বলা হয়ে থাকে, হিথ লিজার ‘জোকার’ চরিত্রটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, সেটা আর কারো পক্ষেই করা সম্ভব না কখনো। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্যে তিনি মরণোত্তর অস্কারও পেয়েছিলেন। অথচ, বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই- হিথ লিজারকে যখন ক্রিস্টোফার নোলান 'দ্য ডার্ক নাইট' এর ‘জোকার’ চরিত্রের জন্যে নির্বাচিত করেছিলেন, তখন তীব্র আপত্তিই করেছিলো ব্যাটম্যান ভক্তরা...

প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে যেসব ক্ষতি আমাদের হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম- আমাদের অসহিষ্ণুতার ক্রমবর্ধমান অবয়ব৷ এমন না, এই সমস্যা আগে ছিলোনা। ছিলো। কিন্তু তা এতটা সর্বগ্রাসী ছিলোনা। এবং সেই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ এতটা কদাকারও ছিলো না। অন্তর্জালের অবাধ প্রসারে যেভাবে আমাদের হেটস্পিচ কিংবা ইনটলারেন্স ছড়ায়, বিষয়টা আগে এতটাও ভয়ঙ্কর ছিলোনা। ঘৃণাবাক্যের সাত-সতেরো আগে নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলেও, যত সময় গড়াচ্ছে, তা যেন মহামারীর মত ছুঁয়ে যাচ্ছে যাপিত সব ক্ষেত্রকেই।

সিনেমা দিয়েই উদাহরণ দিই। সঞ্জয় লীলা বানসালির ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’ মুক্তি পাবে। লিড রোলে আলিয়া ভাট। শুরু হয়ে গেলো সমালোচনা। নেটিজেনরা যেভাবে আলিয়ার অভিনয় না দেখেই বিষেদগার করলেন, তাতে বিস্মিতই হলাম। অথচ, সিনেমাটা মুক্তির পর বেশ প্রকটভাবেই দৃশ্যমান হলো- আলিয়া ভাট কী অসাধারণ অভিনয়ই না করেছেন! বেশ কিছুদিন আগে ‘বব বিশ্বাস’ নামের সিনেমা মুক্তি পেলো। সে সিনেমায় অভিষেক বচ্চন বেশ ভালোই করলেন। কিন্তু তাও নেটিজেনের বেশ বড়সড় অংশই মুখর রইলো- কেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়'কে এ রোলে নেয়া হলোনা? রীতিমতো ঘৃণার বিষবাষ্পে অভিষেক বচ্চনকে উড়িয়ে দেয়ারই চেষ্টা করা হলো একপ্রকার। 

অবশ্য শুধু বলিউডই বা বলছি কেন, ওয়ার্ল্ড সিনেমায়ও এরকম উদাহরণ অজস্র, যেখানে শুধুমাত্র কাস্টিং শুনেই অভিনেতাদের উপর চড়াও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু সিনেমা মুক্তির পর তাদের অনেকের মুখেই আর রা কাটেনি। এরকম কিছু অভিনেতা, যারা বিশেষ কিছু চরিত্রে দোর্দণ্ডপ্রতাপময় অভিনয় করে ঘৃণাকে রূপান্তরিত করেছিলেন ভালোবাসায়, তাদের নিয়েই কথাবার্তা আজ।

১.  রবার্ট প্যাটিনসন (ব্যাটম্যান)

সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত দিয়েই শুরু করি। ম্যাট রিভসের ‘ব্যাটম্যান’ এ রবার্ট প্যাটিনসন নাম ভূমিকায় অভিনয় করবেন, এ খবর নেটদুনিয়ায় আসার সাথে সাথেই হামলে পড়লো অনেকে। নোলানের ‘ব্যাটম্যান ট্রিলোজি’র পর এক শ্রেণির দর্শক ধরেই নিয়েছেন, ক্রিশ্চিয়ান বেলের চেয়ে ভালো ব্যাটম্যান হওয়া সম্ভব না কারো পক্ষেই। এবং ঠিক সে কারণেই, অভিনয় না দেখেই, শুধুমাত্র ঘোষণা শুনেই শুরু হলো ঘৃণার চাষাবাদ। যদিও রবার্ট প্যাটিনসন, ‘ব্যাটম্যান’ এ অনবদ্য অভিনয় করে নিন্দুকদের মুখ দারুণভাবেই বন্ধ করে দিয়েছেন।

রবার্ট প্যাটিনসন

২. বেন অ্যাফ্লেক (ব্যাটম্যান)

‘ব্যাটম্যান’ চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিলো বেন অ্যাফ্লেককেও। জ্যাক স্নাইডার যখন ‘ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান’ এর জন্যে বেন অ্যাফ্লেককে কাস্ট করলেন, দাবানল জ্বলে উঠলো ঠিক তখনই। সমস্যা একটাই- ক্রিশ্চিয়ান বেলের বাইরে কাউকে ‘ব্যাটম্যান’ ভাবতে পারছিলো না জনগণ।  যদিও বেন অ্যাফ্লেক ‘ব্যাটম্যান’ চরিত্রে করেছিলেন দুর্দান্ত অভিনয়। সমালোচকদের করেছিলেন স্তব্ধ।

বেন অ্যাফ্লেক

৩. ম্যাট ডেমন (জেসন বর্ন)

‘জেসন বর্ন’ চরিত্রে ম্যাট ডেমন ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে গেলে মস্তিষ্কের উপর খানিকটা যেন চাপই পড়ে যায়। সেই ম্যাট ডেমনকেই ‘জেসন বর্ন’ চরিত্রে যুক্ত করার পরে শুরু হয়েছিলো শোরগোল। এরকম নিরীহ চেহারার ছেলে কিভাবে অ্যাকশন ফিল্মে অভিনয় করবে, বা, অভিনয় করলেও কতটুকু খোলতাই হবে তা, সেসব নিয়েই জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছিলো বিস্তর। যদিও অভিনয় দিয়েই যাপিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ম্যাট ডেমন।

ম্যাট ডেমন 

৪. অ্যানি হ্যাথাওয়ে (ক্যাটওম্যান)

‘দ্য প্রিন্সেস ডায়ারিজ’ এর সেই লাস্যময়ী তরুণী ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ এর ‘ক্যাটওম্যান’ এর মত এরকম ধূসর, জটিল চরিত্রে অভিনয় করবেন, তা নিয়ে হয়তো সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। কিন্তু সবার সন্দেহকে বেশ দারুণভাবেই নিকেশ করেছেন অ্যানি হ্যাথাওয়ে। করেছেন অনবদ্য অভিনয়ও। 

অ্যানি হ্যাথাওয়ে

৫.  হেনরি ক্যাভিল (সুপারম্যান)

যে হেনরি ক্যাভিলকে আমরা ‘সুপারম্যান’ হিসেবে দেখে অভ্যস্ত, সে হেনরি ক্যাভিলকেই ‘সুপারম্যান’ চরিত্রে যাতে সুযোগ দেয়া না হয়, তা নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি মোটেও। ক্যাভিলের অপরাধ একটাই- সে ব্রিটিশ। আর আমেরিকানরা তাদের দেশের সুপারহিরো হিসেবে একজন ব্রিটিশ অভিনেতাকে কেনই বা দেখতে চাইবে? ফলাফল- হেটস্পিচ, বিদ্বেষ, বিড়ম্বনা। যদিও শেষমেশ হেনরি ক্যাভিলই হয়েছেন ‘সুপারম্যান।‘ এবং এই চরিত্রকে বানিয়েছেন নিজের একচেটিয়া সম্পত্তি। 

হেনরি ক্যাভিল 

৬. টম ক্রুজ (জ্যাক রিচার)

‘জ্যাক রিচার’ চরিত্রে টম ক্রুজ যখন অভিনয় করতে এলেন, তখন প্রথম বিপত্তিই এলো ‘জ্যাক রিচার’ বইয়ের পাঠকদের কাছ থেকে। তাদের অভিযোগ একটাই- বইয়ে জ্যাক রিচারের উচ্চতা ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চি। আর টম ক্রুজের উচ্চতা- পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। উচ্চতার গ্যাঁড়াকলে শুরু হলো বিতর্কও। যদিও টম ক্রুজের দুর্দান্ত অভিনয়ের সুবাদে সিনেমাটি মুক্তির পরে তুমুল ব্যবসা করে। এবং দিনশেষে দর্শকদের মুখেও ফোটে হাসি। 

টম ক্রুজ

৭. জেনিফার লরেন্স (কাটনিস এভারডিন)

‘হাঙ্গার গেমস’ বই অনুযায়ী কাটনিস একজন বাদামী চুলো, জলপাই-বর্ণা তরুণী। কিন্তু এই চরিত্রে অভিনয় করতে আসা জেনিফার লরেন্স ছিলেন লাল-চুলো নীলাভ চোখের তরুণী। দর্শকেরা প্রথমেই তাই জেনিফার লরেন্সকে বিশেষ এ চরিত্রে দেখে বেশ সরব আপত্তিই করেন। যদিও সে আপত্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না। দুর্দান্ত অভিনয়ের সুবাদে জেনিফার লরেন্স খুব অল্পসময়েই জনপ্রিয় করে ফেলেন চরিত্রটিকে।

জেনিফার লরেন্স

৮. হিথ লিজার (জোকার)

বলা হয়ে থাকে, হিথ লিজার ‘জোকার’ চরিত্রটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, সেটা আর কারো পক্ষেই করা সম্ভব না কখনো। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্যে তিনি মরণোত্তর অস্কারও পেয়েছিলেন। অথচ, বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই- হিথ লিজারকে যখন ক্রিস্টোফার নোলান 'দ্য ডার্ক নাইট' এর ‘জোকার’ চরিত্রের জন্যে নির্বাচিত করেছিলেন, তখন তীব্র আপত্তিই করেছিলো মানুষজন। সুদর্শন এক যুবক, যে কিনা রোমান্টিক কমেডি সিনেমায় অভিনয় করে ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়, সে কিভাবে গোথামে ত্রাসের রাজত্ব সঞ্চার করবে, সে কিভাবে ব্যাটম্যানের সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবেন... তা নিয়েও ছিলো অনেকের সংশয়। যদিও এরপরের বাকিটা নিয়ে সবাই অবগত। ‘জোকার’রূপী হিথ লিজারের অতিমানবীয় অভিনয় সম্পর্কে সবারই সবকিছু জানা। সেসব নিয়ে তাই শব্দব্যয় অপচয়। 

হিথ লিজার 

৯. ড্যানিয়েল ক্রেইগ (জেমস বন্ড)

যে ড্যানিয়েল ক্রেইগ সময়ের ফেরে হয়ে গিয়েছেন জেমস বন্ডেরই সমার্থক শব্দ, যে ড্যানিয়েল ক্রেইগকে সবাই ‘বেস্ট জেমস বন্ড’ হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় এখন, সে ড্যানিয়েল ক্রেইগই যখন প্রথম ‘জেমস বন্ড’ চরিত্রে অভিনয় করতে এসেছিলেন, মানুষজন পছন্দ করেনি তাকে। তার চুলের রঙ, তার দেহাবয়ব নিয়েও হয়েছিলো বিতর্ক। যদিও অভিনয় দিয়েই সব বিতর্ককে ক্রমশ থামিয়েছিলেন তিনি। 

ড্যানিয়েল ক্রেইগ

সুতরাং প্রমাণিত এটাই, মলাট দেখে বই বিশ্লেষণ করা যেমন কোনো কাজের কথা না, তেমনি পুরোপুরি না বোঝার আগে উচিত না কোনো কিছু নিয়ে মন্তব্য করাও। যদিও জনতা-জনার্দন এসব নীতিকথাকে নেবেন কি না, সে একান্তই তাদের ইচ্ছে। তবে বিষয়টা নিয়ে ভাববার খোরাক আছে বিস্তর। সেজন্যেই এত কথা বলা। এত শব্দব্যয়। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা