টানা তিন দশক ক্যারিশম্যাটিক অভিনয়ে তিনি বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি জাতিকে। তারপর একদিন ধুমকেতুর মতোই হঠাৎ চলে গেলেন তিনি। তার এই চলে যাওয়া আজও কাঁদায় আমাদের...

বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির ৭১তম জন্মদিন আজ। তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন, তারও নয় বছর হয়ে গেছে। তবে মৃত্যুর এতদিন পরেও তাকে নিয়ে ভক্তদের ভালোবাসা যেমন একটুও কমেনি তেমনি তার জায়গায় তার কাছাকাছি নতুন কোন হুমায়ুন ফরিদীকেও পাইনি আমরা। এখনও শক্তিশালী কোনো চরিত্রে তার অনুপস্থিতি আমাদের কষ্ট দেয়। 

১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম নেওয়া ফরিদী মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ‪‎বারো‬‬‬‬ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক ‘ প্রথম অভিনয়ে করেন। রক্তে ছিলো অভিনয়, সূর্যের মতো আলো তো তিনি একদিন ছড়াবেনই। অবশেষে তাই হলো। তার অভিনয়ের মুগ্ধতায় বিমোহিত হয়েছিল এই দেশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফরিদী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল-দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি অসংখ্য জনপ্রিয় মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শিল্প-সংস্কৃতিপ্রেমীদের হৃদয়ে আসন গেড়ে নেন। 

১৯৭৬ সালে নাট্যজন সেলিম আল দীন এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নাট্যোৎসব। ফরিদী ছিলেন এর অন্যতম প্রধান সংগঠক। এই উৎসবে ফরিদীর নিজের রচনায় এবং নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত‘ নামে একটি নাটক। নাটকটি সেরা নাটক হিসেবে বিবেচিত হয়। ঢাকা থিয়েটার এ ‎শকুন্তলা‬‬‬‬, ফণীমনসা, কীত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, ভূতের মতো তুমুল জনপ্রিয় মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে হয়ে উঠেন ঢাকা থিয়েটারের প্রাণ ভোমরা। ফরিদী সেসময়ের মঞ্চ নাটকের অদ্বিতীয় ব্যক্তি। নাট্যপাড়ায় তখন শক্তিমানদের একজন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সেলিম আল দীনের অত্যন্ত কাছের একজনে পরিনত হন।

আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটক দিয়ে তার টিভি পর্দায় আগমন। তবে ১৯৮৩ সালে সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় সেই সময়কার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় প্যাকেজ নাটক ” ভাঙনের শব্দ শুনি” তে টুপি দাড়িওয়ালা গ্রামের মিচকা শয়তান ‘সেরাজ তালুকদার’ এর যে চারিত্রিক রুপ তিনি দিয়েছিলেন, আর সেই নাটকে তাঁর সেই অমোঘ ডায়লগ "আরে আমি তো পানি কিনি, পানি, দুধ দিয়া খাইবা না খালি খাইবা বাজান?"- মানুষের মুখে মুখে রটে বেরাতো। নাটকটিতে অসাধারন অভিনয় প্রতিভা দিয়ে তিনি চিনিয়েছিলেন তার অভিনয় শক্তি। এরপর একে একে করেছেন হঠাৎ একদিন, দূরবীন দিয়ে দেখুন, কোথাও কেউ নেই, বকুলপুর কত দূর, ভবের হাট, এরকম আরো অসংখ্য অগনিত তুমুল দর্শকপ্রিয় টিভি নাটক উপহার দিয়েছেন তিনি।

বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন তিনি, টেলিভিশনের স্বর্নযুগে এতো প্রানবন্ত, এতো জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেতো ফরিদীর অভিনয়ে। আর বিটিভির  মাস্টারপিস ‘সংশপ্তক’ নাটকে হুমায়ূনের কান কাটা রমজান চরিত্রে তার অভিনয় যারা দেখেছেন তারা ফরিদীকে স্থান দিয়েছেন হৃদয়ের একেবারে মাঝখানে। আজও তার সেই অভিনয়ের আলো যেন ভেসে বেড়ায় আমাদের মনের মাঝে। 

হুমায়ূন ফরীদি (১৯৫২-২০১২)

বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের অঙ্গনেও তিনি ছিলেন অসাধারণ উজ্জ্বল এক নাম। ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফনিমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘ভূত’ এর মতো অসাধারণ কালজয়ী কিছু মঞ্চনাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। উল্লেখ্য স্বনামধন্য দল ‘ঢাকা থিয়েটার’ এর সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।

আশির দশকে শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ সিনেমায় তার অনবদ্য অভিনয় তাকে চলচ্চিত্র মাধ্যমেও অভিনেতা হিসেবে পরিচিতিনেনে দেয়। তবে নব্বই দশকে এসে নাম লিখিয়েছিলেন বানিজ্যিক ধারার বাংলা সিনেমাতে। টেলিভিশন থেকে সিনেমায় এসে সফল হওয়া প্রথম তারকা অভিনেতাও বলা যায় তাকে। 'হুলিয়া' দিয়ে প্রথম এই ধারার সিনেমাতে অভিনয় করেন তিনি। তবে ফরিদী অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমাপ্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সিনেমা হলে তার সিনেমা মুক্তি মানেই উপচে পরা ভীড়। সেলুলয়েড়ের বিশাল পর্দায় ফরিদীর উপস্থিতি মানে দর্শকদের মুহুর্মুহু তালি। 

একটু একটু করে বাংলা সিনেমায় ভিলেনের সংজ্ঞাটাও যেন পরিবর্তন হতে থাকে। পাশাপাশি কিছু সিনেমায় কমেডি এবং ভালো মানুষের চরিত্রেও তিনি সফল হয়েছেন। একজন পরিপূর্ণ ভার্সেটাল অভিনেতা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমান করেছেন। যেকোনো চরিত্র হোক ফরিদী মানেই জমজমাট অভিনয় এটাই ছিলো ভক্তদের এবং নির্মাদের কাছে তৃপ্তির জায়গা। রাক্ষস, আনন্দ অশ্রু, বিচার হবে, মায়ের অধিকার, একাত্তরের যীশু, ভন্ড, পালাবি কোথায়, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, হিংসা, বিশ্ব প্রেমিক, অপহরণের মতো তুমুল জনপ্রিয় এবং একই সাথে বানিজ্যিকভাবে সফল ২৫০ টির মতো সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। 

অভিনয় জগতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় পুরস্কার আরো আগেই পাবার কথা থাকলেও ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ সিনেমায় জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন হুমায়ুন ফরীদি। তবে তার মতো একজন অভিনেতার একুশে পদক না পাওয়াটা আমাদের জন্যই লজ্জার ছিলো। ২০১৯ সালে তাকে অভিনয়ের জন্য মরনোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। 

একজন জাত অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী, রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়, নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে, একদিন শাসন করবে এই যুবক। সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি, এরপর টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি জাতিকে। তারপর একদিন ধুমকেতুর মতোই হঠাৎ চলে গেলেন তিনি। তার এই চলে যাওয়া আজও কাঁদায় আমাদের। তবে তার অভিনীত নাটক, সিনেমার মধ্য দিয়ে তিনি রয়ে যাবেন প্রতিটি বাংগালীর অন্তরে অনন্তকাল। চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়- হুমায়ুন ফরিদীর মতো অভিনেতা এবং সুন্দর মনের মানুষদের জন্যই মনে হয় এই কথাটি বলা হয়েছে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা