মুক্তির পর প্রথম কয়েকদিন 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' এর আইএমডিবি রেটিং ছিল ১০। এরপরই আইএমডিবি তাদের অ্যালগরিদম ব্যবহার করে 'ভুয়া ভোট' বাতিল করায় কমতে শুরু করে সিনেমাটির রেটিং। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী তখন অভিযোগ তোলেন, ম্যানিপুলেট করে তার সিনেমার রেটিং কমানো হচ্ছে। আসলেই কি তাই? আইএমডিবির রেটিং কি ম্যানিপুলেট করে কমানো যায়? কীভাবে কাজ করে এই আইএমডিবি রেটিং?

'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই যেভাবে আগ্রাসীভাবে বক্স অফিসে রাজত্ব করে যাচ্ছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপে আবির্ভূত হবে এ সিনেমা, তা হয়তো আশা করেননি কেউই। এবং যেকোনো সিনেমা ব্যবসাসফল হলেই সে সিনেমার সাথে যা যুক্ত হয়, অর্থাৎ বিতর্ক, সেটি সঙ্গী হয়েছে এ সিনেমারও। অবশ্য, খানিকটা অন্যভাবে। বিতর্কটা আইএমডিবি অর্থাৎ ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজকে নিয়ে। যারা সিনেমা নিয়ে ছিঁটেফোঁটাও জ্ঞান রাখেন, তারা সবাই জানেন, 'আইএমডিবি রেটিং' এর উপরে ভরসা রেখেই মূলত সিনেমা বাছাই করে সাধারণ মানুষজন। এবং এই 'আইএমডিবি রেটিং'কে নিয়েই এখন উঠেছে প্রশ্ন। এবং প্রশ্নটি উঠিয়েছেন স্বয়ং 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' এর ডিরেক্টর বিবেক অগ্নিহোত্রী। তার অভিযোগ- 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' এর আইএমডিবি রেটিং বেশি ছিলো আগে। কিন্তু, এখন ম্যানিপুলেট করে রেটিং কমানো হচ্ছে।

এই অভিযোগের সাপেক্ষে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন চলে আসে মাথায়৷ প্রথম প্রশ্ন- আইএমডিবি রেটিং নির্ধারিত হয় কিভাবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন- এই রেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে কারা? তৃতীয় প্রশ্ন- আইএমডিবি রেটিং কতটা ভরসাযোগ্য? চতুর্থ প্রশ্ন- আইএমডিবি রেটিং ম্যানিপুলেট করা সম্ভব কি না?  এক এক করে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক। 

প্রথমত- আইএমডিবির রেটিং নির্ধারিত হয় এই সাইটের মেম্বারদের ভোটের ভিত্তিতে। আইএমডিবি'র যেকোনো নিবন্ধিত সদস্যই 'এক থেকে দশ' এর মাপকাঠিতে যেকোনো সিনেমাকে মূল্যায়ন করতে পারেন৷ এখানে আলাদাভাবে বলে রাখি, মুভি রিলেটেড ওয়েবসাইট 'রটেন টমেটো' কিংবা 'মেটাক্রিটিক' এ যেমন ফিল্ম ক্রিটিকদের ভোটের ভিত্তিতে সিনেমার রেটিং দেয়া হয়, আইএমডিবি'র ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে গড়পড়তা সবাই-ই দিতে পারেন ভোট। এবং সবমিলিয়ে কতজন ভোট দিলেন এবং 'এক থেকে দশ' এর মধ্যে কত নাম্বারে ভোট দিলেন, এটার গড় করে এরপর আইএমডিবি একটা ওভারঅল রেটিং প্রকাশ করে। তবে 'পূর্নাঙ্গ রেটিং' প্রকাশের আগে 'আইএমডিবি' খানিকটা অ্যালগরিদম ব্যবহার করে। ব্যবহার করার কারণটা বলি।

অনেক সময় এমন হতেই পারে, আইএমডিবি'তে ফেক আইডি খুলে কোনো বিশেষ সিনেমার রেটিং বাড়ানোর চেষ্টা করলো কিছু মানুষজন। এরকম অপচেষ্টা যাতে না হয়, এবং, হলেও যাতে দমন করা যায়, সেজন্যেই আইএমডিবি তাদের নিজস্ব অ্যালগরিদমের সাহায্যে কিছু ফিল্টার ব্যবহার করে। যেমন- যেকোনো সিনেমার রেটিং যারা দিচ্ছে, তারা নতুন ব্যবহারকারী কি না, তাদের আইডি অথেনটিক কি না... এসব ফিল্টার করার পরেই মূলত আইএমডিবি'র ' ফাইনাল রেটিং' প্রকাশিত হয়। এবং এটাও বলে রাখা ভালো, 'আইএমডিবি'তে একটা স্টেবল রেটিং পেতে হলে প্রয়োজন হয় কমপক্ষে ২৫০০০ ভোটেরও। 

এটুকু পড়ার পরে সিংহভাগ পাঠকেরই বুঝতে পারার কথা, আইএমডিবি'র রেটিং কিভাবে নির্ধারিত হয় এবং কারা এই রেটিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। যদি এটুকু বুঝতে পারা যায়, তাহলে তৃতীয় প্রশ্নে ধীরে ধীরে যুক্ত হওয়া যেতে পারে এখন৷ অর্থাৎ, জানার চেষ্টা করা যেতে পারে, আইএমডিবি রেটিং আসলে কতটা ভরসাযোগ্য। এবং এ প্রশ্নের উত্তরের সাথে বেশ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকবে চতুর্থ প্রশ্নের উত্তরও, অর্থাৎ, আইএমডিবি রেটিং ম্যানিপুলেট করা যায় কী না। শুরুতেই যেটা বলার- আইএমডিবি রেটিং খুব একটা ভরসাযোগ্য না। এখানে যারা ভোট দেয়, তাদের সিংহভাগই পুরুষ। এবং সাধারণ দর্শক। তাদের দেয়া ভোটে ক্রিটিক্যাল থিংকিং যে সেভাবে প্রকাশিত হয় না, তা বোধহয় আলাদাভাবে না বললেও চলে। এবং, আইএমডিবি'র যে অ্যালগরিদম, অর্থাৎ যে অ্যালগরিদম 'ফেক ভোটার' ডিটেক্ট করতে পারে, সেটিও যে খুব একটা নিরপেক্ষ, সেটাও বুকে হাত দিয়ে সেভাবে বলা যায় না। এবং আইএমডিবি'র ফিল্টারিং এর পুরো প্রসেসটাই 'গোপনীয়' বলে এই প্রসেসের স্বচ্ছতা নিয়েও থাকে নানা চাপা ফিসফিস। 

দ্য কাশ্মীর ফাইলস

এসবের পাশাপাশি, কিছু ক্ষেত্রে 'আইএমডিবি রেটিং' ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও ব্যবহার করে মানুষ। যেমন- বলিউডের 'গুন্ডে' সিনেমা ব্লকবাস্টার হিট হবার পরেও অজস্র বাংলাদেশি এই সিনেমার 'আইএমডিবি প্রোফাইল' এ গিয়ে 'লো রেটিং' দিয়ে এসেছিলো। কারণ একটাই- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছিলো এ সিনেমায়। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, অ্যাঞ্জেলিনা জোলির 'ইন দ্য ল্যান্ড অব ব্লাড অ্যান্ড হানি'র কথাও। বসনিয়া যুদ্ধের বিতর্কিত পোর্ট্রেয়ালের জন্যে যে সিনেমাকে '১/১০' রেটিং দিয়েছিলো বহু দর্শক। অর্থাৎ, বিষয়টি পরিষ্কার, অডিয়েন্স নানা কারণে, নানা চিন্তায়, নানা আইডিওলজির ফলশ্রুতিতে তাদের 'আইএমডিবি রেটিং' নির্ধারণ করে। এবং ঠিক এ কারণেই- 'আইএমডিবি রেটিং' ৭ হলেই যে কোনো একটা সিনেমা গুণগতমানে উতরে যায় এবং 'আইএমডিবি'তে ভালো রেটিং পেলো না বলেই সে সিনেমাকে উড়িয়ে দিতে হবে... এমনটা মোটেও না। এমনটা বলার সুযোগ নেই তিলমাত্রও। 

পরবর্তী চিন্তা- আইএমডিবি রেটিং কি ম্যানিপুলেট করা সম্ভব। উত্তর- সম্ভব। কিন্তু সে ম্যানিপুলেশন হয় খানিকটা সাটল ওয়েতে। প্রত্যেক তারকারই আজকাল বিশেষ ফ্যান কমিউনিটি আছে। সিনেমা মুক্তির পরে সেই কমিউনিটির ফ্যানাটিক ভক্তরা দেদারসে '১০/১০' রেটিং দিয়ে আসে সিনেমাকে এবং এই রেটিংয়ে 'সিনেমার গুণগতমান' নিয়ে তারা বিন্দুমাত্রও যে ভাবে না, সেটিও ধ্রুবসত্যি। এই ফ্যানাটিক 'ফ্যান বেজ' এর পরে আসে 'পিআর টীম' এর ভূমিকা। কাশ্মীর ফাইলস সিনেমাটির ক্ষেত্রে এই ঘটনাটিও ঘটেছে শুরুতে, একারণে মুক্তির পর প্রথম কয়েকদিন সিনেমাটির রেটিং ছিল ১০/১০, যেটি প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। ফ্যানাটিক ভোটের পাশাপাশি, প্রত্যেক প্রোডাকশন হাউজেরই নিজস্ব 'পিআর টিম' আছে, যারা নানাকিছুর পাশাপাশি কাজ করে সিনেমার 'আইএমডিবি রেটিং' বাড়ানো নিয়েও। কমবেশি সবাই-ই করে থাকেন এ কাজ। বিশেষ করে, উপমহাদেশে সাউথ ইন্ডিয়ান এবং তামিল ইন্ডাস্ট্রিতে এটা বহুল প্রচলিত এক বিষয়। 

আইএমডিবি রেটিং বহু আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ

সুতরাং, উপরের আলোচনা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' এর পরিচালক যে অভিযোগ করছেন, তা একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার মত অমূলক না। যেহেতু এই সিনেমার অস্বস্তিকর তথ্য অনেকেরই 'গলার কাঁটা', তাই বিরোধিতার প্রতিক্রিয়ায় এরকম 'উদ্দেশ্যমূলক রেটিং' খুব একটা অমূলকও না। আবার আইএমডিবি রেটিং নিয়ে আহ্লাদে আটখানা হওয়া, কিংবা নাকিকান্না কাঁদারও কোনো মানে নেই। কারণ 'আইএমডিবি রেটিং' এর এই 'ভানুমতীর খেল' এ সিনেমার তেমন কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না কখনোই। দিনশেষে বক্স অফিসের আয়, আর দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পারার ওপরেই সিনেমার সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে বহুলাংশে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা