মধুবালা: অপূর্ণতায় পূর্ণ এক ভালোবাসার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

দুধে আলতা রঙ, মুক্ত ঝরা হাসি। এমন কোনো পুরুষ নেই সে সময় তার প্রেমে পড়েনি। কিন্তু মধুবালা? কাকে ভালোবেসেছিলেন এই মানুষটা? কী এমন হয়েছিল তার, যা মুঘল-এ-আজম এর আনারকলির পরিণতিকেও হার মানিয়ে দেয়?
অপরূপ সুন্দরী মেয়েটিকে যে দেখতো, সে-ই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। দুধে আলতা রঙ, মুক্ত ঝরা হাসি। হ্যাঁ, মধুবালার কথাই বলছি। তাঁর সৌন্দর্যের দ্যুতিতে নাকি চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। শোনা যায়, তিনিই হিন্দি সিনেমার প্রথম নায়িকা যাকে এক ঝলক দেখার জন্য স্টুডিওর গেটে ভক্তরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এমন কোনো পুরুষ নেই যে সেই সময় তার প্রেমে পড়েনি। কিন্তু মধুবালা? তিনি কাকে ভালোবেসেছিলেন? কেমন ছিল তার প্রেমের জীবন? আসুন, আজ সেই মহাজনপ্রিয় নায়িকা ও সেই সময়ের ছেলেদের স্বপ্নের নারীর সত্যিকার জীবনের ভালোবাসার গল্প শুনি।
যে গল্প ফিল্মের গল্পের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না, যে গল্পের পরিণতি মুঘল -এ -আজম এর আনারকলির পরিণতিকেও হার মানিয়ে দেয়। তার পুরো নাম মুমতাজ জেহান বেগম দেহলভী। দারিদ্রতার কঠিন সংগ্রামের মধ্যে ছোটবেলা কেটেছে। ১৯৩৩ সালের ভালবাসা দিবসে মানে ১৪ই ফেব্রুয়ারী তার জন্ম। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান থেকে বাবা সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে আসেন। কাজের জন্য বোম্বের ফিল্ম স্টুডিওগুলোর দরজায় দরজায় ঘোরা আরম্ভ করেন। মাঝে মাঝে তার মেয়েরাও সাথে থাকতো।
এদের মধ্যে এক মেয়ে ছবিতে কাজের সুযোগ পেয়ে যায়। বেবি মুমতাজ নামে নয় বছর বয়সে শিশু শিল্পী হিসেবে সে প্রথম ক্যামেরার সামনে আসে এবং সবার নজর কাড়ে। এরপর অনেকগুলো ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করে মেয়েটি। ছোটবেলা থেকেই পরিবারকে আর্থিকভাবে সাপোর্ট করার গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া মুমতাজ স্কুলে যেতে পারেনি, কিন্তু সে লিখতে পড়তে জানত। উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। মাত্র বারো বছর বয়সে সে ড্রাইভিং শিখে। খুব ভাল গাড়ি চালাতে পারত, দারুণ শখ ও ছিল তার গাড়ি চালানোর।
পাঠান হওয়ার কারণে তেরো চৌদ্দ বছর বয়সেই প্রাপ্তবয়স্ক এক তরুণীর মতো দেখতে লাগতো মুমতাজকে । লম্বা-চওড়া, রূপ লাবণ্যে ভরপুর একটি মেয়ে। আর শিশু শিল্পী নয়, পূর্ণাঙ্গ নায়িকার রোলের জন্যই মনোনীত হয়ে যায় সে। সেই সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী দেবিকা রানী মুমতাজের নতুন নাম দেন মধুবালা।

