বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর কলমে, ক্যামেরায়। লিখেছিলেন গল্প-উপন্যাস, নির্মাণ করেছিলেন কালজয়ী সব সৃষ্টিকর্ম। যা নিয়ে কথা হয় আজও। বাংলাদেশের পুরো আয়ুষ্কালেও যেসব শিল্পকর্ম নিয়ে নিয়মিতই কথা হবে...

খ্যাতিমান লেখক আহমেদ ছফা বলতেন, প্রত্যেক লেখকেরই একটা দায় রয়ে যায়, নিজের সময়কে তার কলমের মধ্যে দিয়ে তুলে আনার। যদিও অনেক লেখকই সময়ের পরিক্রমায় সে দায় থেকে নিজেদের পরিত্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু এই পরিত্রাণের পেছনে লেখকদের ঢালাওভাবে দোষ দেয়াটাও সমীচীন নয়। প্রশাসন-যন্ত্রের নিষ্পেশন, পেশিশক্তির দাপট, সুযোগ-সুবিধার  প্রলোভন... এসব নানাবিধ প্রভাবক সময়ের নানা প্রকোষ্ঠে বহু লেখকের কলমের ধার কমিয়েছে, স্থবিরতা বাড়িয়েছে। বরাবরই উপলব্ধি করেছি, প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও ইতিহাসের এমন সব অধ্যায়ের সাক্ষী, যা নিয়ে চাইলে দুর্দান্ত কিছু সাহিত্য, সিনেমা, নাটক নির্মাণ করতে পারতেন তিনি৷ নিজের সময়ের পুরোটাকেই ধারণ করতে পারতেন কলমে।

তিনি ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের মহীরুহ এক প্রতিষ্ঠান। ইতিহাসের নানা ঝাপসা অলিগলিতে তিনি চাইলেই আলোকবর্তিকা হতে পারতেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত মধুরেণসমাপয়েৎ হয় নি। তবে, এটাও ঠিক, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ কে তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর কলমে। লিখেছিলেন গল্প-উপন্যাস, নির্মাণ করেছিলেন কালজয়ী সব সৃষ্টিকর্ম। যা নিয়ে কথা হয় আজও। বাংলাদেশের পুরো আয়ুষ্কালেও যেসব শিল্পকর্ম নিয়ে নিয়মিতই কথা হবে।

'ছবি বানানোর গল্প' বইয়ে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন নিজের প্রথম সিনেমা 'আগুনের পরশমণি' নিয়ে সংকট, ত্যাগ, সাফল্যের কথা।  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ সিনেমা যারাই দেখেছেন, তারা জানেন, কতটা হৃদয়স্পর্শী ছিলো এ নির্মাণ! যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের মাঝখানে মতিন সাহেবের নাতিদীর্ঘ পরিবারের সাথে  সম্পর্কযুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ টানাপোড়েনের যে গল্প পর্দায় তুলে আনেন হুমায়ূন আহমেদ, তা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সমাজসচেতনতায় যে এক বড়সড় প্রভাব রাখে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সিনেমা পরবর্তীতে আটটি শাখায় জাতীয় পুরস্কারও পায়। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সিনেমায় উঠে আসে যুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, দমন-পীড়ন-নিপীড়নের টুকরো টুকরো আলেখ্য। চোখে লেগে থাকার মতন এক কালজয়ী সিনেমা দিয়ে 'পরিচালক' হিসেবে শুরু হয় তাঁর স্মরণীয় এক যাত্রা৷

আগুনের পরশমণি

 

মুক্তিযুদ্ধ'কে সম্মুখে রেখে তিনি নির্মাণ করেছিলেন আরেকটি চলচ্চিত্র; শ্যামল ছায়া। মেটাফোরের ছড়াছড়ি এই সিনেমায় যুদ্ধের দাবানলে আটকে পড়া মানুষগুলোর সংগ্রামের একেকটা খণ্ড খণ্ড গল্পকে যেভাবে তুলে আনলেন তিনি পর্দায়, তা নিয়ে চাইলে গবেষণা হওয়া সম্ভব৷ এক্সপেরিমেন্টাল ক্যামেরার কাজ, দারুণ সিনেম্যাটোগ্রাফী, সাটল সব ইনার মেসেজের এই সিনেমায় যুদ্ধের ত্রাস, শঙ্কার পুরোটাই আসে স্বমহিমায়। যুদ্ধের ডামাডোলে মানুষের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের রকমফেরেরও এক সুলুকসন্ধান দেন নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। 'শ্যামল ছায়া' ২০০৬ সালের অস্কারে 'বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র' শাখায় অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা এটিই, যা অস্কারের মঞ্চে গিয়েছিলো।

শ্যামল ছায়া

গুণী এ নির্মাতার প্রয়াণের পরে তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'অনিল বাগচীর একদিন' অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন মোরশেদুল ইসলাম। 'অনিল বাগচী' নামের প্রচণ্ড সংশয়াকুল একজন যুবক কে উপজীব্য করে শাখাপ্রশাখায় সম্পর্কযুক্ত যুদ্ধের নৃশংসতা, বর্বরতা, অমানবিকতা দেখানোর যে প্রয়াস দর্শক লক্ষ্য করে এই সিনেমায়, সেখানেও ক্ষণেক্ষণে মিশে থাকেন হুমায়ূন আহমেদ। 

অনিল বাগচীর একদিন! 

শুধু সিনেমাতেই 'মুক্তিযুদ্ধ'র নানা অনুষঙ্গ আনেন নি তিনি, এনেছেন তাঁর নির্মিত নাটকগুলোতেও। এই নির্মাণগুলোতে নানাভাবে এসেছে যুদ্ধ, মুক্তি, স্বাধীনতা। বিটিভির কালজয়ী ধারাবাহিক নাটক 'বহুব্রীহি'র কথা তো সর্বজনবিদিত। এরশাদের স্বৈরশাসনের দাপটে তখন প্রকাশ্যে যুদ্ধের কথা বলা যেতো না, 'পাকিস্তানি হানাদার' শব্দ হয়েছিলো নিষিদ্ধ। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তাও করলেন এক অভিনব কাজ। 'বহুব্রীহি' নাটকে 'তুই রাজাকার' বলালেন তোতাপাখির মুখ দিয়ে। নাটকের শেষপ্রান্তে পাকিস্তানিদের হিংস্র অপরাধের কিছুটা ইঙ্গিতও দিলেন চরিত্রগুলোর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে। 

বহুব্রীহি! 

হুমায়ূন আহমেদ নিজের পরিচিতজনদের নাম প্রায়ই নিয়ে আসতেন উপন্যাসে। আনিস সাবেত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু। হুমায়ূন আহমেদের অজস্র বইয়ে 'আনিস' নামের চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এমনটা হয়েছে কালজয়ী 'কোথাও কেউ নাটক' এর সময়েও। বাকের ভাই এবং বদি... 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের এই দুই চরিত্র অমরত্ব পেয়েছে, তাও বহুদিন। আশ্চর্যের বিষয়, এই দুটি চরিত্রের নামও হুমায়ূন আহমেদ নিয়েছেন বাস্তবের দুইজন মুক্তিযোদ্ধা থেকে। বাকের নামটা এসেছে মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য শহীদ আবু বকরের নাম থেকে। বকর ইংরেজিতে নাম লিখতেন- Bakr. সেখান থেকে 'বকর' ক্রমশ রূপান্তরিত হয় 'বাকের' এ। যে নামটাই হুমায়ূন আহমেদ ব্যবহার করেন 'কোথাও কেউ নেই' এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে। 'বদি' নামটিও এসেছে মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম বদির নাম থেকে। এই দুইজন মুক্তিযোদ্ধার নামকে হুমায়ূন আহমেদ খুব সুক্ষ্মভাবেই মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর এ নির্মাণের সাথে।  

কোথাও কেউ নেই! 

তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস 'জোছনা ও জননীর গল্প' অনেকেই পড়েছি আমরা। যদিও এ বইয়ের বিস্তর সমালোচনাও আছে কিছু মহলে, তবে সেটুকু যদি বাদও দেই, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করে লেখা এরকম উপন্যাসের সংখ্যাও খুব বেশি নেই বাংলাসাহিত্যে। এই আলোচিত উপন্যাস অবলম্বনেও হুমায়ূন আহমেদ ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ করেছিলেন। যে নাটকের সম্প্রচার শুরু হয় বিটিভিতে, ২০০৮ সালে। কিন্তু তিন পর্ব প্রচার হওয়ার পরেই তিনি এই ধারাবাহিকের সম্প্রচার বন্ধ করে দেন; বিমানবন্দর এলাকায় স্থাপিত লালন ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে। 

জোছনা ও জননীর গল্প! 

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টিকর্ম বিশ্লেষণ করলে তাই উপলব্ধি হয়, মাতাল হাওয়া বা লিলুয়া বাতাসই শুধু না, জোছনা রাতে ভেসে যাওয়া বন কিংবা বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুলই না, নিজের শেকড় নিয়ে অন্ধকারে থাকা এক প্রজন্মকেও তিনি শুনিয়েছেন মুক্তির গান, দেখিয়েছেন যুদ্ধের ছবি, পড়িয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কীর্তিগাঁথা। তিনি তাঁর সময়কালের অজস্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন, এজন্যে আক্ষেপ থাকবেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নানাবিধ নির্মাণে তিনি ছিলেন সোচ্চার, কলম-ক্যামেরা কে বানিয়েছিলেন যুদ্ধের হাতিয়ার। তা স্বীকার না করা এবং তাঁর এ অবদানের জন্যে কৃতজ্ঞ না হওয়াও হবে পুরোপুরি অনুচিত। 

ইতিহাস-বিমুখ এ জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য নিয়ে সচেতন করলেন যিনি, সেই গুণী লেখক ও নির্মাতার প্রয়াণ দিবসে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা