ফারুকীকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন, তার কাজকে অপছন্দ করতে পারেন, ফারুকীর প্রচারণার ধরণটা আপনার পছন্দ না হতে পারে- কিন্ত ফারুকীকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না কখনও।

তিনি নন্দিত একজন, নিন্দিতও বটে। তিনি তুমুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব, সেইসঙ্গে খানিকটা সমালোচিতও। আমাদের দেশের নিয়মই এটা। আপনি যা'ই করবেন, সেটার পজিটিভ-নেগেটিভ দুটো ইমপ্যাক্টই থাকবে। কেউ আপনার কাজ পছন্দ করবে, কেউ করবে না, আবার একদল ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জোর নিয়ে নিন্দা করতে নেমে যাবে। তবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নামের মানুষটার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় নিন্দুকও নির্দ্বিধায় স্বীকার করে যে, এই লোকটার মেধার তুলনা হয় না। এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমার বলয় ভেঙে অন্য একটা ধারার জন্ম দেয়ার পেছনে যাদের খুব বড় ধরনের অবদান আছে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাদেরই একজন।

তার সঙ্গে আমার প্রথম স্মৃতি 'একান্ন বর্তী' নাটকটা দিয়ে। চ্যানেল আইতে সেটা প্রচারিত হতো বোধহয়। আশির দশকে বাংলা নাটকের একটা জোয়ার ছিল, বাসার সবাই মিলে একসঙ্গে বসে থাকা একটা নাটকের জন্যে, এসব আমরা তখন বড়দের মুখেই শুনেছি। নিজের চোখে সেই দৃশ্যটা দেখা ওই একান্ন বর্তী দিয়েই। ওই ছোট্ট বয়সে নাটক বোঝার সক্ষমতা হয়নি তখনও, তবুও ফয়সাল-ফরহাদ-ফাহিম-শিউলি-পলা-টুশি চরিত্রগুলো আমার কত আপন হয়ে উঠেছিল! কাব্য নামের শ্যামলামতোন ছোট্ট ছেলেটার ভেতরে নিজেকে আবিস্কার করাতাম যেন। প্রতি পর্বের শেষে পরিচালকের জায়গায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নামটাই চোখে পড়তো শুধু। মানুষটা দেখতে কেমন, লম্বা না মোটা, বেঁটে না চ্যাপ্টা কিছু জানতাম না।

একান্নবর্তীর পঞ্চাশতম পর্বে সব অভিনেতা-অভিনেত্রী আর ক্যামেরার পেছনের মানুষদের নিয়ে একটা বিশেষ পর্বের মতো করা হলো। সেখানেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নামের মানুষটাকে প্রথম দেখলাম। ছোটখাটো গড়নের যুবকমতো একটা মানুষ। অতি আপনজন হয়ে টেলিভিশন নামের বোকাবাক্সের মধ্যে দিয়ে যিনি ঢুকে বসে গেলেন আমাদের বাসার ড্রয়িংরুমে! ফারুকীর কাজ বা তার মেধার পরিমাণ বোঝার মত্য বয়স তখন আমার হয়নি, সেসব অনেক বছর বাদে বুঝতে শিখেছি।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী মানুষটা সবসময়ই স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে গেছেন, ভিন্নধর্মী কিছু করার চেষ্টা করেছেন, অন্যদের অনুকরণ না করে, চলতি স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন সবসময়ই। এজন্যে তাকে কম কথা শুনতে হয়নি, কম সমালোচনা সইতে হয়নি। বাংলা ভাষাটাকে তিনি ধ্বংস করে দিচ্ছেন বলে অপবাদ দেয়া হয়েছিল এককটা সময়ে, অভিযোগ ছিল- তিনি মানুষের মুখের ভাষাটাকে টেলিভিশনে নিয়ে এসেছেন। অভিযোগটা মিথ্যে নয়, বাংলা নাটকে 'করতেসি, খাইতেসি, যাইতেসি' টাইপের শব্দচয়ন ফারুকীর হাত ধরেই এসেছে। কিন্ত সেগুলো আমাদের মুখের ভাষা, আমরা এভাবেই কথা বলি, এভাবেই মনের ভাব প্রকাশ করি। সেই বাস্তবতাটাকেই পর্দায় তুলে এনেছেন ফারুকী, আর এটাই গাত্রদাহের কারণ হয়েছিল অনেকের।

'ওয়েটিং রুম' নামের নাটক দিয়ে যাত্রা শুরু, তারপর বিজ্ঞাপন আর সিনেমা দিয়ে দর্শককে মাতিয়েছেন। একান্নবর্তীর পরে ৬৯, ৪২০, ক্যারামের মতো নাটক বানিয়েছেন, মোশাররফ করিমের মতো অভিনেতার জন্ম হয়েছে তার হাতে। কচি খন্দকার, হাসান মাসুদ কিংবা মারজুক রাসেলকেও তারকা অভিনেতা বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি! তার নাটকে সহকারী পরিচালকের কাজ যারা করতেন, সেই ছেলেগুলোকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই জানতেন ফারুকী। তাদের প্রত্যেককে নিজের হাতে ধরে নাটক পরিচালনা শিখিয়েছেন, তাদের জন্যে ছবিয়াল বানিয়েছেন, একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে দিয়েছেন। ফারুকী জানতেন, তিনি চিরদিন থাকবেন না নাটকে। কিন্ত যে ধারাটা তিনি শুরু করেছেন, সেটা তার ভাইবেরাদারদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে।

ফারুকী ও তার ভাইব্রাদার

একটা সময়ে বাংলা নাটক বলতেই আমরা ফারুকী আর তার ভাইবেরাদারদের বুঝতাম। ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, আদনান আল রাজীব, রেদওয়ান রনি, হূমায়ুন সাধু, আশফাক নিপুণ বা মোস্তফা কামাল রাজ'রা টিভি পর্দা মাতিয়েছেন দিনের পর দিন। তাদের টার্গেট অডিয়েন্সই ছিল তরুণ সমাজ, সেই দর্শকশ্রেণীর মন খুব ভালোভাবেই জয় করতে পেরেছিল ফারুকীর ছোট ভাইয়েরা। রাজ এখন সিনেমার নিয়মিত পরিচালক, ফাহমী বা রেদওয়ান রনি'রাও সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। ফারুকী একটা ট্রেন্ড সেট করে দিয়ে গিয়েছিলেন, আলাদা একটা ঘরানার জন্ম দিয়েছিলেন, সাদামাটা হয়েও সাধারণের চাইতে খুব আলাদা ছিল যেটা।

ফারুকী যখন প্রথম সিনেমাটা বানালেন, সেটা তখন আমরা দেখতে পাইনি। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়া ছেলের জন্যে ব্যাচেলর অনেক বেশী অ্যাডভান্সড একটা সিনেমা, দেখলেও হয়তো বুঝতাম না। এই সিনেমাটা আমি অনেক পরে দেখেছি, আর ২০০৩ সালের বাস্তবতায় ব্যাচেলরের অবস্থান কল্পনা করে শিউরে উঠেছি। পনেরো বছর আগে ফারুকী তার নিজস্ব ধারায় যে গল্পটা বলেছিলেন, সেটা এখনও বানানো সম্ভব নয় কারো পক্ষে। লিটনের ফ্ল্যাট কিংবা 'বাচ্চা হবে না' ডায়লগগুলো এখনও তুমুল জনপ্রিয়, এই কথাগুলো আমরা বন্ধুরা বন্ধুদের সাথে বলি, প্রেমিক হয়তো প্রেমিকাকে বলে। কিন্ত টিভি বা সিনেমা হলের পর্দায় এই দৃশ্যগুলোকে দেখাতে অসীম সাহসের প্রয়োজন হয়, সেই সাহস, কিংবা দুঃসাহসটা ফারুকীর বরাবরই ছিল।

মেড ইন বাংলাদেশ বা থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার- এই দুটো সিনেমাও সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রবর্তী। এত রাতে একা একটা মেয়ে রাস্তায় কি করছে, এই প্রশ্নের বিপরীতে এত রাতে একটা ছেলে রাস্তায় কি করছে প্রশ্নটা দিয়েই সমাজের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গিটার দিকে আঙুল তুলেছেন ফারুকী। নিজের সিনেমায় শিক্ষণীয় কিছু আছে বলে কখনও দাবী করেননি তিনি, জীবনের গল্প বলে দর্শককে খানিকটা সময় আনন্দ দিতে চেয়েছেন কেবল।

আর চেয়েছেন বাংলা সিনেমার নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করতে। তার মতে- "আমাদের সিনেমার নিজের কোন ভাষা নাই। আপনি হলিউড সিনেমা দেখলে বুঝবেন সেটা হলিউড সিনেমা, বলিউড সিনেমা দেখলে বুঝবেন সেটা হিন্দি সিনেমা, ইরানি সিনেমা সাউন্ড অফ করে দেখলেও আপনি বুঝবেন সেটা ইরানি সিনেমা। কিন্তু আমাদের সিনেমা দেখলে বুঝা যায় না সেটা আমাদের সিনেমা।" সেই ভাষাটাই তৈরি করতে চেয়েছেন ফারুকী। 

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

আর সেটা করতে গিয়েই কুড়িয়েছেন নিন্দা, তিনি সিনেমা নামের নাটক বানান বলেও দাবী করেছে কিছু মানুষ। তাতে ফারুকী থেমে থাকেননি, তার পথচলা বাধাগ্রস্থ হয়নি একটুও। বাংলা সিনেমাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার কাজটা করে চলেছেন তিনি। সেখানেও সমালোচনা করে কেউ কেউ, তাদের ভাষ্য- ফারুকী সর্বসাধারণের জন্যে সিনেমা বানান না, কেবল পুরস্কারের আশাতেই সিনেমা বানান!

ফারুকী নিয়ে কথা হবে, আর ডুব আসবে না সেখানে- তা কি করে হয়! ডুব নিয়ে অনলাইনে যতো সমালোচনা দেখেছি, তার সিংহভাগই শুধু গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার কারণে। আমার চোখে ডুব টেকনিক্যালি অসম্ভব রিচ একটা সিনেমা, নৈঃশব্দ্যের আলোকে অনেক কিছু বলতে চেয়েছেন ফারুকী, সেই বার্তাটা ধরতে সমস্যা হয়েছে অনেকের। ক্যামেরার কাজ, সাউন্ড ডিজাইন, কস্টিউম, তিনটে আলাদা আলাদা সময়কে ফ্রেমে ধরা- সবকিছু মিলিয়ে ডুব চমৎকার একটা কাজ হতে পারতো, তবে খুঁটিনাটি কিছু ত্রুটি সেটা হতে দেয়নি। 

ফারুকীর সিনেমায় কোথায় যেন একটা বেপরোয়া ভাব আছে, সমাজের ভ্রান্ত সব নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখানোর একটা সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা আছে। আর তাই সমালোচনাটাও বরাবর বেশিই জুটেছে তার পাতে। সেই ‘ব্যাচেলর’ থেকে শুরু করে মেড ইন বাংলাদেশ, পিঁপড়াবিদ্যা বা হালের ডুব- তার প্রতিটা কাজ নিয়েই বিভক্ত হয়েছে দর্শকেরা। তবে ফারুকীর বিশেষত্ব যেটা, কারো কথায় কান না দিয়ে তিনি একমনে নিজের কাজটা করে যান। তার সিনেমা নিয়ে কে কি বললো, এসব ভাবার চেয়ে পরের সিনেমার কাজ এগিয়ে রাখাটাই তার কাছে মূখ্য বিষয়। ফারুকী নিজের ফোকাসটা সিনেমাতেই রাখেন, চারপাশে হাজারো বিতর্ক ডালপালা মেললেও(বা তিনি নিজে সেসব ডালপালার জোগান দিলেও), সেগুলো তাকে ছুঁতে পারে খুব কমই। 

নওয়াজউদ্দিনের সাথে ফারুকী, শুটিংয়ের ফাঁকে

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে লিখতে বসলে সেটা শাহনামা হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। মেইনস্ট্রিম সিনেমা বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেটা ফারুকীর নির্মাণের বিষয়বস্তু নয়। তবুও তিনি নতুন কিছু করলেই সাড়া পড়ে যায় চারিদিকে। একদল মুগ্ধ হয়ে তার কাজ দেখে, অন্যদল ছুরি হাতে শাণ দেয় সমালোচনায় জর্জরিত করতে। 

ব্যক্তি ফারুকীকে আপনার ভালো না লাগতে পারে, তার চিন্তাভাবনার সঙ্গে আপনি একমত না'ই হতে পারেন, কিন্ত বাংলা সিনেমায় যে গুণগত পরিবর্তনটা এসেছে, গল্পনির্ভর সিনেমা হচ্ছে, মারদাঙ্গা অ্যাকশন বা দুষ্টুমিষ্টি প্রেম ফেলে রেখে জীবনধর্মী ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণে আমাদের পরিচালকদের আগ্রহী হবার পেছনে ফারুকীর অবদান অবশ্যই আছে, এই সত্যিটাকে অস্বীকার করা যাবে না কোনভাবেই। সিনেমার অশ্লীলতার সেই অন্ধকার যুগে তারেক মাসুদের মতো পরিচালকের ছায়াতলে থেকে অন্যরকমের সিনেমা বানানোর লড়াইটায় তাকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন ফারুকী, তারেক মাসুদ অবেলায় হারিয়ে যাবার পরেও তিনি টেনে নিয়ে গেছেন সেটাকে, এখনও যাচ্ছেন।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন, তার কাজকে অপছন্দ করতে পারেন, ফারুকীর প্রচারণার ধরণটা আপনার পছন্দ না হতে পারে- কিন্ত ফারুকীকে আপনি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না কখনও। স্বয়ং ইরফান খানের মতো মানুষ যার কাজ আগ্রহ নিয়ে দেখেন, তার সিনেমায় অভিনয় করার জন্যে বাংলা ভাষা শেখার চেষ্টা করেন- তিনি তো অবশ্যই ফেলনা কিছু নন। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো তুখোড় অভিনেতা যার পরিচালনায় কাজ করতে  একবাক্যে রাজী হয়ে যান, সেই মানুষটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় কি আছে?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা