মোদ্দা কথা এটাই, সময়ের এই প্রকোষ্ঠে এসে মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রির বাইরের ছোট ছোট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোও দুর্দান্ত সিনেমা নির্মাণের সাহস করছে। আমিষ, গামাক ঘর, কিল্লা'র মতো সিনেমাগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে, আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে, মানুষকে ভাবাচ্ছেও। 'সিনেমা' নামক ডাকাবুকো খোকার সার্থকতা ও চমৎকারিত্ব তো ঠিক এখানেই...

উপমহাদেশের 'সিনেমা' যখন সদ্যোজাত শিশু, সে সময়কার নির্মাণগুলোর কাঠামোর মধ্যে বিস্ময়ের উপাদান ততটা ছিলো না। ধর্মীয়, সামাজিক, রোমান্টিক গল্পের চেনাপরিচিত গণ্ডির মধ্যেই আটকে ছিলো সাদা-কালো কিংবা রূপোলী পর্দা। তবে সে স্থবিরতা ছিলো সাময়িক। এরপর সময় পাল্টেছে। 'সিনেমা' নামক শিশুও ক্রমশ প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে। নির্মাণের পেছনের কারিগরদের চিন্তা ক্ষুরধার হয়েছে। সবকিছুর মিলিত বদান্যতায়, আদ্যিকালের সিনেমার  প্রথাগত কাঠামো ভেঙ্গেছে, ভেঙ্গে ছত্রখান হয়েছে। এখন সিনেমার চৌহদ্দির কোনো তালতলা নেই। যেকোনো প্রেক্ষাপট, যেকোনো আঙ্গিক, যেকোনো ছোটখাটো ঘটনাও সাঁই করে চলে আসতে পারে প্রেক্ষাগৃহে। মুগ্ধ করতে পারে বিস্ময়াভিভূত একরাশ চোখকে! 

ভিন্ন কনসেপ্ট নিয়ে সিনেমা আজকাল আকছারই হয়। এবং ভাবনা-উদ্রেগকারী এ জাতীয় সিনেমার কথা বললে প্রথমেই মাথায় আসে মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির কথা। হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তাদের অভিনব সিনেমা নেই। কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ছে কয়েকদিন আগে দেখা 'হোম' সিনেমার কথা। তথ্যপ্রযুক্তিতে অতটা সড়গড় না এমন এক বাবার একদিন সাধ হয় স্মার্টফোন ব্যবহার করবেন। তার ছেলে তাকে স্মার্টফোন কিনেও দিলেন। কিন্তু এরপরেই শুরু হলো বিপত্তি। প্রযুক্তির অজ্ঞতা ঘটাতে শুরু করলো বিস্তর অঘটন। আপাতদৃষ্টিতে, সিনেমার গল্প খুবই সাধারণ। কিন্তু নির্মাণের গুণে এ সিনেমাই রূপান্তরিত হয় দারুণ এক আখ্যাণে! 

এরকম অভিনব ভাবনার চিন্তা-উদ্রেগকারী সিনেমা আছে আরো অজস্র। সেসবের মধ্যিখান থেকে বাছাই কিছু সিনেমা নিয়ে আজকের কথাবার্তা। 

১. আমিষ

এ সিনেমা যেভাবে শুরু হয়েছিলো এবং যেভাবে হয়েছে শেষ, তা স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কারো দূরতম কল্পনাতেও আসার কথা না৷ সিনেমার অধিকাংশ জুড়েই খাবার-দাবার এর সুন্দর উপস্থাপনা। সেসব মুখরোচক খাবারের সাথে অদ্ভুত গা ছমছমে এক গল্পকে যেভাবে ব্লেন্ড করলেন নির্মাতা ভাস্কর হাজারিকা, মুগ্ধ হয়েছিলাম। সিনেমায় পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী খুব বেশি ছিলেন না। অথচ যারা ছিলেন, তাদের কারো অভিনয় দেখে বোঝার ছিঁটেফোঁটাও জো রইলো না যে, তারা প্রথমবারের মতন অভিনয় করছেন পর্দায়। গল্প, নির্মাণ, অভিনয়...সবমিলিয়ে 'আমিষ' এর মতন সিনেমা সাম্প্রতিককালে বিরল। খুবই বিরল।

আমিষ! 

২. ভিসারানাই

পরিচালক কিংবা চিত্রনাট্যকার হিসেবে ভেট্রিমারান কতটা সিদ্ধহস্ত, তা প্রায় সবাই জানেন। এবং ভেট্টিমারান কে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে 'ভিসারানাই' সিনেমার কথা। এ সিনেমা যখন প্রথম দেখি, নৃশংসতার তীব্রতায় গা গুলিয়ে এসেছিলো। পুলিশ কাস্টডিতে আসা চার নিরপরাধ তামিল শ্রমিক, তাদেরকে জোরপূর্বক এমন অপরাধ স্বীকার করতে বলা যে অপরাধ তারা করেনি, সে অপরাধ-স্বীকারে অস্বীকৃতি জানানোর পরেই নেমে আসা নৃশংস অত্যাচার...শিউরে উঠেছি ক্ষণেক্ষণে। 'এম চন্দ্রকুমার' এর বই 'লকআপ' অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় প্রশাসনের পৈশাচিক অবয়ব, সিস্টেমের ফাঁকফোকর, সামাজিক কুষ্ঠরোগ পর্যায়ক্রমে যেভাবে উঠে আসে, বিস্মিত হয়েছি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এ সিনেমাটি ২০১৭ সালের অস্কারে ভারতের অফিশিয়াল এন্ট্রি হিসেবে অংশও নিয়েছিলো।

ভিসারানাই! 

৩. তিথি

কর্ণাটকের খুব প্রত্যন্ত এক গ্রামে মারা যান শতবর্ষী এক বৃদ্ধ। তার মৃত্যুর পরবর্তী মুহুর্ত থেকেই গ্রামটিতে কাহিনীর ঘনঘটা শুরু হয়৷ 'গাদাপ্পা' নামের এই বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে একে একে সে গ্রামে উপস্থিত হয় তার ছেলেমেয়ে, নাতিরা। সিনেমা যত সামনে এগোয়, এই বৃদ্ধের সাথে সম্পর্কিত মানুষগুলোর নানাবিধ বিচিত্র মানসিক জটিলতার মুখোশ খুলতে থাকে। শতবর্ষী বৃদ্ধের জমিজমা ছিলো বিস্তর, তা নিয়ে কোন্দল বাড়ে। কোন্দল বাড়ে চরিত্রগুলোর মধ্যেও। তারই ফলশ্রুতিতে সিনেমা ক্রমশ ঢুকতে থাকে অনিশ্চিত সব গলি-উপগলিতে৷ কন্নড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই সিনেমা নিয়ে যেমন নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলা ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন, তেমনি একগাদা আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছিলো রাম রেড্ডির এই অনবদ্য নির্মাণ। সারকাজম, কালচারাল ডাইভার্সিটি এবং মেটাফোরের মিশেল এ সিনেমা মাস্টওয়াচ! 

তিথি

৪. কিল্লা

মারাঠি ভাষার এ সিনেমার চিন্তাভাবনা খুব যে উচ্চমার্গের তেমনটি বলা যাবে না। বরং 'সহজ কথা যায় যে বলা সহজে'র এক সুন্দর নিদর্শন হিসেবে 'কিল্লা'কে সামনে দাঁড় করানো যেতে পারে। এগারো বছরের এক ছেলে যে সম্প্রতি তার বাবাকে হারিয়েছে, সে কিভাবে জীবন-সংগ্রামে নেমে যাচ্ছে, তা নিয়েই গল্প। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়া, সেখানে আস্তে আস্তে কিছু বন্ধু পাওয়া, বয়সের গাছপাথর ক্রমশ বাড়তে থাকা...এসব নিয়ে গল্পের আঁকিবুঁকি, জটিলতা। বলে রাখা ভালো, সিনেমার প্রোটাগনিস্ট শিশু হলেও এ সিনেমা শিশুদের না। সিনেমায় সহজবোধ্য অনেককিছু থাকলেও, এ নির্মান প্রাপ্তবয়স্কদেরই ভাবাবে। 'কিল্লা'র নির্মাতা অবিনাশ অরুণের এ সিনেমা বারবার দেখার মতনই এক নির্মাণ। 

কিল্লা! 

৫. গামাক ঘর 

শহুরে ইট-কাঠের জঞ্জালে মাঝেমধ্যেই হাপিত্যেশ ওঠে আমাদের সবার। নাভিশ্বাস ওঠা এই শহুরে সময়গুলোতে চোখ রাখতে হয় গ্রামে। যেখানে আমাদের অনেকেরই শেকড় পোঁতা। 'গামাক ঘর' ডাঁটাশাকের শুকনো পাতার মতন অতীত এবং প্রাচীন শৈশবের গ্রামকেই যেন মনে করায়। এখানে কাহিনীর জটিলতা নেই, বিস্তর চিন্তায় হৃদয় বিদীর্ণ হওয়া নেই, এ যেন ছিমছাম এক গল্প, যে গল্পে দুঃখ আছে, সুখ আছে। আছে বায়োস্কোপ চোখে সময়কে ফিরে দেখাও। আচল মিশ্র'র 'গামাক ঘর'  উপলব্ধির জলাশয়ে আলোড়ন তোলার মতন সিনেমা। চোখ আর্দ্র হওয়ার মতন সিনেমা। 

গামাক ঘর! 

৬. বিরিয়ানি 

মালায়ালাম এ সিনেমা শুরুর দৃশ্য থেকেই দারুণ ধাক্কা দেবে দর্শককে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, সে সমাজে 'খাদিজা' নামক এক নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়েই পুরো গল্প। কিন্তু এ সংগ্রাম শুনতে যতটা প্রথাগত মনে হয়, পর্দার রূপান্তর তার থেকেও বহুগুণ বেশি জটিল। সিনেমার কিছু কিছু অংশ এমন, প্রচণ্ড বিস্ময় হবে, চিন্তাভাবনার প্রাচীরে চির ধরবে, পেটের নাড়িভুঁড়ি উলটে আসতে চাইবে। 'বিরিয়ানি' ঠিক এভাবেই সফল। সাজিন বাবু'র এই সিনেমা প্রচণ্ড দমবন্ধ এক অনুভূতি দেবে। ক্ষণেক্ষণেই বোঝাবে জীবন-গল্প কতটা অমানবিক হতে পারে! 

বিরিয়ানি! 

 

৭. লাইভ ফ্রম ঢাকা

এরকম অমানবিক গল্পের আরেক সিনেমা 'লাইভ ফ্রম ঢাকা!' আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ'কে 'রেহানা মরিয়ম নূর' এর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার বদৌলতে প্রায় সকলেই চেনেন। তবে যখন এই নির্মাতাকে অনেকেই চিনতেন না, সেসময়ে সাদ নির্মিত প্রথম সিনেমা 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' দেখে চমকে উঠেছিলাম। চমকে উঠবোও না বা কেন, এরকম দমবন্ধ, বিষাদগ্রস্ত গল্প তো দেখিনি অনেকদিন!  সাজ্জাদ নামের এক মানু্ষ, যিনি তেলাপোকার মতন কুঁকড়ে বেঁচে আছেন ঢাকার কোনো এক প্রকোষ্ঠে, সে মানুষটিই এ সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। এ গল্পে প্রেম আছে, বিশ্বাস আছে, বিশ্বাসঘাতকতাও আছে। সাদা-কালো জীবনের জঞ্জালও আছে। সবকিছু মিলিয়েই 'লাইভ ফ্রম ঢাকা'র অভিনবত্ব! বাংলাদেশেও এরকম সিনেমা হতে পারে, তা ভাবিনি কখনোই। 

লাইভ ফ্রম ঢাকা! 

৮. ম্যান্ডেলা

তামিল এই সিনেমার দারুণ দারুণ সব সারকাজম, হিউমার এবং অন্তরালের খুব বোল্ড এক বার্তার সন্ধান পেয়ে যারপরনাই চমকে উঠেছিলাম। ম্যাডোনে আশ্বিনের এ সিনেমার দুই ঘন্টা বিশ মিনিটের টাইমলাইনে এত এত সব লেয়ার উঠে এসেছে, অবিশ্বাস্য! জাতপ্রথা, নির্বাচনের প্রহসন থেকে শুরু করে স্থানীয় কোন্দল, রাজনীতির জাঁতাকল, ধর্ম-অধর্ম... কী নেই! স্থানীয় এক নরসুন্দর, যার নাম 'ম্যান্ডেলা', তাকে ঘিরেই গল্প এগোয় শুরু থেকে শেষপর্যন্ত। ভারিক্কি চালের কোনো কথা নেই। স্ক্রিনপ্লে'তে কোনো জটিলতা নেই। আছে ছিমছাম এক গল্প। আছে শক্তিশালী সামাজিক বয়ান। 'ম্যান্ডেলা' ঠিক এখানেই চমৎকার!

ম্যান্ডেলা! 

এই নির্মানগুলোর বাইরেও বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির আরো অজস্র দুর্দান্ত নির্মাণ আছে। সেসব নির্মাণের সিকিভাগকেও এক লেখায় স্পর্শ করা খুব দুরূহ এক কাজ। তাই কলমের ডগায় অনেক তুখোড় নির্মাণকে না আনার আক্ষেপ থেকেই যায়। সে আক্ষেপ থাকবেই। তারপরেও মোদ্দা কথা এটাই, সময়ের এ প্রকোষ্ঠে এসে মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রির বাইরের ছোট ছোট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিগুলোও দুর্দান্ত সিনেমা নির্মাণের সাহস করছে। আমিষ, গামাক ঘর, কিল্লা'র মতন সেসব সিনেমাগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে৷ মানুষকে ভাবাচ্ছেও। 'সিনেমা' নামক ডাকাবুকো খোকার সার্থকতা এখানেই। উৎকর্ষও এখানেও। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা