সিনেমার নায়িকা হবে বলে মেয়েটা ঘর ছেড়েছিল, ভাগ্যের নির্মমতায় জায়গা হয়েছিল বেশ্যাপাড়ায়। সেই জীবনটাকেই বরণ করে নিয়েছিলেন গাঙ্গুবাঈ, হয়ে উঠেছিলেন হাজারো অসহায় নারীর কণ্ঠস্বর! গাঙ্গুবাই সিনেমার নায়িকা হতে পারেননি, কিন্ত হতভাগ্য সেই নারীর গল্প নিয়ে আজ সঞ্জয় লীলা বানসালী বানাচ্ছেন সিনেমা...

সিনেমা দেখার খুব শখ ছিল মেয়েটার। চল্লিশের দশকে রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজে মেয়েদের বাড়ির বাইরে পা দেয়াটাই যেখানে কঠিন ছিল, সেখানে এই মেয়েটা কিশোর বয়সে সাইকেলে চড়ে সপ্তায় সপ্তায় চার কিলোমিটার দূরের সিনেমা হলে গিয়ে নতুন নতুন সিনেমা দেখে আসতো। কখনও সঙ্গী হতো ছোট ভাই, কখনওবা বান্ধবী। রঙিন পর্দার নায়িকা হবার আশায় বাড়ি ছেড়ে বোম্বেতে পাড়ি জমিয়েছিল মেয়েটা, ভাগ্য তাকে বানিয়ে দিয়েছিল পতিতা! সিনেমার নায়িকা হওয়া হয়নি তার, অথচ এখন তার জীবনের গল্প নিয়েই তৈরী হচ্ছে সিনেমা- গাঙ্গুবাঈ কাটিয়াবাদি নামের এই মহিলার জীবনের গল্পটা তো আসলে সিনেমার চেয়েও রোমাঞ্চকর। সেই জীবনে স্বপ্ন আছে, কষ্ট আছে, দুঃখ আছে, আছে অহর্নিশ সংগ্রামের অনেকগুলো কঠিন অধ্যায়। 

জন্ম হয়েছিল বৃটিশ ভারতের গুজরাটের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে, সাল ১৯৩৯। বাবা নাম রেখেছিলেন গঙ্গা হরজীবনদাস কাটিয়াবাদি। স্কুলে যাওয়ার সময়টা থেকেই ফিল্মের পোকা হয়ে উঠলেন, মধুবালার প্রেমে পড়লেন পাগলের মতো। তাদের ব্যবসার হিসাব দেখাশোনার জন্যে দক্ষণ ভারতীয় এক যুবককে চাকরিতে রাখা হয়েছিল, নাম ছিল রামলাল। গুজরাটে আসার আগে রামলাল কিছুদিন বোম্বেতে কাটিয়েছিল, আলো ঝলমলে সেই শহর আর ফিল্মি দুনিয়ার গল্প খুব রসিয়ে রসিয়ে সে বলতো গঙ্গার কাছে। শুনে স্বপ্নাতুর চোখগুলো আরও বড় বড় হয়ে যেতো গঙ্গার। 

যা হবার তাই হলো, রামলালের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো গঙ্গা। কিন্ত কিশোরী মেয়েটা জানতো না, তাকে বাজেভাবে ব্যবহার করার চক্রান্ত করেছে রামলাল। সিনেমার নায়িকা হবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে রামলালের হাত ধরে ঘর ছাড়লো সে, পথে বিয়েটাও সেরে নিলো দুজনে, তারপর চলে এলো বোম্বেতে, যে শহরে আসার স্বপ্ন এতদিন ধরে দেখেছে গঙ্গা। একটা ছাপরা জায়গায় তাকে এনে তুললো রামলাল, পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বামীকে আর কোথাও খুঁজে পেলো না সে। মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লো, যখন জানলো এই জায়গাটা আসলে একটা পতিতাপল্লী, ৫০০ রূপির বিনিময়ে তাকে এখানে বিক্রি করে গেছে রামলাল! 

