অস্কারজয়ী 'এনকান্তো'র জাদুর জগৎ ও কিছু জীবনবোধ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

পরিবারে যে কেউ কারো শত্রু না, বরং, সবাই যার যার দিক থেকে যে আপ্রাণ চেষ্টাই করে যায় পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে, 'এনকান্তো'তে খুব স্পষ্টভাবে ভাস্বর হয়ে উঠেছে সেটি। ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম হয়ে যাওয়া 'পারিবারিক সম্প্রীতি'র এই বিক্ষুব্ধ সময়ে 'এনকান্তো'র বয়ান সেজন্যেই এতটা স্পষ্ট, প্রাসঙ্গিক। এবং সময়োপযোগী। ঠিক সে কারণেই, এই সিনেমা দেখা এবং উপলব্ধি করা উচিত সবারই।
যদি বিগত কিছু বছরের অ্যানিমেশন সিনেমার হালচাল কেউ একটু গভীর মনোযোগে দেখেন, তাহলে একটা বিষয় লক্ষ্য করে অবাক হতেই হবে- গল্প দিয়ে চমকে দেয়ার বিষয়টা কেন যেন বেশ প্রকটভাবেই অনুপস্থিত সাম্প্রতিক সময়ের সিংহভাগ অ্যানিমেশন সিনেমায়। চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্স, রঙচঙে প্যালেট কিংবা নানা বিষয়আশয় এর কমতি মোটেও নেই, কিন্তু 'র্যাটাটুলি' কিংবা 'সোল' দেখে যেরকম মুগ্ধ হওয়ার একটা বিষয় থাকতো, খানিকটা ভাবনার খোরাক থাকতো... সেটাই যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে গড়পড়তা নির্মাণগুলো থেকে। আবার, যেহেতু বাচ্চাদের 'টার্গেট অডিয়েন্স' করেই বানানো হচ্ছে সিনেমাগুলো, সেহেতু খুব যে গূঢ় বার্তার সুলুকসন্ধান এসব নির্মাণে থাকবে না, সেটিও জানা। তবে তাই বলে গল্প মোটেও গভীর প্রকোষ্ঠে নামবে না, ছিঁটেফোঁটা দাগ পড়বে না হৃদয়ে, সেটাও খানিকটা কেমন যেন।
যদিও এই অভিযোগ থেকে পুরোপুরিই মুক্তি পাবে এবারের অস্কারে শিরোপাজয়ী অ্যানিমেশন সিনেমা 'এনকান্তো।' যে সিনেমার মূল উপজীব্য- কলম্বিয়ান এক জাদুর বাড়ি 'কাসিতা'য় বসবাসরত প্রচণ্ড বর্ণময় 'মাদ্রিগাল পরিবার' এর কিছু অধিবাসী এবং তাদের যাপিত কার্যকলাপ। পাশাপাশি উপজীব্য, 'রিফিউজি' কিংবা 'ক্ষমতাহীন' হওয়া আক্ষেপের গল্প। এবং এসবের পাশাপাশি উপস্থিত- মূল গল্পকে সঙ্গত দেয়ার জন্যে হাস্যরস, সঙ্গীত কিংবা চটকদার গল্পবয়ান! একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে- 'এনকান্তো'তে এমন কিছু সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জীবনবোধেরও ইঙ্গিত আছে, যেসব ইঙ্গিতের যোগসূত্রই মূলত এ নির্মাণকে করেছে সবার থেকে ভিন্ন, স্বকীয়, বিশেষ।
'এনকান্তো'র গল্প শুরু হয় কলম্বিয়ান মাদ্রিগাল পরিবারকে উপজীব্য করে, যে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যেরই কিছু না কিছু জাদুর ক্ষমতা আছে। না, একটু ভুল বললাম। এই পরিবারের একজন সদস্যের কোনো জাদুর ক্ষমতা নেই, এবং বলাই বাহুল্য, সেই মানুষটিই এই গল্পের প্রোটাগনিস্ট। তিনি মিরাবেল। যেখানে মিরাবেলের পরিবারের কেউ ইচ্ছে হলেই ফোটাতে পারে ফুল, কেউ চাইলেই বানাতে পারে মেঘ কিংবা বৃষ্টি, দালানকোঠা হেলায় নড়িয়ে দিতে পারে কেউ, অথবা কেউ বুঝতে পারে পশুপাখির ভাষা... সেখানে মিরাবেলের এই যে ক্ষমতাহীনতা, তা মাঝেমধ্যেই প্রচণ্ড বিমর্ষ করে তাকে। আশেপাশের সবাই ঠারেঠোরে তাকে তার অক্ষমতা বুঝিয়েও দেয়। এবং 'মাদ্রিগাল পরিবার' এর যিনি কর্ত্রী, অর্থাৎ, আবুয়েলা আলমা, তিনিও কেন যেন খুব একটা গুরুত্ব দেন না মিরাবেলকে।
এভাবেই দিন কাটে। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে মিরাবেল জানতে পারে, তাদের জাদুর বাড়ি 'কাসি'তা, যে কাসিতা'র উপরে ভরসা করে আছে পুরো গ্রামবাসীর ভাগ্য, সেটি ধ্বংসের মুখোমুখি। ভয়ঙ্কর সংকটের লালচোখ দেখে শঙ্কিত মিরাবেল উঠেপড়ে লাগে পুরো পরিবারকে একাট্টা করতে, পাশাপাশি চেষ্টা করে নিজেদের কাসিতাকেও বাঁচাতে। এবং এভাবেই গল্প এগোতে থাকে নানা ঘটনা-অঘটনায়। যদিও শেষপর্যন্ত শেষরক্ষা হয় কী না, 'কাসিতা' বহাল তবিয়তে থাকে কি না...সেসব জানার জন্যে সিনেমা দেখাই হবে সমীচীন। সেসব তাই আর খোলাসা করছি না মোটেও।
'এনকান্তো' ভালো লাগার কারণ বহুবিধ। প্রথম কারণ- গল্প ও গল্পের তলদেশে মনিমুক্তোর খোঁজ। 'এনকান্তো' কলম্বিয়ান যে পরিবারের গল্প বলে, সে গল্প কোথায় গিয়ে যেন আমাদের যাপিত পরিবারের সাথেই মিলে যায়। 'মাদ্রিগাল পরিবার' এর চরিত্রেদের এমন করেই বানানো, তাদের সাথে বাস্তবের গড়পড়তা প্রত্যেক পরিবারের কোনো না কোনো চরিত্র মিলবেই৷ এবং ঠিক সে কারণেই গল্প আর গল্পে খোলসবদ্ধ না থেকে ঢুকে পড়ে ব্যক্তিগত জীবনের সমীকরণে। তৃপ্তি দেয়। এবং এ গল্পের যে সারমর্ম, অর্থাৎ, চড়াই কিংবা উৎরাইয়ে পরিবারের সঙ্গ না ছাড়া, মায়া কিংবা স্নেহের বাঁধনে সবাইকে জমাটবদ্ধ করে রাখা... এসব ক্রমে ক্রমে উঠে আসে এ গল্পেও। মোট কথা, জীবনবোধেরই এক স্বাভাবিক অথচ নতুন দিক উঠে আসে এই সিনেমার বরাতে।

দ্বিতীয়ত- রঙচঙে বৈচিত্র্য ও গান। বড় স্ক্রিনে 'এনকান্তো' দেখার অভিজ্ঞতা যাদেরই হবে, তাদের যে চোখে লেগে থাকবে এই সিনেমা, তা হলফ করেই বলা যায়। 'ডিজনি'র সিনেমায় 'কালারফুল অ্যাসথেটিজম' থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এবং 'এনকান্তো'তে তা ছিলো বেশ ভালোভাবেই। তাছাড়া কলম্বিয়ান কালচারের নানা বিষয়আশয় যেমন- পঞ্চো, রঙবেরঙ এর নকশাদার জামাকাপড় এবং অতি অবশ্যই গান যেভাবে ব্যবহার করা হলো, সেটিও বেশ মুগ্ধতা ছড়ালো। এ সিনেমায় গান যেন খানিকটা আলাদাভাবেই গুরুত্ব পেলো। 'মাদ্রিগাল পরিবার' এর প্রতিটি সদস্যকে যেভাবে গান গেয়ে পরিচয় করানো হলো, অভিনবত্ব রইলো সেখানেও। যদিও গানগুলোর সুর কিংবা লিরিক্সে নতুনত্ব কিংবা ভালো লাগার দিকটা কম পেয়েছি, তবে ব্যতিক্রমও আছে। এ সিনেমারই 'উই ডোন্ট টক অ্যাবাউট ব্রুনো' বিশ্বব্যাপী কুড়োলো সুনাম। বিলবোর্ডের স্ট্রিমিং গানের চার্টে 'নাম্বার ওয়ান' পজিশন দখল করলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এটাই ডিজনির প্রথম গান যারা প্রথমবারের মত এ চার্টের শীর্ষস্থান ছুঁতে পেরেছে। এ গান ছাড়া বাদবাকি গানগুলো যে খুব অখাদ্য, এমন না। সিনেমার মূলভাব কিংবা কলম্বিয়ান টোন অনুযায়ী মোটেও বেখাপ্পা না। বরং, বেশ সাবলীল। ভালো লাগলো।
তৃতীয়ত- 'পিক্সার' যেমন 'কোকো' সিনেমায় মেক্সিকান কালচারকে হোমাজ দিয়েছিলো, তেমনি 'ডিজনি'ও যে 'এনকান্তো'তে কলম্বিয়ান কালচারকে ট্রিবিউট দিয়ে নিজেদের সিনেমার গণ্ডি ওয়ার্ল্ড ম্যাপে নিয়ে এলো, এ বিষয়টা বেশ ইতিবাচক লাগলো। অ্যানিমেশন সিনেমায়ও যদি এভাবে ক্রস-কালচারের নিদর্শন নিয়মিত দেখা যায়, তা দিনশেষে আমাদের জন্যেই ভালো। দর্শকের জন্যে ভালো। সংস্কৃতির বিনিময় কিংবা প্রচার-প্রসারের জন্যেও ভালো।

মূলত, এসব কারণ মিলিয়ে মিশিয়েই 'এনকান্তো' গত বছরের প্রিয় অ্যানিমেশন সিনেমাগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে ছিলো। এই সিনেমায় সবচেয়ে ভালোভাবে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, সেটির মূলসূত্র যা, অর্থাৎ- সবার উপরে পরিবারের প্রাধান্য, সেটি বেশ প্রাসঙ্গিক লেগেছে। পাশাপাশি, পরিবারে যে কেউ কারো শত্রু না, বরং, সবাই যার যার দিক থেকে যে আপ্রাণ চেষ্টাই করে যায় পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে, 'এনকান্তো'তে খুব স্পষ্টভাবে ভাস্বর হয়ে উঠেছে সেটিও। ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম হয়ে যাওয়া 'পারিবারিক সম্প্রীতি'র এই বিক্ষুব্ধ সময়ে 'এনকান্তো'র বয়ান সেজন্যেই এতটা স্পষ্ট, প্রাসঙ্গিক। এবং সময়োপযোগী। ঠিক সে কারণেই, এই সিনেমা দেখা এবং উপলব্ধি করা উচিত সবারই।