অসহায়ের দুঃখে হাহাকার বাড়ানোর দায় নিয়ে আসেনি গুল্লাক, আসেনি বিত্তবানের বৈভব দেখিয়ে কাউকে ঈর্ষান্বিত করতেও। সে এসেছে মাটির ভাঁড়ে জমিয়ে রাখা কিছু গল্প নিয়ে। পাশাপাশি, এও বলতে- জীবনে 'সুখী' হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেই কিছুই। আর সুখের জন্যে বহুদূরে যাওয়ারও নেই আবশ্যকতা। নোনাধরা ঘরে প্রিয় মানুষের স্পর্শে যে স্বস্তি, তা যে আর কারো সাথেই তুলনীয় না, 'গুল্লাক' ক্রমাগত দিয়েছে সে বার্তাও...

'গেম অব থ্রোন্স' এর শেষ সিজনের শেষ পর্বে টিরিয়ন ল্যানিস্টার বলেছিলেন-

What unites people?
Armies? 
Gold? 
Flags?
No. It’s stories. There's nothing in the world more powerful than a good story. 

গল্প ভালো হলে এবং গল্পের চরিত্রেরা জ্যান্ত হলে সে গল্পাশ্রয়ী নির্মাণ যে অপার্থিব আবহ দেয়, তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত- গুল্লাক। মধ্যবিত্ত জীবনের ডাল-চাল-চিনির অনশন, পেট কাটা টিউবের পেস্ট কিংবা গজগজ করা চায়ের পাতিলের এরকম আড়ম্বরহীন গল্প এরচে স্পষ্টভাবে উঠে আসতে দেখিনি আর কোনো নির্মাণেই। সামনেও কখনো আসবে কী না, নিশ্চিত নই। আজকাল যদিও মুহুর্তের ব্যবধানে খরস্রোতা নদীর পলির মত আশেপাশে জমা হয় নানাবিধ নির্মাণ৷ ক্ষণেক্ষণে চমক, বুদ্ধির কারসাজি, মগজে জিলিপির প্যাঁচ, প্রযুক্তির চকমকি পাথর... আসে তো সবই৷ কিন্তু মনে থাকে ক'জন? 'হাওয়াই মিঠাই' এর মতন একবার মুখে নিলেই উবে যায় যাদের আকর্ষণ, সেসব নির্মাণের ভীড়ে বহুদিনের পাথেয় হয় কয়টা কাজ? মস্তিষ্কেও বা জমা হয় ক'টি? এবং এখানে এসেই পার্থক্য গড়ে 'গুল্লাক।' এ নির্মাণের গল্প এমনই এক গোত্রের মানুষের প্রতিনিধি, যে গোত্রের মানুষ জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত লাইনকে ধারণ করে বুকে, যে লাইনের বক্তব্য- 'একটু আলতোভাবে বাঁচতে চাই।' অমরত্বের প্রত্যাশা কিংবা সর্বগ্রাসী দাবিদাওয়া না, পাত পেড়ে ডাল-ভাত আর সুখে-অসুখে মিলেমিশে থাকার যে নিষ্পাপ স্বপ্ন মধ্যবিত্তের, 'গুল্লাক' সেটিই বলে হাসি-কান্নার মিশেলে। যে মিশেলে মন ভরে, মন ভারও হয় বিস্তর। 

'গুল্লাক' এর তৃতীয় সিজন নিয়ে বেশ প্রত্যাশা ছিলো। ছিলো চাপা আনন্দও। প্রত্যাশা অনেক নির্মাণ নিয়েই থাকে। কিন্তু, 'চাপা আনন্দ' সবার জন্যে থাকে না। 'গুল্লাক' এর 'মিশ্রা পরিবার' আবার আসবে, তাদের যাপিত জীবনের চুম্বকাংশের সাথে সামিল হওয়ার সৌভাগ্য হবে, মূলত সেটাই ছিলো চাপা আনন্দের উৎস। এবং সে কারণেই, খানিকটা পূর্বপ্রস্তুতিরও দরকার হলো। তৃতীয় সিজন শুরু করার আগে অবধারিতভাবেই চোখ বোলাতে হলো দ্বিতীয় সিজনের শেষ পর্বের সে দৃশ্যে, যে দৃশ্যে চোখ আর্দ্র হয়না, এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন। আপাত ব্যর্থ বড়ছেলের কাঁধে বাবার ভরসার হাত আর ছেলের কান্না ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা... খানিকটা কি নিজের বাবার বহুবার বলা 'কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে' ভরসাকেই মনে করায় না! দৃশ্যটা যতবারই দেখি, যে অনুভূতিতে আক্রান্ত হই, সেটা হলো এবারও। ব্যতিক্রম মোটেও নেই। 

আবেগতাড়িত হওয়ার সেই বিশেষ দৃশ্য! 

এই যে 'আপাত ব্যর্থ বড়ছেলে' আনু মিশ্রা, বিগত দুই সিজন ধরে যে 'অকালকুষ্মাণ্ড' হয়েই বসে আছে, তৃতীয় সিজনের শুরুতেই তার চাকরিপ্রাপ্তির খবরে সন্তোষ-শান্তির মত স্বস্তি পাই আমরাও। ভাবতে বসি- যাক! এবার তাহলে 'মিশ্রা পরিবার' এর দুর্দশা কমবে। পায়েসে দুধ বাড়বে, মাংসভাতের আয়োজন বাড়বে, ঘরের সংস্কার করে 'বিট্টুর মা' এর সাথে একহাত নেয়াও হবে। কিন্তু বিধিবাম! হুমায়ূন আহমেদ স্যার যেমন বলেছিলেন- 'সাধারণ মানুষের সাথে মিরাকল হয় না', তেমনি বলা যায়- সাধারণ মানুষ নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিও পায়না। যেমনটা পায়না মিশ্রা পরিবারও। ছোট ছেলের মোটা অঙ্কের অ্যাডমিশন ফি, ঘরের টুকরো টাকরা সমস্যা... সব মিলিয়ে মিশিয়ে দিনশেষে ট্যাঁকের অভ্যন্তর আবারও গড়ের মাঠ। এরইমধ্যে গোদের উপর বিষফোড়া! সন্তোষ মিশ্রাকে অন্যায়ভাবে 'সাসপেন্ড' করা হয় চাকরী থেকে। সদ্য সদ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানো আনু মিশ্রার উপরে এসে পড়ে পুরো পরিবারের যাপিত নির্ভরতা। গল্প ক্রমশ এগোয়। এগোয় মিশ্রা পরিবারের সংকটজর্জর অভিজ্ঞতাও।

যদিও 'গুল্লাক' এর এবারের কিস্তি কিছুক্ষেত্রে খানিকটা ওভার-ড্রামাটিক এবং ফিল্মি আবহই দেবে, তবুও তা মূল গল্প সাপেক্ষে নেহায়েতই কম। মূল গল্পকে তা কখনো ছাপিয়েও যায় না। পাশাপাশি, কোনো একটা ভালো ওয়েব সিরিজ নিয়মিত আসতে থাকলে 'এবার কেঁচেগণ্ডূষ করবে না তো?' নামের যে ভয়টা অবধারিতভাবে সঙ্গী হয় দর্শকের, সেই ভয়ের জায়গাকেও হেলায় ধূলিসাৎ করে 'গুল্লাক।' প্রত্যাশার চাপ সামলে গল্প ও কুশীলবদের যে দ্যোতনা, তা মাটির কাছ থেকেও সরে যায় না মোটেও। এবং সে কারণেই মাটির ঘ্রাণমাখা সারল্যই হয়ে থাকে 'গুল্লাক' এর সবচেয়ে বড় স্বকীয়তা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'কোটা ফ্যাক্টরি'র প্রথম সিজন জনপ্রিয় হওয়ার পরে, দ্বিতীয় সিজনে এসে খানিকটা খেই হারিয়ে ফেলে বিশেষ এ নির্মাণ। সেদিক বিবেচনায় 'গুল্লাক' তৃতীয় কিস্তিতে এসেও অক্ষয় ধ্রুবক। যেটা বিস্তর স্বস্তির! 

সাধারণত, এরকম 'স্লাইস অব লাইফ' কন্টেন্ট এর ক্ষেত্রে গল্পের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চরিত্রেরা। এবং এই নির্মাণের এ জায়গাতে মুগ্ধতা বরাবরই স্থির। 'সন্তোষ মিশ্রা' চরিত্রে জামিল খানের যে অভিনয়, সে অভিনয়ে সিংহভাগ দর্শক খুঁজে পায় নিজের বাবাকেই। 'মধ্যবিত্ত বাবা' হয়ে সততার সাথে সন্ধি, হাসি-ঠাট্টা-খুনসুটি আর যাপিত সংকটে ঘরের বাতিঘর...বিচিত্র পরিস্থিতিতে খুব দুর্দান্তভাবেই তিনি উপস্থিত থাকেন বরাবর। ছেলের চাকরির বেতন থেকে টাকা চাওয়ার দ্বিধা, স্ত্রী'র মুরগি রান্নার প্রস্তাবে অভিমান গলে জল... জামিল খানের অভিনয়ে কেন যেন 'অভিনয়'টাই পাওয়া যায় না। মনে হয়, পুরোটাই নিজের মধ্যবিত্ত-জীবনের 'অতীত স্মৃতি'র টুকরো মঞ্চায়ন! একই কথা 'গীতাঞ্জলি কুলকার্নি'র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যিনি 'শান্তি মিশ্রা' চরিত্রে বলতে গেলে মধ্যবিত্ত পরিবারের সব মায়েদের সংকটকেই এক লহমায় নিয়ে আসেন সামনে। সন্তানদের উপর নির্ভরশীলতা, স্বামীর সাথে খিটিমিটি, দায়িত্বের রিলে রেসে নিজের সাথেই আপোষ, সংকটে পাণ্ডুবর্ণ ধারণ...  সবকিছুতেই খুব দারুণভাবে মিশে যান গীতাঞ্জলি কুলকার্নি। আটপৌরে শাড়িতে 'মধ্যবিত্ত সংসার'নৌকার নাবিক হওয়ার যে লড়াই, সে লড়াই 'শান্তি মিশ্রা' চরিত্রে খুব সাবলীলভাবেই প্রকট করেন গীতাঞ্জলি। 

সুখে-দুখে মিশ্রা পরিবার! 

দুই ভাই- আনু এবং আমানের ব্যক্তিগত সংকট, পারস্পরিক খুনসুটি কিংবা পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও যেন খুব আটপৌরে। ছিমছাম৷ এবং যত দিন গড়াচ্ছে, 'আনু' ওরফে 'আনন্দ মিশ্রা' চরিত্রে বৈভব রাজ গুপ্ত'র অভিনয়ও যেন ততটাই হচ্ছে খোলতাই। এই কঠোর এই নরম, বাবার অপমানে লালচোখ আর বাবার অসুখে ভেজাচোখের যে রূপান্তর... তা খুব দারুণভাবেই স্পষ্ট বৈভবের অভিনয়ে। পাশাপাশি, 'আমান মিশ্রা' চরিত্রে হর্ষ মায়ারের নিপাট সরলতা এবং 'কমিক রিলিফ' দেয়ার যে যাপিত দায়... সেখানেও ঘাটতির অবকাশ নেই মোটেও। এদের পাশাপাশি বিট্টুর মা, বিট্টু, লাকি, পিয়ুশ ভাই... সবাই দারুণ। খুঁত ধরার উপায় তো নেই-ই, বরং, প্রতিটি চরিত্রই নিজেদের মাত্রাজ্ঞান বুঝে এতটাই মাপা, স্রেফ মুগ্ধতাই একমাত্র অবলম্বন! 

আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের যাবতীয় 'যদি-কিন্তু' আক্ষেপের মধ্যে থেকেও খুঁজে নিয়েছি মোটামুটি সুখ, গুড়ের মোয়ার মত জড়াজড়ি করে থেকেছি সুখে-দুঃখে-বিষাদে, তাদের কাছে 'গুল্লাক' যেন অতীত-গুহায় ঢোকার এক জ্বলন্ত মশাল। ক্রমশ জটিল ও কুটিল হয়ে ওঠা এ সময়ের নির্মাণগুলো যেখানে ক্রমশই দগদগে ক্ষত বাড়ায়, সেখানে 'গুল্লাক' চোখ রাখতে বলে পেছনের সে রাস্তায়, যে পথে আমাদের হাঁটা হবেনা আর কোনোদিন৷ এই যে নষ্টালজিয়া, এই যে আক্ষেপ, এসবে পোড়ানোই হয়তো তাই 'গুল্লাক' এর আপ্ত দায়িত্ব। অসহায়ের দুঃখে হাহাকার বাড়ানোর দায় নিয়ে আসেনি এ নির্মাণ, আসেনি বিত্তবানের বৈভব দেখিয়ে কাউকে ঈর্ষান্বিত করতেও। সে এসেছে মাটির ভাঁড়ে জমিয়ে রাখা কিছু গল্প নিয়ে। পাশাপাশি, এও বলতে- জীবনে 'সুখী' হওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেই কিছুই। আর সুখের জন্যে বহুদূরে যাওয়ারও নেই আবশ্যকতা। নোনাধরা ঘরে প্রিয় মানুষের স্পর্শে যে স্বস্তি, তা যে আর কারো সাথেই তুলনীয় না, 'গুল্লাক' ক্রমাগত দিয়েছে সে বার্তাও। 

যাপিত বিড়ম্বনার প্রিয় চারমুখ! 

কলকাতার বিখ্যাত লেখক ও তার্কিক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বলেন- 

আজকাল এত এত নির্মাণ চারপাশে, এসবের চক্করে পড়ে মানুষ আজকাল কোনো নির্মাণ দেখা শেষে ভাবতেও ভুলে গিয়েছে৷ মানুষ আজকাল ভাবেনা। কিচ্ছু ভাবেনা। শুধুই দেখে যায়। 

কথাটা সর্বৈব সত্যি। তবে ব্যতিক্রমও আছে। যে ব্যতিক্রমই 'গুল্লাক।' বলা হয়ে থাকে- It is simple to be Happy. But, it is difficult to be simple. 'অসাধারণ' হওয়ার এই র‍্যাট-রেসে খানিকটা সাধারণ হওয়ার যে গল্প বলে 'গুল্লাক', 'সে গল্পেই নিহিত এ নির্মাণের অভিনবত্ব। 'গুল্লাক' তাই এমনই এক আখ্যান, যে আখ্যানে বাবা-মা-সন্তানের উষ্ণ আলিঙ্গনে ক্রমশ গভীর হওয়া সম্পর্ককে ছোঁয়ার আস্পর্ধা দেখায় না সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক জটিলতা। গভীর থেকে গভীরতর হওয়া যে সম্পর্ক আমাদের আরাধ্য, সে সম্পর্কই মূর্ত হয় 'মিশ্রা পরিবার' এর বরাতে। সেজন্যেই তাই প্রতিবার হৃদয় ভারী হয়। ভারী হয় নানাবিধ সুখস্মৃতিতে। পাশাপাশি এও ইচ্ছে হয়, এরকম নির্মাণ আসুক বারবার। 'মিশ্রা পরিবার' এর পলেস্তারা-খসা ঘুলঘুলিতে আমরাও চোখ রাখি, চোখ রাখি অতীতে। ধুলোমলিন সময় ফিরে দেখার যে সাধ, সেটার জন্যে হলেও তাই 'গুল্লাক' এর আসা উচিত। আসা উচিত বারবার।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা