'হাওয়া'র টিকেট ছাড়ার পরে মানুষের চাপে স্টার সিনেপ্লেক্স এর সার্ভার ক্রাশ করেছে। অনেকগুলো সিনেমাহলে 'প্রি-বুকিং' চলাকালীন শেষ হয়ে গিয়েছে 'হাওয়া'র টিকেট, মানুষজন হন্যে হয়ে টিকেট খুঁজছে, এদিকে, 'হাওয়া' টিম একের পর এক ইউনিভার্সিটি'তে প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন করছে, সে ক্যাম্পেইনে 'সাদা সাদা কালা কালা' কিংবা 'এ হাওয়া' গানে পাগলের মত কন্ঠ মেলাচ্ছে মানুষ... এক বাংলা সিনেমা নিয়ে এরকম মাতামাতি হবে, তা কি কখনো ভেবেছিলো কেউ?
আমার কথাটা একটু রুড শোনাতে পারে। কিন্তু, তাও বলছি। আমার যে ক্যারিয়ার, চাইলে আমি অজস্র সিনেমায় অভিনয় করতে পারতাম। তাতে আমার পকেটে টাকাও আসতো অনেক। কিন্তু, আমি সিনেমা করেছি ৫-৭টি। কেন জানেন? কারণ, আমি এমন সিনেমায় অভিনয় করতে চাইনি, যে সিনেমা আমায় তৃপ্তি দেবেনা।
যিনি এই কথাগুলো বললেন, সে মানুষটির নাম- চঞ্চল চৌধুরী। তিনি এমন একজন, যিনি কোনো একটি কন্টেন্টে থাকলেই, আমরা, সাধারণ দর্শকেরা নড়েচড়ে বসি। আমরা খানিকটা আলাদা নজরেই সে কন্টেন্ট দেখতে বাধ্য হই। কারণ, আমরাও জানি, আর সবাই হতাশ করলেও, উনি হতাশ করবেন না৷ অভিনয়টা উনি যে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে করেন, যে গভীর বোধের জায়গা থেকে করেন, সেখান থেকে অভিনয় এলে দর্শকের হতাশ হবার কারণও থাকেনা কোনো।
সেই চঞ্চল চৌধুরীই এই টকশো'র এক পর্যায়ে বলেন-
'হাওয়া' যে বাংলাদেশি সিনেমার হাওয়া ঘুরিয়ে দেবে না, সেটা কেউ বলতে পারবে? এমনও তো হতে পারে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের যে অবস্থান, তা হয়তো এই এক 'হাওয়া'র কারণেই ঘুরে গেলো!
চঞ্চল চৌধুরীর এ কথাগুলো অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে, খানিকটা বাড়াবাড়িও মনে হতে পারে। তবে, এও তো ঠিক, কথাগুলো তিনি যদি নাও বলতেন, তবুও এই এক সিনেমাকে নিয়ে যা হচ্ছে চারপাশে, সেসব দেখেশুনে, এ ধারণাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না মোটেও। একটা উদাহরণ দিই- স্টার সিনেপ্লেক্স এর ৬০টা শো এর ৪৭টাই দখল করেছে বাংলা সিনেমা। এরমধ্যে 'হাওয়া' ২৭টি, 'পরাণ' ১৬টি, 'দিন দ্য ডে' ৪টি। যে সিনেপ্লেক্সে বরাবরই ইংরেজি সিনেমা সর্বেসর্বা, সেখানে এখন বাংলা সিনেমার রাজত্ব... প্যারাডাইম শিফট'টা বুঝতে পারছেন? 'হাওয়া'র টিকেট ছাড়ার পরে মানুষের চাপে স্টার সিনেপ্লেক্স এর সার্ভার ক্রাশ করেছে। কয়েক সিনেমাহলে 'প্রি-বুকিং' চলাকালীন শেষ হয়ে গিয়েছে 'হাওয়া'র টিকেট, মানুষজন হন্যে হয়ে টিকেট খুঁজছে, এদিকে, 'হাওয়া' টিম একের পর এক ইউনিভার্সিটি'তে প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন করছে, সে ক্যাম্পেইনে 'সাদা সাদা কালা কালা' কিংবা 'এ হাওয়া' গানে পাগলের মত কন্ঠ মেলাচ্ছে মানুষ, রিক্সা-আর্টে 'হাওয়া'র পোস্টার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে 'হাওয়া'র স্টিল ইমেজ, বিলবোর্ড, হোর্ডিং, টিশার্ট, নোটবুক, ব্যাজ... সবখানে 'হাওয়া'র এই যে প্রবল আধিপত্য, শেষ কবে কোন সিনেমার আগে এমনটা দেখেছি, মনে পড়ে না। বা, আদৌ কি দেখেছি কখনো? কোনো সিনেমা নিয়ে এরকম মাতামাতি কি আগে নজরে এসেছে? নিশ্চিত নই।
নিঃসন্দেহে 'বাংলা সিনেমা' এখন স্মরণকালের সেরা সময়টা পার করছে। এবং, 'ড্রাইভিং সিট' এ অবশ্যই 'হাওয়া।' তবে, এখানে একটু সতর্কতাও আছে। সে সতর্কতাটুকু আমাদের জন্যে। মেজবাউর রহমান সুমন, নির্মাতা হিসেবে গুণী আমরা জানি। তিনি যেসব নাটক, বিজ্ঞাপন, ওটিটি কন্টেন্ট বানিয়েছেন, সেসব নিয়ে কথা নিয়মিতই হয়। কিন্তু, তাও মনে রাখতে হবে, তিনি অতিমানব না। বড়পর্দায় এটা তার প্রথম কাজ। অভিষেক নির্মাণ। হয়তো, আবারও বলছি হয়তো, এমন হতেই পারে, গান-প্রমোশন কিংবা ওয়ার্ড অব মাউথ এ যে হাইপ উঠেছে, সিনেমাটা ততটা ভালো হলোনা। হতেই পারে। এবং, ঠিক সে সময়েই আমাদের ম্যাচুরিটি দেখানোর পালা। সেসময়ে আমরা যেন খড়গহস্ত না হই। আমরা যেন একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখি বিষয়টা। বেশ কিছুদিন ধরে সিনেমাহলে আধিপত্য ধরে রাখা 'পরাণ' শতভাগ নির্ভুল সিনেমা না, বা, এর আগে মুক্তি পাওয়া 'শাণ'ও টেকনিক্যালি সেন্ট পার্সেন্ট সাউন্ড ছিলোনা। তবু, মানুষ অকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছে। এ সমর্থনটুকু যেন 'হাওয়া'ও পায়। সেটাই প্রত্যাশা।
একটা ভিন্ন বিষয় মনে পড়ছে। ক'দিন আগেই চঞ্চল অভিনীত 'পাপ-পূণ্য' সিনেমাটা মুক্তি পেলো প্রেক্ষাগৃহে। হলে গিয়েই দেখেছিলাম সিনেমাটা। অবাক হয়েছিলাম, বেশ ভালো কনসেপ্টের একটা সিনেমা হওয়া সত্বেও এ সিনেমা ভালো ব্যবসা করতে পারেনি। কারণ, প্রমোশনের অভাব। এ আক্ষেপের কথা চঞ্চল চৌধুরী অনেক টকশো'তে এসে বলেওছিলেন। তবে, তিনিও বোধহয় আশা করেননি, এত তাড়াতাড়িই তার আক্ষেপের সে খেদ মিটবে। কারণ, 'হাওয়া'র প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন যে লেভেলে পৌঁছেছে, যে বেঞ্চমার্ক তৈরী করেছে, তা চক্ষু ছানাবড়া করার মতন। আর, এই প্রমোশনের 'মধ্যমণি' হিসেবে বিষয়টা যে তার জন্যেও সন্তুষ্টির, সেটাও বলাই বাহুল্য।
চঞ্চল চৌধুরীর 'মনপুরা' সিনেমার একটা গান আছে-
নিথুয়া পাথারে
নেমেছি বন্ধুরে
ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই!"
মজার ব্যাপার হচ্ছে, চঞ্চল চৌধুরী নিথুয়া পাথারে আবার নেমেছেন, তবে 'সোনাই' হয়ে নয়। 'চান মাঝি' হয়ে। একাও নন। উরকেস, পারকেস, এজা, নাগু সহ অনেককেই নিয়েছেন সাথে। এই পাথারে বেঁচে থাকা আছে। মরে ভূত হওয়া আছে। 'আমি বাঁচতি চাই' বলে মাঝ দরিয়ায় লাফ দেয়াও আছে। এর মাঝখানে আছে মেজবাউর রহমান সুমনের ডিরেকশন আর কামরুল হাসান খসরুর সিনেম্যাটোগ্রাফী... একটা সিনেমার এতসব আয়োজন দেখে, 'হাওয়া'র ট্রেলারের শেষে চঞ্চল চৌধুরীর 'ভয় পাচ্ছিস' এর প্রত্যুত্তরে কেন যেন তাই বলতেই ইচ্ছে করে-
ভয় না, সাহস পাচ্ছি। অদ্ভুত কিছু দেখার সাহস। বাংলা সিনেমা নিয়ে গর্ব করার সাহস।'
বাকিটা সময়ই বলবে। 'হাওয়া'র হাওয়া কোন দিকে যায়, সেটা জানা যাবে আর কয়েক ঘন্টা পরেই। রইলো শুভকামনা। রইলো ভালো কিছুর চাওয়া-পাওয়াও।