'গেহরাইয়া'র সিনেম্যাটোগ্রাফি ও কিছু মুগ্ধতা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'গেহরাইয়া'র নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা যেমন হচ্ছে, সমালোচনাও চলছে দেদারসে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এটাই, সেসব আলোচনা-সমালোচনার বড় এক অংশ জুড়ে শুধুই সিনেমার অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলোর একপেশে সংজ্ঞায়ন। অথচ, এই সিনেমার ক্যামেরার কাজে যেভাবে আলাদা করে ভাবা হয়েছে সবকিছু, হিউম্যান ইমোশনের সাথে কালার টোন, ফ্রেম কিংবা লেন্সকে ব্লেন্ড করার চেষ্টা করা হয়েছে, মেটাফোরিক্যালি সাটলভাবে অনেক এলিমেন্টস আনা হয়েছে গল্পের সাইডকিক হিসেবে, সেসব নিয়ে ভেবেছে কয়জন?
'গেহরাইয়া' যারা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, তারা হয়তো অনেকেই সিনেমার 'টোনাল চেঞ্জ' এর বিষয়টি খেয়াল করেছেন। সিনেমার নানা অংশে যেভাবে 'কালার টোন' পাল্টেছে ক্রমশ, সে বিষয়টাকে অনেকে হয়তো সিনেমার চলমান গল্পের সাথেও নানাভাবে কানেক্ট করে ফেলেছিলেন। এবং সে কানেকশনের বিষয়টা যে মোটেও ভ্রান্ত না, সেটাও যেন প্রমাণিত হয়েছে 'গেহরাইয়া' এর সিনেম্যাটোগ্রাফার কৌশল শাহ এর এক লেখায়। যেখানে তিনি নিজেই অকপটে স্বীকার করেছেন- গল্পের বিন্যাস অনুযায়ী তিনি ও নির্মাতা শকুন বাত্রা পাল্টেছেন কালার টোন, ফ্রেম, ক্যামেরা মুভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিনেম্যাটোগ্রাফার কৌশল শাহ, দুই বিখ্যাত ফিল্মমেকার আসগার ফারহাদি ও নুরে বিলজে সেইলান এর বেশ বড়সড় ভক্ত। এবং সে কারণেই 'গেহরাইয়া'য় তিনি এই দুই নির্মাতার বেশ কিছু সিনেমার বিশেষ অংশ নিয়ে করেছেন ক্রসওভারও। এই সিনেমার গল্প এগোনোর সাথে সাথে যেমন ফ্রেম, কালার, ক্যামেরার টেনশন পাল্টেছে, সে সাথে যুক্ত হয়েছে পরিচালকদের নিয়ে হোমাজও। কৌশল শাহ এবং শকুন বাত্রার উদ্দেশ্য ছিলো- এই সিনেমার দৃশ্যগুলো তারা দেখবেন না, উপলব্ধি করবেন। সেটা কিভাবে? ভেঙ্গে বলছি।
প্রথমত, সিনেমা যখন শুরু হয়- তখন কালার টোন ঝকঝকে উজ্বল। যেন রোদ-ঝলমলে এক দিনের আভাসই সিনেমাজুড়ে। শুরুর এই সময়টাতে, ফ্রেমিং কিংবা ক্যামেরার টেনশনে নতুন কিছু নেই। চরিত্রগুলোর পরিচয় খোলাসা হচ্ছে ধীরে ধীরে। ক্যামেরাও তাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। প্রাথমিক এই 'আইস ব্রেকিং' দৃশ্যাবলীর জন্যে রেফারেন্স হিসেবে নেয়া হয় মিনি ওয়েব সিরিজ 'নরমাল পিপল'কে। বিচ হাউজে পার্টি করতে যাওয়া টিয়া, আলিশা, জেইন এবং করন এর মধ্যবর্তী রসায়ন স্টাবলিশ করার ক্ষেত্রে খানিকটা অনুপ্রেরণাই যেন নেয়া হয় 'নরমাল পিপল' এর কিছু বিশেষ শটের গ্রামার থেকে। তাছাড়া, সিনেমার প্রাথমিক এই অংশ থেকেই আলিশা ও জেইনের মধ্যে আলাদা এক মিথস্ক্রিয়া তৈরীর কাজটিও হয় দুর্দান্ত। ক্যামেরা সাদামাটা থাকে। জোর দেয়া হয় জমাটি সম্পর্কের রূপান্তরে।

সিনেমার দ্বিতীয় অংশ বেশ ইন্টারেস্টিং। আলিশা এবং জেইন দুইজনেই দূর্বল হয়ে পড়েছে দুজনের উপরে। আবার, তারা এটাও জানে, এই সম্পর্ক গড়পড়তা সম্পর্কের চেয়ে ভিন্ন, অনেক বেশি টানাপোড়েনের। তারা তাই সম্পর্কে জড়াবে কি না, এ নিয়ে তাদের চিন্তাজনিত জটিলতাও বেড়ে যায় অনেকটুকু। এবং এই থটপ্রসেস'কে ধরার জন্যেই ক্যামেরার দুলুনি খানিকটা অন্যরকম হয়। ৭৫ মিলিমিটার লেন্সে খানিকটা টপ অ্যাঙ্গেল থেকে নেয়া শটে যেন সিনেম্যাটোগ্রাফার এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন- প্রোটাগনিস্টদের কমপ্লেক্সিটি বুঝতে পারছে দর্শকেরাও। পাশাপাশি, চরিত্রদের যে দোনোমোনো ভাব, সেটাও লেন্স ও হাইট ম্যানেজমেন্টে স্টাবলিশ করবেন সিনেম্যাটোগ্রাফার, এটাও ছিলো উদ্দেশ্য। এবং সে উদ্দেশ্যে তারা বেশ সফলও হন। বহু ভাবনাচিন্তার পরে যখন দুই চরিত্র সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সম্পর্কে জড়াবে তারা, ক্যামেরার লেন্স অনেকটাই দৃঢ় হতে থাকে তখন, এবং সিনেমার কালার টোনও হয় ক্রমশ 'ওয়ার্মিশ।' যেন সম্পর্কের উষ্ণতাকেই নির্দেশ করে নির্মাণের এই কারিগরি দিক।
এরপরের অংশে, যেখানে অতীতের যন্ত্রণা ভুলে দুইজনের সম্পর্ক ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে, যখন ভবিষ্যৎ নিয়েও খানিকটা অনিশ্চয়তা তৈরী হচ্ছে ভেতরে ভেতরে, এই সময়ে এসে সিনেমার কালার টোন খানিকটা ধূসর হয়ে যায়। বিভ্রান্তি বোঝাতেই। সাদা-কালো তো ঠিক অথবা ভুল। কিন্তু 'ধূসর' রঙেরই যেন কোনো পক্ষ নেই। এবং এ কারণেই, বিশেষ এ রঙকে করা হয় উপজীব্য। পাশাপাশি, আলো, লেন্স এবং ফ্রেমের ত্রৈধ সম্মিলনে একাকীত্ব, অনিশ্চয়তা, দূর্বলতা...এগুলোকে আনার চেষ্টাও যেন করেন সিনেম্যাটোগ্রাফার। চরিত্রকে লেন্সের গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে ব্রাত্য করা, লাইটের প্লেসমেন্টে কমপ্লেক্সিটি আনা...সিনেমার স্রোতের সাথে সঙ্গত দেয়া হয় এখানেও।
পরবর্তী অংশে, আলিশা ও জেইন যেন আরো কাছাকাছি দুজনের। সম্পর্কের প্রগাঢ়তা বোঝাতে সিনেমার এই অংশে এমন কোনো ফ্রেম নেই, যেখানে এই দুজনকে পাওয়া যায় না। ফলাফল- ক্যামেরার কিংবা ফ্রেমিং এর কোর ফোকাসে বরাবরই এই দুজন মানুষ৷ সিনেমার কালার টোনও তখন অনেক বেশি সফট, রোমান্টিক। সিনেমার দুটি গানও ব্যবহার করা হয় এ অংশে। এবং সে সাথে দেখানো হয় দুই প্রোটাগনিস্টের অন্তরঙ্গতাও। যে অন্তরঙ্গতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। জলঘোলা বিতর্ক।।
নির্মাণ ক্রমশ এগোয়। প্রণয়-জনিত উষ্ণতার পরে আসে ছন্দপতন। উথাল-পাতাল প্রেমের পরে কিছু সংকট। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, শঠতা, প্রবঞ্চনা... নানাকিছু। এ সবকিছুর ফলশ্রুতিতে সেই মাখামাখি সম্পর্কও হতে থাকে শীতল। এবং সেই শীতলতা খুব দারুণভাবেই ফুটে ওঠে কালার টোনে। 'ওয়ার্ম' থেকে ক্রমশই 'কোল্ড' হতে থাকে কালার টোন। এই অংশে এসে কিছু টেক্সচার শটও নেয়া হয়। দীপিকার অস্থিরতা, হাত-পা'র মুভমেন্ট, শ্যাডো রিফ্লেকশন, ক্যামেরার লেন্সের আন-ইউজুয়াল অ্যাঙ্গেল... নানাকিছু দিয়ে যেন সম্পর্কের এই অস্থিরতাকেই প্রকট করা হয় পর্দায়।
এসব ছাড়াও জেইনের 'অফিস' এর নানারকম শটের মাধ্যমে পাওয়ার-হাঙ্গার কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের খানিকটা গ্লিম্পস, সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে আলিশার ভালনেরাবিলিটির সাটল কানেকশন, 'উজাক', 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন আনাতোলিয়া' বা 'ইউফোরিয়া'র মাধ্যমে ডিরেক্টরিয়াল হোমাজ... সবকিছুই চলে পাশাপাশি। এভাবেই যেতে যেতে একসময়ে সমাপ্ত হয় যাত্রাপথ।

'গেহরাইয়া' নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বহু কথা বলা যায়। এবং কথা বলা হচ্ছেও। এই সিনেমার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা যেমন হচ্ছে, সমালোচনাও চলছে দেদারসে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এটাই, সেসব আলোচনা-সমালোচনার বড় এক অংশ জুড়ে শুধুই সিনেমার অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলোর একপেশে সংজ্ঞায়ন। অথচ, এই সিনেমার ক্যামেরার কাজে যেভাবে আলাদা করে ভাবা হয়েছে সবকিছু, হিউম্যান ইমোশনের সাথে কালার টোন, ফ্রেম কিংবা লেন্সকে ব্লেন্ড করার চেষ্টা করা হয়েছে, মেটাফোরিক্যালি সাটলভাবে অনেক এলিমেন্টস আনা হয়েছে গল্পের সাইডকিক হিসেবে, সেসব নিয়ে ভেবেছে কয়জন? 'গেহরাইয়া' নিয়ে আলোচনা হতে গেলে, এই বিষয়গুলো থাকা উচিত দরকার ছিলো সর্বাগ্রে। এবং আক্ষেপের বিষয় এটাই- সিনেমার সবচেয়ে অভিনব প্রসঙ্গটিই হয়েছে সবচেয়ে তীব্রভাবে উপেক্ষিত। যেটা অবিচার। 'গেহরাইয়া'র কারিগরি টিমের পরিশ্রমের অবমূল্যায়ন। এবং এই অবমূল্যায়ন খুবই অপ্রত্যাশিত। অনাকাঙ্ক্ষিত।
তথ্যসূত্র ও ছবি কৃতজ্ঞতা- ফিল্ম কম্প্যানিয়ন