পরিণত বয়সে গাঙ্গুবাঈ

কামাতিপুরার রেড লাইট এরিয়াতে অন্যরকম একটা জীবন শুরু হলো গঙ্গার। পতিতালয়ের প্রধান যিনি ছিলেন, তার নাম ছিল শীলা মাসী, তিনি গঙ্গাকে বোঝালেন, এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তার। ভদ্রসমাজ তাকে আর গ্রহণ করবে না। গঙ্গা তবুও বার দুয়েক পালানোর চেষ্টা করলো, ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো আবার কামাতিপুরায়, নিজেকে সমর্পণ করলো শীলা মাসীর কাছে। শীলা  মাসী নিজের হাতে গঙ্গাকে সাজিয়ে দিলেন, চোখের জলে কাজলের রঙ ভেসে যাচ্ছিলো, বারবার মুছেও সামলানো যাচ্ছিলো না অশ্রুর বেয়াড়া ফোঁটাগুলোকে। গঙ্গা থেকে কিশোরী মেয়েটার নাম হয়ে গেল গাঙ্গুবাঈ। 

কামাতিপুরার কোঠিতে আসা সবগুলো মেয়ের গল্প প্রায় কাছাকাছি ছিল। কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে, কেউবা দারিদ্র‍্যের কষাঘাত সইতে না পেরে চলে এসেছে এই পথে। কোঠির সবচেয়ে শিক্ষিত, রুচিশীল আর সুন্দরী ছিল গাঙ্গুবাঈ, তাই খদ্দেরদের চাহিদার শীর্ষে থাকতো তার নামটা। এরইমধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেল একদিন, এক পাঠান গুণ্ডা তার মতের বিরুদ্ধেই ধর্ষণ করলো গাঙ্গুবাঈকে। কোঠির মেয়েদের সাথে এমন ঘটনা প্রায়ই হয়, ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সময়ে-অসময়ে শুতে হতো প্রভাবশালী গুণ্ডাদের সঙ্গে। কিন্ত গাঙ্গুবাঈ ছিল অন্য ধাতুতে গড়া, আহত শরীর নিয়ে সে ছুটে গেল সেই গুণ্ডার বসের কাছে, নাম তারা করিম লালা, বোম্বের মাফিয়া জগতে যে নামটা ভয় আর আতঙ্কের সঙ্গে উচ্চারণ করতো সবাই।

সব শুনে করিম লালা সবার সামনেই বেল্ট খুলে অমানুষের মতো পেটালো সেই গুণ্ডাকে। সবাইকে বলে দিলো, গঙ্গা আমার আপন বোনের মতো, ওর দিকে কেউ যাতে তাকানোর চেষ্টাও না করে। কোঠিতে ফিরে এলো গাঙ্গুবাঈ, কামাতিপুরার ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে গেল, করিম লালা আর গঙ্গার নয়া আত্মীয়তার খবর জানতে বাকী রইলো না কারো। এরপর থেকে গাঙ্গুবাঈকে সমীহের চোখে দেখা শুরু করলো সবাই। 

শীলা মাসী মারা যাওয়ার পরে কামাতিপুরার সর্দারনী হয়ে উঠলেন গাঙ্গুবাঈ, রেড লাইট এরিয়ার নিয়ম-কানুনও একটু একটু করে বদলাতে শুরু করলেন তিনি। জোর করে এখানে কাউকে আটকে রাখা হতো না, কেউ চলে যেতে চাইলে তাকে সসম্মানে যেতে দেয়া হতো। আত্মীয়স্বজন যদিবা বিক্রি করে দিয়ে যায়, তবু কোনো মেয়ে থাকতে না চাইলে তাকে নিজের দ্বায়িত্বে বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন গাঙ্গুবাঈ। গঙ্গা নিজে প্রতারণার শিকার হয়ে এখানে এসেছিলেন, পালাতে পারেননি, জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। তিনি চাননি তার মতো পরিণতি আর কারো হোক। 

গাঙ্গুবাঈ কাটিয়াবাদি সিনেমায় আলিয়া ভাটের লুক

এ পর্যন্ত গাঙ্গুবাঈয়ের জীবনে কোন টার্নিং পয়েন্ট ছিল না। কোঠির সর্দারনীদের জীবন তো এরকমই হয়, সবার গল্পগুলোতেই মোটামুটি মিল থাকে। তবে গাঙ্গুবাঈ নিজেকে আলাদা করে নিলেন একটা ঘটনা দিয়ে, হয়ে উঠলেন গণমানুষের নেতা, বিশেষ করে কোঠির নারীদের চোখে সাক্ষাৎ ভগবান হয়ে গেলে তিনি।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পরে 'সমাজ রক্ষা'র ধুয়া তুলে কোঠিগুলো বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়। তখন পথে নেমে আসে হাজার হাজার নারী, যারা শরীরকে সম্বল করে দুটো পয়সা আয় করেন। এই শরীরটা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। তারা অন্য কাজ হয়তো করতে পারবেন, কিন্ত কোঠির মেয়েদেরকে ভারতীয় সমাজ অন্য কোথাও মেনে নেবে না। কোঠি বন্ধ হয়ে গেলে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না তাদের! 

বোম্বে থেকে দিল্লি, সুদূর পশ্চিমবঙ্গ কিংবা চেন্নাই- সব জায়গায় শুরু হলো বিক্ষোভ, রাস্তায় নেমে এলো কোঠিতে কাজ করা মেয়েরা, সমাজ যাদের 'বেশ্যা' বলে গালি দেয়। কিন্ত বেশ্যা হলেও তো ওরা মানুষ, ওদেরও ক্ষিধে লাগে, অসুখ হয়- সেসবের সমাধান কী? এই নারীদের সামনে দেখা গেল একটা পরিচিত মুখকে- সেটা গাঙ্গুবাঈয়ের। ট্রেনে চড়ে তিনি বোম্বে-দিল্লি ঘুরে ঘুরে কোঠির মেয়েদের সংগঠিত করেছেন, ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এই নারীদের মধ্যে শিক্ষিত ছিলেন একমাত্র তিনিই, তাই আন্দোলনের পুরোটা সময় ঠান্ডা মাথায় প্রতিটা ঝামেলা সামলেছেন তিনি। 

জওহরলাল নেহেরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। পতিতাপল্লী থাকবে কি থাকবে না, এরকম অবস্থায় যখন সরকার ধীরে ধীরে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কথা ভাবছে, তখন কামাতিপুরার রেড লাইট এরিয়াতেই একটা সমাবেশে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন গাঙ্গুবাঈ। নেহেরুও চলে এলেন সেখানে, তারা কি বলতে চায় সেটা নিজের কানে শোনার জন্যে। নেহেরুর সামনেই অগ্নিগর্ভ এক ভাষণ রাখলেন গাঙ্গুবাঈ, প্রশ্ন তুললেন, সরকার যে কোঠি আর পতিতালয় বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে, এই মানুষগুলোর জন্যে বিকল্প আয়ের কোন ব্যবস্থা কি করা হয়েছে? আজ কোঠি বন্ধ হয়ে গেলে কাল দুপুরে তারা কি খাবে- সরকারের মাথায় কি সেটা আছে? 

জওহরলাল নেহেরু অবাক হলেন গাঙ্গুবাঈয়ের তেজোদীপ্ত ভাষণ শুনে। কোঠির সর্দারনীর মুখ থেকে এমন জ্বালাময়ী কথাবার্তা তিনি আশাই করেননি। সেদিনই তিনি গাঙ্গুবাঈকে কথা দিলেন, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে ভারত থেকে একটি কোঠিও বন্ধ করা হবে না। যাওয়ার আগে গাঙ্গুবাঈকে তিনি বলে গেলেন, 'আমি আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করি। কোঠি বন্ধ হবার পর নিশ্চয়ই অসাধারণ একজন জীবনসঙ্গী পাবেন আপনি।' গাঙ্গুবাঈ চটজলদি প্রশ্ন করলেন- 'আপনি করবেন আমাকে বিয়ে?' নেহেরু চুপ করে গেলেন প্রশ্ন শুনে। গাঙ্গুবাই এবার বললেন, 'বলাটা খুব সহজ স্যার, করাটা ভীষণ কঠিন। যে জীবনে আমরা আছি, এখানে আমাদের প্রতি শুধু দয়া দেখানো যায়, ভালোবাসা যায় না।' 

গাঙ্গুবাঈ মারা গেছেন চার দশকেরও বেশি পার হয়ে গেছে। ভারতের মানুষ গাঙ্গুবাঈকে ভুলেও গেছে হয়তো। বেশ্যাপাড়ার এক সর্দারনীকে মনে রেখে কীইবা হবে? তবে ভোলেননি সঞ্জয় লীলা বানশালি, তার নতুন সিনেমা 'গাঙ্গুবাঈ কাটিয়াবাদি' বানানো হবে গাঙ্গুবাইয়ের সংগ্রামী জীবনের গল্প নিয়েই। গাঙ্গুর চরিত্রে অভিনয় করবেন আলিয়া ভাট। নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে বোম্বেতে এসে যে মেয়েটার জীবন দুর্বিষহভাবে পাল্টে গিয়েছিল, সেই গাঙ্গুবাঈয়ের জীবন নিয়েই এখন সিনেমা বানানো হচ্ছে! আফসোস শুধু এটাই, গাঙ্গুবাঈ সেই সিনেমাটা কখনও দেখতে পাবেন না... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা