেটে-শরীরে আঘাতের গভীর ক্ষত নিতে ফেরেন আবার। অনেকে ফেরেন না। সীমান্ত পার হয়ে এমন এক জগতেই পৌঁছে যান তারা, যেখান থেকে আর ফেরা হয় না। 

সীমান্ত পার হয়ে অনেকেরই আর ফিরে আসা হয়না

সমীকরণ জানায়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত 'ডানকি ফ্লাইট' এর মাধ্যমে বিদেশে প্রবেশ করতে গিয়ে মারা গিয়েছে অর্ধলক্ষ মানুষ। বহু মানুষের লাশও পাওয়া যায়নি আর। কর্পূরের মতই উবে গিয়েছে তারা। হিরানির 'ডানকি'র প্রোটাগনিস্ট 'পাঞ্জাবি যুবক' এর আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে সেসব মানুষকেই। হয়তো পাওয়া যাবে বসনিয়ার জঙ্গলে দেড় বছর ধরে আটকে থাকা সিলেটের সেই এনামুলকেও। যিনি এখন পর্যন্ত ২৩ বার চেষ্টা করেছেন সীমান্ত পাড়ি দেয়ার। যিনি এখন পর্যন্ত খুইয়েছেন বিশ লাখ টাকা! যিনি এখনও পর্যন্ত হননি সফল! এরকম অজস্র মর্মস্পর্শী আখ্যানের যে 'ডানকি ফ্লাইট', তা নিয়ে কিভাবে ডিল করবে এ সিনেমা, মূল আগ্রহ সেখানেই। 'ডানকি'র অ্যানাউন্সমেন্ট ভিডিও হয়তো বেশ উইটি, কিন্তু যে বিষয় নিয়ে এ সিনেমা, সে বিষয় যে বিস্তর বিষাদগ্রস্ত, ধ্রুবসত্যি সেটাও। এবং রাজু-শাহরুখ জুটি কিভাবে গভীর এ বিষাদকে পর্দায় স্পষ্ট করবেন, মূলত সেটাই আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা