কেন 'ফ্যামিলি ম্যান' এর দ্বিতীয় সিজন নিষিদ্ধের দাবী তুলছে তামিলনাড়ুর মানুষ?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

তামিলনাড়ু রাজ্যের সরকারী দল আর বিরোধী দল, দুই পক্ষই বলছে, এই সিরিজ নাকি তামিল জনগনের অনুভূতিতে আঘাত হানবে। কিন্তু এই বিতর্কের উৎস কোথায়? তামিল অনুভূতির সঙ্গে ফ্যামিলি ম্যান এর গল্পেরই বা সম্পর্ক কী?
অ্যামাজন প্রাইমের ওয়েব সিরিজ 'দ্য ফ্যামিলি ম্যান' এর ওপর ঠিক কার কুদৃষ্টি পড়েছে, এটা নিয়ে একটা গবেষণা হতে পারে। একে তো করোনার কারণে শুটিংয়ে বাধা এসেছে, মুক্তির তারিখ পিছিয়েছে কয়েক দফায়। এবছরের ফেব্রুয়ারীতে যখন মুক্তির দিনক্ষণ ঘোষণা করা হবে, তখনই ভারতের তথ্য মন্ত্রণালয় আচমকা নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে দিলো ওটিটি কন্টেন্টের ওপর, নির্মাতাদের স্বাধীনতায় এলো হস্তক্ষেপ। মামলার ঝুঁকি এড়াতে বিতর্কিত বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে অনেকটা কেড়েছেঁটে সাজানো হয়েছিল সিরিজটির প্লট।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর দ্য ফ্যামিলি ম্যান এর ট্রেলার রিলিজ পেয়েছে ক'দিন আগেই, মুক্তির তারিখও ঘোষণা হয়ে গেছে। অথচ জুনের ৪ তারিখে মুক্তি পেতে যাওয়া ফ্যামিলি ম্যান নিষিদ্ধের দাবীতে এখন একাট্টা ভারতের তামিলনাড়ুর মানুষ। সেখানকার সরকারী দল আর বিরোধী দল, দুই পক্ষই বলছে, এই সিরিজ নাকি তামিল জনগনের অনুভূতিতে আঘাত হানবে। কিন্তু এই বিতর্কের উৎস কোথায়? তামিল অনুভূতির সঙ্গে ফ্যামিলি ম্যান এর গল্পেরই বা সম্পর্ক কী?
ট্রেলারে দক্ষিণী অভিনেত্রী সামান্থা রুথ প্রভুকে দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগার গেরিলার চরিত্রে। পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি আইএসআইয়ের সঙ্গে মিলে যারা হামলা করতে চায় ভারতের ভুখণ্ডে। সেই হামলা রুখে দেয়ার দায়িত্ব পড়ে ফ্যামিলি ম্যান এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীকান্ত তিওয়ারি ওরফে মনোজ বাজপাইয়ের ওপর, যে কিনা পারিবারিক অশান্তিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দিল্লি থেকে চেন্নাইতে পোস্টিং নিয়েছে।
তামিল টাইগার গেরিলাদের প্রতি ভারতের তামিলনাড়ুর মানুষের একটা সফট কর্ণার অনেক আগে থেকেই আছে। এই সংগঠনটির জন্ম শ্রীলঙ্কায়। সেদেশে তামিল জনগোষ্ঠী বরাবরই নিপীড়নের শিকার হতো সংখ্যাগুরু সিংহলিজদের হাতে। ক্ষমতায় থাকা সিংহলিজরা তাদের বঞ্চিত করছিল নানাভাবে, একাত্তরের আগে পশ্চিম পাকিস্তান যেমন আমাদের বঞ্চিত করতো। ভাষার ক্ষেত্রেও বঞ্চনার শিকার হয় তামিলরা, তাদের ভাষাকে দেশটির অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়নি। সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি- সব জায়গাতেই বাধার সম্মুখীন হতো তামিলরা, এমনকি তাদেরকে ঠেকানোর জন্য রিজার্ভেশন সিস্টেমও চালু করা হয়েছিল।
এই বঞ্চনা আর ক্ষোভ থেকেই তামিলরা বিদ্রোহ শুরু করে। জন্ম হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তামিল টাইগার্সের, তারা সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এবং পুলিশের সঙ্গে, দেশজুড়ে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। তামিল টাইগারদের অস্ত্র এবং টাকা দিয়ে সাহায্য করতো ভারত সরকার, কারন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু ছিল পুরোপুরি তামিল অধ্যুষিত একটা এলাকা, স্বভাবতই স্বজাতির প্রতি একটা টান ছিল তামিলনাড়ুর লোকজনের।
আশির দশকের শেষ ভাগে রাজীব গান্ধীর ভারত সরকার যখন তামিলদের সাহায্য করা বন্ধ করে উল্টো শ্রীলঙ্কার সিংহলিজ সরকারের সঙ্গে হাত মেলালো, তখন তামিল টাইগারদের একটা দল আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে রাজীব গান্ধীকেই হত্যা করেছিল। তাতেও অবশ্য শ্রীলঙ্কান তামিলদের প্রতি তামিলনাড়ুর জনগনের ভালোবাসা কমেনি। এখনও শ্রীলঙ্কান তামিলদের নিজেদের একজন হিসেবেই মনে করেন সেখানকার লোকেরা। তামিলনাড়ুতে অজস্র শ্রীলঙ্কান তামিলিয়ান বাস করেন, যারা নিজের দেশ থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন সাগর পাড়ি দিয়ে।

ইতিহাস কপচানো হয়ে যাচ্ছে বেশি, ফ্যামিলি ম্যান নিয়ে বিতর্কে ফিরে আসি। ফ্যামিলি ম্যান এর দ্বিতীয় সিজনের ট্রেলার রিলিজের পর থেকেই তামিলনাড়ুর লোকজন সমালোচনায় মত্ত হয়েছেন। রাজ্যের বিরোধী দলের নেতা ভাইকো এবং সিমান, দুজনেই তামিল গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই সংগঠনটিকে জঙ্গীবাদী সংগঠন হিসেবে উপস্থাপনটা তারা মেনে নিতে পারেননি। তামিলনাড়ুর সরকারে থাকা দল ডিএমকে'ও বিরোধিতা করেছে তামিল গেরিলাদের এভাবে ভারতের ওপর শত্রু হিসেবে দেখানোর।
দুই পক্ষই এক হয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী প্রকাশ জাবড়েকরের কাছে আবেদন করেছে, ফ্যামিলি ম্যান এর দ্বিতীয় সিজন যেন মুক্তি দেয়া না হয়। এতে তামিল জনগনের অনুভূতিতে আঘাত আসবে। তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকার এবং বিরোধী দল বলছে, সিরিজটি মুক্তি পেলে এখানকার জনগনের মধ্যে যে ভাতৃত্ববোধ আছে, সেটা নষ্ট হতে পারে। দক্ষিণী অভিনেত্রী সামান্থার অভিনীত তামিল গেরিলার চরিত্রটি নিয়ে তাদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি। তামিলনাড়ুর সাধারণ মানুষজনও টুইটারে হ্যাশট্যাগ দিয়ে সমালোচনা করছে ফ্যামিলি ম্যান এর পরিচালক রাজ এন্ড ডিকে'র।
কিন্তু দুই পরিচালক নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আড়াই মিনিটের একটা ট্রেলার দেখে সিরিজের পুরো কাহিনী কিভাবে আন্দাজ করা সম্ভব? সিরিজে তামিল টাইগার গেরিলাদের পজিটিভলি উপস্থাপন করা হয়েছে নাকি ভিলেন হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেটা জানার জন্যে তো সিরিজটা দেখতে হবে। সিরিজ মুক্তির আগেই একটা গুজব তুলে দিয়ে সেটাকে রুখে দেয়ার চেষ্টাটা অন্যায়। তারা তামিলনাড়ুর মানুষকে আশ্বস্ত করেছেন, কোন জাতিসত্তার মানুষকে আঘাত করার মতো উপাদানই দ্য ফ্যামিলি ম্যান- এ নেই।
এর আগেও তামিল জনগনের তীব্র বিরোধিতার মুখে মুরালিধরনের বায়োপিক '৮০০' থেকে সরে যেতে হয়েছিল অভিনেতা বিজয় সেথুপতিকে। ফ্যামিলি ম্যান এর ভাগ্যে কি আছে, সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই জানা যাবে। কারণ দুই পক্ষই এখনও অনড় অবস্থানে। আর তাতে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে সাধারণ দর্শক আর ফ্যামিলি ম্যান এর ভক্তদের।