চৌদ্দ বছর বয়সের মধুবালার নায়িকা হিসেবে প্রথম ছবি নীল কমল (১৯৪৭) মুক্তি পায়। তবে সবচেয়ে বেশি সাফল্য পান ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মহল ছবিটি করে। সুপার ডুপার হিট এই ছবিটিতে ষোলো বছরের মধুবালা সবার হৃদয়ে ভালোবাসার পাকাপোক্ত জায়গা করে নেন। এরপর একের পর এক হিট ছবি।
মধুবালার জনপ্রিয়তা এতটাই আলোচ্য বিষয় ছিল যে তা হিন্দি সিনেমার গন্ডি পেরিয়ে হলিউড পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। ১৯৫২ সালে আমেরিকান ম্যাগাজিন থিয়েটার আর্টস এ মধুবালার বিপুল জনপ্রিয়তা সম্পর্কে একটি বিরাট আর্টিকেল ছাপা হয়, যার টাইটেল ছিল 'The Biggest Star in the World – and she's not in Beverly Hills', যেখানে শুধু ইন্ডিয়া নয়, ইন্টারন্যাশনাল সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রেও যে মধুবালার যথেষ্ট পোটেনশিয়াল আছে সে সম্পর্কে লেখা হয়েছিল।
একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত চিত্র পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপরা মধুবালাকে নিয়ে একটি হলিউড মুভি বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু মধুবালার বাবা সেই অফার ফিরিয়ে দেন। ভীষণ কড়া ও ডমিনেটিং ছিলেন ভদ্রলোক। আর মধুবালা ছিলেন অসম্ভব রকমের বাধ্য সন্তান। তার সমস্ত কিছু তার বাবার আদেশে পরিচালিত হত। মধুবালার কোনো রকম পাবলিক এপেয়ারেন্স দেয়ার অনুমতি ছিলো না, তাকে কোনো ফিল্ম পার্টি বা প্রিমিয়ার এটেন্ড করতে দেয়া হতো না, ছিলো না কোনো বন্ধু বা মনের কথা বলার সাথী। এগুলো সব তার বাবা নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করতেন।
খাঁচার ভেতর বন্দি পাখি যেমন ডানা ঝাপটিয়ে মুক্তির আকুলতা প্রকাশ করে, ঠিক তেমনি হিন্দি সিনেমার এই রাজকন্যাও নিজের এই ছকে বাধা নিরস প্রাণহীন জীবনে এক ঝলক আলোক রশ্মির জন্য ছটফট করতেন। ভালোবাসা খুঁজতেন। চাইতেন একান্ত নিজের করে কাউকে পেতে যে তার এই বিষাদের জীবনে একটুখানি সুখ বয়ে আনবে।
অল্প বয়সে এক হিন্দু সহশিল্পীর প্রতি ভালোলাগা তৈরী হয়েছিল কিন্তু বাবার শাসন ও রক্ষণশীল মনোভাবের জন্য নিজের মনের জানালা বন্ধ করে দেন গোড়াতেই।এ যেন এক রোবটিক জীবন! শুধু চুপচাপ মুখ বুজে কাজ করে যাওয়া পরিবারের মানুষদের জন্য, আর কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আসা। নিজের জীবন, হাসি আনন্দ, চাওয়া পাওয়া, স্বাধীনতা কোনোকিছুরই যেন সেখানে কোনো স্থান নেই।
এরকম এক সময়ে তার জীবনে আসেন সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক দিলীপ কুমার। তিনিও মধুবালার মতোই পেশাওয়ারের থেকে আসা মুসলিম পাঠান। আসল নাম ইউসুফ খান। টগবগে তরুণ, সুদর্শন ও সুঅভিনেতা। আদব কায়দা, রীতি নীতি, মন মননশীলতা, ধর্ম, বয়স, পদমর্যাদা সবই নিখুঁতভাবে মিলে যায় তাদের। দুজন দুজনকে এতটা যথাযথ ভাবে কমপ্লিমেন্ট করার মতো প্রেমিকযুগল হিন্দি ছবির জগতে এরপর বহুদিন আসেনি আর।

১৯৫১ সালের ছবি 'তারানা' তে কাজ করতে গিয়ে একে অপরের প্রেমে পড়েন তারা। ভালোবাসার কথা মধুবালাই আগে জানিয়েছিলেন। নিজের হেয়ার ড্রেসারকে দিয়ে উর্দুতে একটি চিঠি লিখে পাঠান তিনি, সাথে একটি গোলাপ ফুল....চিঠির শেষে লেখা ছিল যদি দিলীপ কুমার মধুবালাকে ভালোবাসেন তাহলে যেন গোলাপ ফুলটি গ্রহণ করেন। মনে মনে দিলীপ কুমার যেন এটাই চাইছিলেন। ফুল আর ভালোবাসা কোনটি গ্রহণ করতেই আর দেরি হয়না তার। শুরু হয় একটি স্বর্ণালী প্রেমের অধ্যায়। দিলীপ কুমারের ভালোবাসা মধুবালার সমস্ত না পাওয়াকে পরম প্রাপ্তিতে পরিণত করে।
দিলীপ কুমার ভীষণ ডেডিকেটেড প্রেমিক ছিলেন। যত দূরেই তার কাজের শিডিউল পড়ুক, আর তিনি যেখানেই থাকেন, কাজ শেষে মধুবালার কাছে ছুটে আসতেন। মধুবালার জীবনেও কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন দিলীপ... তার কারণে জীবনে প্ৰথমবারের মতো মধুবালাকে কোনো এক সিনেমার পার্টিতেও দেখা গিয়েছিলো। হাতে হাত রেখে সেখানে তারা এন্ট্রি নেন। সেই সময়ে এই ব্যাপারটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।
ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুঠানগুলোও মধুবালা সাথে উদযাপন করা যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছিল তার জন্য। প্রাথমিকভাবে অমত করলেও দিলীপ কুমারের ভদ্র ব্যবহার, সামাজিক স্ট্যাটাস ও মেয়ের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে পরে অতোটা তীব্র বিরোধিতা করে উঠতে পারেননি মধুবালার বাবা। এরপর আর কী বাকি থাকে? এতো পারফেক্ট ম্যাচ, দুজন দুজনাকে পাগলের মতো ভালবাসা, জুটি হিসেবে দর্শকের ভালবাসা ও আশীর্বাদ সবই তো রয়েছে। এখন শুধু বিয়ের অপেক্ষা। সেটা হয়ে গেলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যায়, আর বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি পেয়ে যায় নজরকাড়া সুন্দর ও সফল একটি রীল ও রিয়েল জুটিকে।
কিন্তু ভাগ্যে যে অন্য কিছু লেখা ছিল... এতো সুখ মধুবালার কপালে সইলে তো? আকস্মিকভাবে একদিন 'বহুত দিন হুয়ে' (১৯৫৪) নামের একটি ফিল্মের সেটে রক্তবমি করে ভাসিয়ে দেন মধুবালা। হতভম্ভ হয়ে যায় সবাই। কী হয়েছে তার? জল্পনা কল্পনা শুরু হয় তাকে নিয়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তিনি কিছুটা সেরে উঠেন। মধুবালা শক্ত মেয়ে, নিজের অসুস্থতা আর মানুষের কথা কোনটিই পাত্তা না দিয়ে ছবিটির কাজ শেষ করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পরপর কয়েকটি ছবির চিত্রায়নের সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। এরপর আর দেরি চলে না, ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এবার সব দেখেশুনে পরীক্ষা করে ডক্টর জানান মধুবালার হার্টে বিশাল ছিদ্র আছে এবং তার যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্রাম দরকার। যে মেয়েটি ছোটবেলা থেকে এতো হেলদি, তার এতো বড় একটি অসুখ এটা মেনে নেয়া যেন সবার জন্য দুঃসাধ্য ছিল। ডাক্তার জানান জন্ম থেকেই তার হার্টে এই হোলটা আছে, যেটা এই চব্বিশ বছর বয়সে এসে ধরা পড়লো। আর সবার মতো মধুবালাও যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ব্যাপারটা। তিনি মনে প্রাণে চাইছিলেন নিজের অসুখ ইগনোর করতে।
অসুস্থতার সময় তার ভালোবাসার মানুষটি তার কাছেই ছিলেন। ইনফ্যাক্ট তারা তখন দুটি ছবিতে একসাথে কাজও করছিলেন। একটি হলো তাদের জুটির সবচেয়ে বিখ্যাত ও ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম ব্যবসাসফল, অল টাইম ক্ল্যাসিক 'মুঘল এ আজম' এবং আরেকটি 'নয়া দওর'। বাড়িতে বসে বিশ্রাম করার চেয়ে প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য হয়তো তার কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল, মধুবালা হয়তো ভেবেছিলেন কাজ নিয়ে ভুলে থাকলে অসুখ তাকে কাবু করবে না, তিনি ভাল হয়ে যাবেন। ইতিবাচক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার এই সময়ে আবারো বিনা মেঘে বজ্রপাত! মধুবালাকে মুখোমুখি হতে হয় আরেক হৃদয় বিদারক ঘটনার।
নয়া দওর নামের সিনেমাটির অল্প কিছু দৃশ্যর ইনডোর শ্যুটিং সম্পন্ন হওয়ার পর সিনেমাটির নির্মাতা আউটডোর শুটিংয়ের জন্য গোওলিওর নামের একটি স্থান নির্বাচন করেন। শুটিংয়ের শিডিউল অনুযায়ী অনেকগুলো দিন সেখানে গিয়ে মধুবালাকে থাকতে হবে এরকম একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই ব্যাপারটি নিয়ে মধুবালার বাবা এবং ছবিটির নির্মাতার মধ্যে বিরাট ঝামেলার সৃষ্টি হয়। আতাউল্লাহ খান (মধুবালার বাবা) মেয়েকে আউটডোরে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানান। ছবির কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী মধুবালা নির্মাতার মনোনীত জায়গায় গিয়ে কাজ করতে বাধ্য কারণ তিনি চুক্তিপত্রে সই করেছেন। অথচ বাবার আদেশ অমান্য করার কথাও মধুবালা ভাবতে পারেন না।
তখন নির্মাতার অনুরোধে দিলীপ কুমার নিজে এসে কথা বলেন আতাউল্লাহ খানের সাথে, তবুও তাকে রাজি করানো সম্ভব হয় না। তার এক কথা, লোকেশন পরিবর্তন করতে হবে, নির্মাতার ঠিক করা লোকেশন তার পছন্দ নয়। দিলীপ কুমার ঠান্ডা মাথার লোক কিন্তু ভীষণ ইগো, তার অনুরোধ এভাবে নাকচ করাতে আত্মসম্মানে লাগলো তার। এটা ছাড়াও দিলীপ ও মধুবালার প্রেম এবং আসন্ন বিয়েকে পুঁজি করে মধুবালার বাবার কিছু ব্যবসায়িক ইচ্ছে নিয়ে কিছুদিন ধরেই দিলীপ কুমার ও মধুবালার বাবার মধ্যে মতান্তর হয়ে আসছিলো। দুটো ঘটনা মিলিয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
ওদিকে নয়া দৌড় সিনেমার নির্মাতা চুক্তিভঙ্গের ও তাকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করার অপরাধে মধুবালা ও তার বাবার বিরুদ্ধে কেস ফাইল করেন। কেসটি পুরো এক বছর ধরে চলে। দৃঢ়চিত্ত দিলীপ কুমারের সাক্ষ্য যখন চাওয়া হয় তখন তিনি সত্যকে বেছে নেন এবং ছবিটির নির্মাতার পক্ষে নিজের মতামত প্রদান করেন। মধুবালার বাবা কেস হেরে যান এবং মেয়েকে তিনি দিলীপ কুমারের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেয়ার আদেশ দেন। এই একটি কেস মধুবালার পুরো জীবনটা ওলোট পালট করে দেয়।
যে প্রতিনিয়ত তার শারীরিক কষ্ট ও দুর্বলতা ভুলে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে তার জন্য এই মানসিক ধাক্কাটা সামলানো কতটা কঠিন ছিল তা বলার প্রয়োজন পড়ে না। কোর্ট কেসের কারণে পাবলিক ইমেজের ক্ষতি, নিজের বাবা ভুল এটা জেনেও তার বিপক্ষে দাঁড়ানোর অক্ষমতা, ভালোবাসার মানুষকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার ভয়, বাবা ও ভালবাসার মধ্যে দ্বন্দ্ব, নিজের অসুস্থতা সব মিলিয়ে এতো কিছু একসাথে ফেইস করা যেন মাধুবালার পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
দিশেহারা মধুবালা শেষ বারের মতো সবকিছু ঠিক করার একটা চেষ্টা করেন। তিনি তার ভালোবাসার মানুষটিকে অনুরোধ করেন তার বাবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। তার ধারণা ছিল দিলীপ কুমার যদি একটিবার আতাউল্লাহ খানের কাছে সরি বলেন তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দিলীপ কুমার তার এই ইচ্ছেটি পূরণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি মধুবালাকে বলেন যেই অপরাধ তিনি করেননি, তার জন্য তিনি ক্ষমা চাইবেন না। সেই সাথে তিনি মধুবালাকে দৃঢ় চিত্তে এও জানান তিনি তাকে ভালোবাসেন এবং আমৃত্যু বাসবেন। তবে তাকে বিয়ে করতে হলে মধুবালাকে তার বাবার সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করে, পরিবারকে ভুলে গিয়ে তার কাছে আসতে হবে।
মধুবালার পক্ষে পরিবার ছেড়ে দেয়া বা বাবার বিরুদ্ধাচারণ করা সম্ভব ছিলো না। কেউ কেউ বলে অতিরিক্ত বাধ্য মেয়ে হওয়াতে সারাজীবন তিনি বাবার ভুলের খেসারত দিয়েছেন, আবার অনেকে বলে তার পরিবার তার দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতার কারণে তিনি বারবার কষ্ট পেয়েছেন। ভালোবাসা আর পরিবারের প্রতি কর্তব্যের মধ্যে যখন তাকে যেকোন একটিকে বেছে নিতে বলা হলো তিনি পরিবারকেই বাছলেন অথবা বেছে নিতে বাধ্য হলেন।
নিজের ভালোবাসার প্রতি আস্থা ছিল, ভেবেছিলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আর ঠিক হলো না। মুঘল এ আজম এর শুটিং তখনও চলছে। সম্পর্ক ভেঙে যাবার পরও দুজনকে একসাথে কাজ করে যেতে হচ্ছে। প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ছবিটির কাজ চালিয়ে যান তিনি। ক্যামেরার সামনে যার সাথে দুধর্ষ সব রোমান্টিক দৃশ্যে অভিনয় করতে হচ্ছে, সেই মানুষটা বাস্তবে তার হৃদয় ভেঙে টুকরো করে দিয়েছে। তবু তাকে ভালোবাসেন তিনি। কি অদ্ভুত নিরুপায়তা!

ভালবাসার মানুষ সামনে অথচ আজ আর সেই ভালবাসা প্রকাশের অধিকারটুকুও তার নেই, মানুষটা অনেক দূরে সরে গেছে। ইগোর এই কঠিন দেয়াল ভেদ করা কি এ জীবনে আর সম্ভব হবে? ভয়াবহ মানসিক চাপে আরো ভেঙে পড়লেন তিনি। শরীরের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যেতে লাগলো। তবু কাজের প্রতি একাগ্রতা রক্ষায় কার্পণ্য করেননি কখনো।
এরকম একটি ছবি, এরকম একটি চরিত্র একজন শিল্পীর জীবনে বড় একটা আসে না। মধুবালা সেটি বুঝতে পেরেছিলেন দেখেই নিজের অসুস্থতার পরোয়া না করে প্রচন্ড খেটে, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ছবিটিতে অভিনয় করে গিয়েছেন। আনারকলিকে বেঁধে রাখা ওই ভারী ভারী লোহার শেকলগুলো কিন্তু সত্যিকারের ছিল, অসুস্থ মধুবালার সেগুলো পরে অভিনয় করতে কষ্ট হতো, হাতে পায়ে দাগ পড়ে যেত, দিন শেষে বাড়ি ফিরে ব্যাথায় কুঁকড়ে যেতেন তবু ক্যামেরার সামনে তার সততার কোনো কমতি ছিল না। এভাবেই এই কালজয়ী ছবিটির কাজ শেষ করেন তিনি।
তার পরিশ্রম, তার ত্যাগ বৃথা যায়নি। সিনেমাপ্রেমীরা আজও তাঁকে আনারকলি হিসেবে মনে রেখেছে। ছবিটি মুক্তির ষাট বছর পরও ছবিটির প্রতি মানুষের আগ্রহ এবং ভালোবাসা অক্ষুন্ন আছে।
মুঘল এ আজম এর কাজের সাথে আরো যে কয়েকটি ছবির কাজ মধুবালা করছিলেন তার একটি ছিল চলতি কা নাম গাড়ি। এই ছবিটিতে কাজ করার সময় কিশোর কুমার মধুবালার প্রেমে পড়েন। কিশোর কুমার তখনও কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার হয়ে ওঠেননি। তিনি তখন শুধুই একজন স্ট্রাগলিং অভিনেতা। কলকাতা থেকে বোম্বে এসে অভিনয়ে সফল হওয়ার চেষ্টা করছেন। মনের মতো ব্রেক পাচ্ছেন না দেখে নিজেই ভাইদের সাহায্য নিয়ে ছবি প্রযোজনা করছেন। সেই ছবিতে তিনি নায়ক ও মধুবালা নায়িকা। বৃষ্টির রাতে গাড়ির গ্যারাজে বিখ্যাত সেই গানটি সিনেমাপ্রেমীরা নিশ্চই চেনেন? এক লাড়কি ভিগি ভাগি সি। হ্যাঁ, সুপারহিট গান, ছবিও সুপারহিট। সেই সাথে কিশোরকুমারের মধুবালার পিছনে পাগলের মতো বিয়ে করার জন্য ঘোরাও সিনে ম্যাগাজিন গুলোর জন্য হট এবং হিট টপিক।
কিন্তু মধুবালা তো শুধুই দিলীপ কুমারকে ভালবাসেন। পুরোনো দিন ফিরে আসবে না জেনেও মনকে মানাতে পারেন না। দিলীপ কুমারের নির্মায়িকতা আর কাঠিন্য ধীরে ধীরে মধুবালার অভিমানকে ক্ষোভে পরিনত করে ফেলে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বিধস্ত মধুবালা শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সপ্রাপ্ত ও এক সন্তানের জনক কিশোর কুমারকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিশোর কুমার মধুবালাকে বিয়ে করা জন্য ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হন, নাম নেন আব্দুল করিম। তিনি মধুবালার প্রতি এতটাই মোহগ্রস্থ হয়েছিলেন যে, মধুবালা যে তাকে ভালোবাসেন না এটা নিয়েও তার কোনো সমস্যা ছিল না।

সবাই জানতো মধুবালার এ সিদ্ধান্ত শুধুই জেদের বশে নেয়া। এ যেন দিলীপ কুমারকে বোঝানোর জন্যই মধুবালার একটা জবাব, মরিয়া হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা যে দেখো কেউ তো আছে যে পাগলের মতো অস্থির হয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
হাতে অন্যান্য যেসব ছবি ছিল, সেগুলোর কাজ শেষ করে মধুবালা লন্ডনে যাবার প্রস্তুতি নেন। কথা হয় লন্ডনে গিয়ে মধুবালার চিকিৎসা শেষ করে তাদের বিয়ে হবে। কিন্তু কিশোর কুমার লন্ডনে যাওয়ার আগেই বিয়ে করার জন্য চাপ দেন। তার মধুবালাকে পাওয়ার জন্যে এই অস্থিরতা ও আকুলতার জয় হয়। বিয়ে করেই লন্ডন যান তারা।
সালটা ছিল ১৯৬০। সবার মতো কিশোর কুমারও ভেবেছিলেন অপারেশন করে মধুবালা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু লন্ডনের ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, মধুবালাকে অপারেট করা আর সম্ভব না। এখন আর কিছুই করার নেই (সেই যুগে ventricular septal defect এর চিকিৎসা ছিল না)। মধুবালার হাতে আর মাত্র বছর দুয়েকের মতো সময় আছে। কোনোভাবেই তাকে বাঁচানো যাবে না। তার অবস্থা এখন শুধুই খারাপ হবে। কাজ করা বা স্বাভাবিক বৈবাহিক জীবন যাপন দুটোর একটিও তিনি আর করতে পারবেন না। দুটোই তার জন্য নিষিদ্ধ, কারণ এতে তার মৃত্যু আরো এগিয়ে আসবে। মধুবালাকে জানিয়ে দেয়া হয় পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও চিরপ্রস্থানের অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
বহু সাধনা করে মধুবালাকে বিয়ে করা কিশোর কুমার এরকম ভয়ঙ্কর খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, প্রস্তুত ছিলেন না মধুবালাও। অনেক কষ্ট, সংগ্রাম, ঘাত প্রতিঘাত, হৃদয়ভাঙার যন্ত্রনা, অপমান সবকিছু সহ্য করার পরও মধুবালার মনে বেঁচে থাকার আশা ছিল। খারাপ দিন প্রচুর দেখেছেন তিনি, অনেক যন্ত্রনাও সয়েছেন কিন্তু ভাগ্যের এরকম নিষ্টুর পরিহাসের জন্য কখনোই তৈরী ছিলেন না।
তার মৃত্যুর অনেক বছর পরে একটি সাক্ষাৎকারে তার ছোট বোন বলেছিলেন, মধুবালা ভীষণ ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন, বারবার বলতেন, আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চাই না। আমি এভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই না...
দেশে ফিরে আসার পর কিশোর কুমার পাল্টে গেলেন। মধুবালার জীবনের নির্মম সত্য, তার আসন্ন মৃত্যু কিশোর কুমারের প্রেমিক মনকে যেন এক ঝটকায় বহুদূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো। কাটার রোডে একটি বাড়ি কিনে ২৪ ঘন্টার জন্য মধুবালার কাছে একটি নার্সকে নিয়োগ করে কিশোর কুমার তার দায়িত্ব শেষ করলেন। বৈবাহিক জীবন যখন যাপন করা সম্ভব নয়, তাহলে একসাথে থেকে কী হবে? তিনি সৃষ্টিশীল মানুষ, ব্যস্ত মানুষ, তার তো ঘরে বসে বৌ এর সেবা করলে চলবে না। তিনি আলাদা থেকে নিজের ক্রিয়েটিভিটি বিকাশে মনোনিবেশ করা অধিক প্রয়োজনীয় মনে করলেন। ছ' মাসে একবার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন সেই যথেষ্ট।
আর কিশোর কুমারেরই বা দোষ কী? পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে যে বড্ডো দেরি করছিলেন মধুবালা। ডাক্তারের দেয়া দুবছরের সময়কাল অতিক্রম করেও আরো অনেকগুলো বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। নিঃসঙ্গ, প্রেমহীন, বন্ধুহীন হয়ে বিছানার সাথে মিশে টিকে ছিলেন দীর্ঘ নয়টি বছর। ভীষণ লড়াকু মেয়ে ছিলেন যে! তাই হয়তো এতো সহজে হার মানতে চাইতেন না।
শরীরে যদি একটু বল অনুভব করতেন তখনি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়তেন। এরকমই একবার(১৯৬৬) মনে হয়েছিল শরীর বুঝি ঠিক লাগছে, পুরোনো এক ফিল্মের সেটে গিয়েছিলেন ফেলে আসা কাজ আবার নতুন করে শুরু করার আশা নিয়ে। কিন্ত নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হওয়ায় কাজ আর শুরু করতে পারেন নি, আবার সেই বিছানাতেই ফিরতে হয়েছিল তাকে।
তার ছোটবোনের ভাষ্যমতে, দিলীপ কুমারকে আমৃত্যু ভালবেসে গিয়েছিলেন মধুবালা। কোনোদিন ভুলতে পারেননি। চেয়েছিলেন নিজের জীবনের গল্প নিয়ে একটি ছবি নির্মাণ করতে। নাম দিয়েছিলেন ফর্জ অউর ইশক (কর্তব্য ও ভালবাসা)। কিন্তু সেটি আর করা হয়ে উঠেনি।
১৯৬৯ সালের শুরুতে শরীর খারাপের মাত্রাটা যেন একটু কমে এসেছিলো। ভেবেছিলেন এবার একটু উঠে দাঁড়াতে পারবেন, নতুন কিছু একটা করতে পারবেন, একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল। মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে এতগুলো বছর যখন টিকে গেলেন, আরো কিছুদিন নিশ্চয়ই পারবেন। ঠিক তখনই আচমকা সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মধুবালা। ছত্রিশ বছর বয়সের স্বপ্নাতুর চোখ দুটো বুজে গেলো।
দিনটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রূয়ারি। তার মৃত্যুর পর এসেছিলেন দিলীপ কুমার। আর ইগো দেখাবেন কাকে? মানুষটিই তো নেই! অভিমানী মধুবালা কি ওপার থেকে তা দেখতে পেয়েছিলেন? বলে উঠেছিলেন কি, সেই তো আসতেই হলো, শুধু যখন সব শেষ হয়ে গেলো। কে জানে! মধুবালার হৃদয়ের কথাগুলো জানার সব উপায় তিনি নিজে বন্ধ করে গিয়েছিলন। নিজের জীবনের সব না বলা কথা, অভিযোগ অনুযোগ, কষ্ট, অভিমান, ভালবাসার স্মৃতি সবকিছু নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। ওই ডায়েরিই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।
তার মৃত্যুর পর তার সাথে সাথে তার ডায়েরীটিকেও সমাহিত করা হয়। তার একান্ত অনুভূতিগুলোর একমাত্র সাক্ষীকেও তিনি নিজের সাথে করে নিয়ে গিয়েছেন। এও যেন তাঁর আরেক অভিমান। যেন বলতে চাইলেন, আমার কষ্ট আমারই থাক, আমার সাথেই শেষ হয়ে যাক, অন্য কাউকে এর ভাগ দেবো না। তবু যারা তাঁকে পছন্দ করে, মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও ভালোবেসে স্মরণ করে, তাঁর করে যাওয়া কাজগুলো দেখে তাকে শিল্পী হিসেবে সম্মান করে, তারা সকলেই অনুভব করতে পারে এক দুঃখী অভিমানী নিঃসঙ্গ মধুবালাকে।
কিছু প্রেম পূর্ণতা পেয়ে সুন্দর। আবার কিছু প্রেম অপূর্ণতায় সার্থক। মধুবালার ভালোবাসার গল্প দ্বিতীয় দলের। তাই সফলতা না পেয়েও এটি সফল। মৃত্যুকে বরণ করার মুহূর্ত পর্যন্ত যে ভালোবেসে যায় তার ভালবাসা কখনো অসম্পূর্ণ হতে পারে?