সেন্ট্রাল পার্ক, রঙিন টাই, লালচুলো গান্থার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

নাভিশ্বাস ওঠা সময় থেকে খানিকটা ফাঁকতালে যদি ডুব দিই 'ফ্রেন্ডস' এ, কাঁচের দরজার ওপাশে ক্যাশ-কাউন্টারের পেছনে ঠিকই খুঁজে পাবো গান্থার কে। যে অক্ষয়। সবাই হারালেও যে কখনও হারায় না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে অমরত্ব-প্রকোষ্ঠের ঠিক সম্মুখেই। হাসিমুখে। স্বস্তিতে...
কিছু কিছু টিভি শো আছে, শেষ করলেও অদ্ভুত এক রেশ রয়ে যায় ভেতরে। বিচিত্র সে রেশ। অনেকটুকু তৃপ্তি। অসাধারণ কিছু দেখে ফেলবার তৃপ্তি। সাথে গভীর আক্ষেপ। দারুণ কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আক্ষেপ। যাত্রাপথের সমাপ্তিবিন্দু দেখে ফেলার আক্ষেপ। যে আক্ষেপের স্বীকার হয়েছি 'ব্রেকিং ব্যাড' শেষে, 'রিপ্লাই ১৯৮৮' শেষে। 'ফ্রেন্ডস' শেষে। ব্যাপ্তির দিক থেকে 'ফ্রেন্ডস'ই সবচেয়ে বড় কলেবরের। সে কারণেই হয়তো 'ফ্রেন্ডস' শেষ হলেও র্যাচেল, মনিকা, ফিবি, জোয়ি, চ্যান্ডলার, রস ফুরিয়ে যায়নি কখনোই। যেমন ফুরোয়নি মনিকার অ্যাপার্টমেন্টের বেগুনি দরজা। কিংবা 'সেন্ট্রাল পার্ক' কফিশপের অতিকায় কমলা সোফা। অলস গুলতানি। ঢাউস কফির কাপ। শশব্যস্ত গান্থারের কীর্তিকলাপ।
বেঁচে থাকার এক বড়সড় অভিশাপ, প্রিয় মানুষদের ক্রমশ 'অদৃশ্য' হতে দেখার অভিশাপ। মানুষ নানাভাবে প্রিয় হয়। 'প্রিয় মানুষ' এর সে তালিকাও বড় রহস্যময়। জটিল। তবুও সেই রহস্যমাখা জটিল তালিকাতে বহু মানুষের পাশাপাশি ছিলো 'গান্থার' এর নামও। সেই গান্থার এর প্রয়াণের সংবাদ যখন পেলাম, খানিকটা বিষাদগ্রস্ত যে হইনি, তা বলবো না মোটেও। যদিও 'ফ্রেন্ডস' এর যাত্রাপথের নটেগাছ মুড়িয়েছে, তাও বহুদিন। আবেগের উত্তুঙ্গ ঢেউ এতদিনে স্তিমিত হবার কথা। কিন্তু তা হয়নি। কোথাও গিয়ে একটা তাজা অদৃশ্য টান যেন রয়েই গিয়েছে।
হু হু করে সময় পাল্টেছে। 'ফ্রেন্ডস' এর সেই ছয় মানুষের চেহারা বদলেছে। টানটান চামড়া কুঁচকেছে। জীবন-সূর্য ক্রমশই বেলাশেষের ঘরে ঢলে পড়বার ফন্দি এঁটেছে। 'ফ্রেন্ডসঃ রিইউনিয়ন', এ প্রিয় মুখদের এভাবে বয়স্ক হতে দেখে খানিকটা স্থানু হয়ে গিয়েছিলাম৷ ভুলেই গিয়েছিলাম, 'বয়স' নামক আততায়ী কাউকে ছাড়ে না। আক্রমণ করে সবাইকেই।
তবে সেই রিইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি চমকে উঠেছিলাম গান্থার'কে দেখে। চোখেমুখে জীবনযুদ্ধের তুমুল ধ্বস্তাধস্তির সুস্পষ্ট চিত্র। যে ধ্বস্তাধস্তি তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ ক'বছর ধরে। ভেতরে ভেতরে লড়ছেন বিশাল বড় এক দানবের সাথে। যে দানবের নাম- ক্যান্সার। ঢাকঢোল না পিটিয়ে একান্ত নিভৃতেই করে যাচ্ছেন প্রতিরোধ। ন্যুব্জ হচ্ছেন। মুখে বলিরেখা খড়িমাটি হয়ে আঁচড় বোলাচ্ছে। যদিও আমরা তখনও ভেবে নিচ্ছি, নিউ ইয়র্কের কোনো ব্যস্ত রাস্তার পাশে এক চিলতে 'সেন্ট্রাল পার্ক' এ ঠিকই রঙিন জামা এবং টাই এ সজ্জিত হয়ে লালচুলো গান্থার তদারকি করছে এসপ্রেসো ও লাটের। উপরে কঠিন, ভেতরে নরম যে মানুষটির হৃদয়ের পুরোটা এখনও দখল করে আছে র্যাচেল গ্রিন নামের এক স্বর্ণকেশী তরুণী।

'ফ্রেন্ডস' এর যারা মুখ্য কুশীলব, সে তালিকায় গান্থার নেই। তার স্ক্রিনটাইমও যে খুব বেশি, তেমনটিও জোরগলায় বলা যাবে না। নির্মাতারা তাকে অভিনয়ে নেয়ার পরেও খুব যে ভরসা করেছেন, সেটিও না। অজ্ঞাতকুলশীল 'গান্থার' এর হাতে একটিই অস্ত্র ছিলো। অভিনয়। সেই অভিনয়ের চমৎকারিত্ব এবং দুর্দান্ত টাইমিং এর পাঞ্চলাইন দিয়ে অল্প সময়েই মানুষের ব্যক্তিগত অন্দরমহলে প্রবেশ করেছেন পর্দার 'গান্থার' কিংবা বাস্তবের জেমস মাইকেল টাইলার নামের মানুষটি।
পর্দায় 'কমিক রিলিফ' হয়ে হাসানোর কাজটি বেশ দক্ষতার সাথে করলেও পর্দার পেছনের জীবনটি খুব যে সুখকর ছিলো তার, তা বলা যাবে না। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই হারিয়েছেন বাবা-মা দুইজনকে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট গান্থার এরপর কায়ক্লেশে পড়াশোনা শেষ করেছেন। গ্রাজুয়েশনের পরে 'অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিল্ম এডিটর' এবং 'প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট' হিসেবে চাকরী করেছেন। পর্দার পেছনে শুরু করলেও ক্রমশ তিনি এসেছেন পর্দার সামনে। মনে রাখা কিংবা না রাখার মতন একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে করে আচমকাই একদিন পেয়েছেন 'গান্থার' চরিত্রে কাজ করার সুযোগ।

মজার ব্যাপার, টাইলার কে যখন 'সেন্ট্রাল পার্ক' এর 'ম্যানেজার গান্থার' চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, তখন টাইলার আসলেই লস এঞ্জেলস এর একটি কফিশপে কাজ করছিলেন। তাকে 'গান্থার' চরিত্রে মনোনীত করার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো, সে কফি মেশিন চালাতে পারতো। শুটিং শুরুর পরে নির্মাতারা প্রথম প্রথম তাকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতেই থাকতো। ঠিক সে কারণেই তার প্রথম তেত্রিশটি শটে তাকে কোনো ডায়লগ দেয়া হয় না। এরপর একসময় এসে 'গান্থার' ডায়লগ পেয়েছেন। এবং ডায়লগ পেয়ে তিনি বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছেন, কেন তিনি গড়পড়তা আর পাঁচটা চরিত্রের ছায়া নন। কমিকে 'পাঞ্চলাইন' এর টাইমিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটিই খুব দক্ষভাবে বরাবর করেছেন টাইলার। যার বরাতেই প্রোটাগনিস্ট না হয়েও তিনি পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। 'গান্থার' চরিত্রকে পৌঁছে দিয়েছেন বহু মানুষের কাছে।
'ফ্রেন্ডস' শেষ হওয়ার পরেও বিভিন্ন সিনেমা-সিরিজে অভিনয় করছিলেন টাইলার। প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরেও স্বাভাবিক কাজকর্ম বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 'ইফ ইউ নিউ' নামে একটা আয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন, প্রোস্টেট ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যে৷ সবাইকে জানাচ্ছিলেন কেন ক্যান্সার নিয়ে সাবধান থাকা প্রয়োজন। শারীরিক সুস্থতা নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াচ্ছিলেন। এরইমাঝে ঝুপ করে সন্ধ্যা। পাততাড়ি গুটিয়ে ফেরার আয়োজন শুরু।
'ফ্রেন্ডসঃ রিইউনিয়ন' এ এসে গান্থার বলছিলেন- ফ্রেন্ডস চলাকালীন এই দশ বছর সময়টা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তবে আমরা যারা 'ফ্রেন্ডস' দেখেছি আমাদের কাছে 'গান্থার' এর প্রতিটা দৃশ্যই আজীবন ধরে বারবার দেখার মতন। চিরকাল মনে রাখার, মন ভালো করার মতন। যদিও গান্থারের অন্তিম প্রয়াণে স্বজন হারানো চিনচিনে ব্যথা আছেই। তবুও সান্ত্বনা হয়তো এটাই, আমাদের সেই প্রবল পরিচিত গান্থার হারায়নি। নাভিশ্বাস ওঠা সময় থেকে খানিকটা ফাকতালে যদি ডুব দিই 'ফ্রেন্ডস' এ, কাঁচের দরজার ওপাশে ক্যাশ-কাউন্টারের পেছনে ঠিকই খুঁজে পাবো গান্থার কে। যে অক্ষয়। সবাই হারালেও যে কখনও হারায় না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে অমরত্ব-প্রকোষ্ঠের ঠিক সম্মুখেই। হাসিমুখে। স্বস্তিতে...