পারিবারিক সংকটের চোরাস্রোত, নানাবিধ সম্পর্কের কোমলতা-জটিলতা কিংবা গৃহাভ্যন্তরের সরল-গরল তাপমাত্রা...সবকিছু নিয়েই টুকরো টুকরো কথার মালা গেঁথে বসেন পরিচালক রোজিন থমাস, 'হোম' নামের সিনেমায়। যে সিনেমাকে 'সিনেমা' কম, আত্মশুদ্ধির দাওয়াই বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত...

'হোম' বা 'ঘর' এর সংজ্ঞা ব্যক্তিভেদে আলাদা৷ কারো কাছে 'ঘর' খুব আটপৌরে এক জায়গা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এ জায়গা মোটেও আটপৌরে না, বরং বেশ জটিলতার সমাবেশ এখানে। ব্যক্তিবিশেষের মতানৈক্যের এ হিসেবে 'ঘর' এর সোজাসাপ্টা সংজ্ঞা দেয়া আসলে খুব কঠিন। তবে আপাতদৃষ্টিতে যতটুকু বোঝা যায়, ঘরই সে জায়গা, যেখানে কারো অভিনয় থাকে না। চেহারায় মুখোশ থাকে না। কথাবার্তায় কাঁটাতার থাকে না। আচরণের জটিলতা থাকে না। 

আবার ঘরেও জটিলতা হয়। অথবা ঘনায়। সে জটিলতাও নানাবিধ। বাবা-মা'র সাথে সন্তানের সম্পর্কের জটিলতা। পরিবারের সদস্যদের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা। হুটহাট নানা ক্রাইসিসে আচমকা বিপদে পড়ার জটিলতা। আবার প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে প্রযুক্তিঘনিত জটিলতাও নেহায়েত কম না। সবমিলিয়ে ঘরের ভেতরেও অজস্র সর্পিল চোরাস্রোতের সমাবেশ। কখনো তা টের পাওয়া যায়। কখনো না। 

সেসব চোরাস্রোত, সম্পর্কের কোমলতা-জটিলতা কিংবা গৃহাভ্যন্তরের সরল-গরল তাপমাত্রা...সবকিছু নিয়েই টুকরো টুকরো কথার মালা গেঁথে বসেন পরিচালক রোজিন থমাস, 'হোম' নামের সিনেমায়। যে সিনেমাকে 'সিনেমা' কম, আত্মশুদ্ধির দাওয়াই বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। 

সিনেমার ভরকেন্দ্র এক পরিবার। যে পরিবারে সদস্য-সংখ্যা পাঁচ। বাবা-মা, তাদের দুই সন্তান এবং এক বৃদ্ধ দাদু। এই পঞ্চপাণ্ডবকে ঘিরে আবর্তিত 'হোম' এর প্রোটাগনিস্ট চরিত্রের নাম- অলিভার টুইস্ট। নামটা নিঃসন্দেহে অদ্ভুত। চার্লস ডিকেন্সের জনপ্রিয় চরিত্রের নাম কেন ভারতের এক অধিবাসীর নাম হলো, সে প্রশ্নের উত্তর এখানে না, সিনেমাতে মিলবে। 

অলিভার টুইস্টের দুই ছেলে। বড় ছেলে ফিল্মমেকার। প্রথম সিনেমা হিট হওয়ার পরে এখন দ্বিতীয় সিনেমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে লড়ছেন তিনি। পাশাপাশি প্রেমঘনিত জটিলতাও রয়েছে তার৷ দ্বিতীয় ছেলে অকালকুষ্মাণ্ড। একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেটা নিয়েই তার রাত-দিন। এই দুই ছেলের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে প্রযুক্তিতাড়িত হয়ে, প্রযুক্তিমণ্ডিত হয়ে। দুই ছেলের এই প্রযুক্তিপ্রেম দেখে একদিন বাবা অলিভারেরও মনে হয়, তারও যদি একটা স্মার্টফোন থাকতো, বেশ হতো! তিনিও অনেক কিছু করতে পারতেন! 

পাকেচক্রে তার হাতে স্মার্টফোন চলেও আসে একদিন। স্মার্টফোনের নৌকায় সওয়ার হয়ে অলিভার টুইস্ট প্রযুক্তির এই কালস্রোত বোঝার চেষ্টা করেন।  আদ্যিকালের মানুষ অলিভার টুইস্ট, এ আধুনিক জগতের সাথে অভ্যস্ত হতে তাই খানিকটা সময় লাগছিলো। কিন্তু এরইমধ্যে তিনি এমন এক কাজ করে ফেলেন, যার ফলশ্রুতিতে প্রযুক্তির রূঢ় অবয়ব প্রকট হয়ে ওঠে তার সামনে। অন্তর্জালের জটিল সর্পিল প্যাঁচ এ আচমকা জড়িয়ে অলিভার টুইস্ট এমন এক বিপাকে পড়েন, যে বিপাকের পরবর্তীতে ঘরের সদস্যদের সাথে মুখোমুখি সংঘাতে পড়তে হয় তাকে। 

'হোম' সম্পর্কের জটিলতার কথা বলে! 

এসব নিয়েই 'হোম' এর গল্প। হলফ করে বলা যায়, এ সিনেমায় যেসব বিষয়ের অবতারণা হয়েছে, সেগুলো আমাদের অনেকের পরিবারেরই নিত্যকার ঘটনা। ছোট ছোট ম্যাক্রো ইমোশনস, বড় বড় বার্নিং ইস্যুর সাটল সব ট্রিটমেন্ট, ফ্যামিলি মেম্বারদের ইমোশনাল আপডাউন... যেসব কিছু এই সিনেমার উপজীব্য, সেসব আমাদের  পরিচিত। এ কারণে সিনেমাটা যখন কেউ দেখবেন, সে খুব তাড়াতাড়ি কানেক্ট করতে পারবেন। উপলব্ধি করবেন বিষয়কে। সিনেমাকেও। 

'হোম' এর সবচেয়ে ভালো দিক- সিনেমার মেইন থিমের সাথে যুগপৎভাবে বেশকিছু সাবপ্লট আনা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ামের প্যারাডক্স, স্মার্টফোন অ্যাডিকশন, মেন্টাল হেলথ, মিডিওকার লাইফের বিড়ম্বনা, পরিবারের সদস্যদের মেন্টাল কমপ্লেক্সিটি... দারুণ এবং প্রাসঙ্গিক সব সাবপ্লট। তবে, এই যে একাধিক সাবপ্লট, এটাই আবার সিনেমার ঋণাত্বক দিক। একগুচ্ছ সাবপ্লট আনা হয়েছে, কিন্তু সবগুলোকে ভালোভাবে স্টাবলিশ করা হয়নি। সেটা সম্ভবও না৷ ২ ঘন্টা ৩৮ মিনিটের রানটাইমে এতগুলো কমপ্লেক্স এলিমেন্টসকে ঠিকঠাকভাবে পর্দায় তোলাও যায় না। সেক্ষেত্রে নির্মাতা কিছু প্লট কমিয়ে এনে আরেকটু ডিটেইলসের দিকে যেতে পারলে ভালো করতেন। 

প্রযুক্তিভেদে পালটে যায় সময়! 

ফিরি অন্য প্রসঙ্গে। মালায়ালাম সিনেমার ন্যারেশন স্টাইল কিংবা অভিনয়... সবই টপনচ থাকে। এ সিনেমার ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় নেই। সবাই যার যার জায়গা থেকে দারুণ। তবে মন জয় করে নিয়েছেন ইন্দ্রানস। আটপৌরে এক বাবার চরিত্রে তিনি যে অভিনয় করেছেন, স্রেফ দুর্দান্ত। মনে হয় না, তার জায়গায় অন্য কেউ এতটা সাবলীল অভিনয় করতে পারতেন! প্রসঙ্গক্রমে একটা দৃশ্য মনে পড়ছে, যেখানেই অলিভার টুইস্ট (ইন্দ্রানস) এর বড় ছেলে তাকে বলছে-

তোমার জীবনের যা অ্যাচিভমেন্টস, তাতে একটা বইয়ের এক পৃষ্ঠাও ভরতি হবে না।

তখন 'অলিভার টুইস্ট'রূপী ইন্দ্রানস এর চোখমুখের যে অভিব্যক্তি, তা মনে থাকবে বহুদিন। আবার স্মার্টফোন-জনিত বিড়ম্বনার পরে তার চোখেমুখে যে সলজ্জ বিব্রতভাব, সেটাও খুব সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে যায় সিনেমার সাথে। ইন্দ্রানস এ সিনেমার শুরু থেকে শেষপর্যন্ত অভিনয় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তিনি এ সিনেমার প্রোটাগনিস্ট। দারুণ! বাকিদের অভিনয়ও ভালো। শ্রীনাথ, মানজু,  নাসলেন, জন...সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে অনবদ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর কিংবা এডিটিং...সবই পরিশীলিত, ছিমছাম। আক্ষেপের জায়গা নেই। সিনেমার শেষদিকে খানিকটা ওভার-ড্রামাটিক সিচুয়েশন আছে। কিন্তু সেটা ধর্তব্য না। সিনেমার সাথে কোথাও গিয়ে যেন এই অতি-আবেগও মিশে যায়। খুব একটা বাড়াবাড়ি মনে হয় না। 

ইন্দ্রানস এর অভিনয় চোখে লেগে থাকবে বহুদিন! 

শেষে এসে মোদ্দা কথা এটাই, 'হোম' সিনেমা দেখা উচিত সবার। সিনেমায় প্লটজনিত সমস্যা আছে, একাধিক প্লটহোলও আছে। তা সত্বেও এ সিনেমা দেখার মতন। 'ফিল গুড' মুভি হিসেবে এই নির্মাণ দুর্দান্তভাবেই উতরে যাবে। পাশাপাশি, এই সিনেমা যেভাবে প্রশ্ন তোলে নানাবিধ সামাজিক ব্যাধি নিয়ে, সেও অভিনব। সামাজিক মাধ্যমের সরব উপস্থিতি আমাদেরকে ক্রমশ অসামাজিক করে তুলছে কী না, প্রযুক্তির সাথে অতিরিক্ত মাখামাখি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিষিয়ে তুলছে কি না, বহুল আলোচিত এসব প্রশ্ন আরেকবার বেশ প্রকট হয়ে উঠবে 'হোম' সিনেমায়! 

সবমিলিয়ে 'হোম' তাই দেখা উচিত দুই কারণে। প্রথমত, আনন্দের জন্যে। দ্বিতীয়- উপলব্ধির জন্যে। তাহলেই সার্থক হবে এ নির্মাণ দেখা! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা