
'ভালোবাসা আসলেই আশ্রয়, চিরকালই আশ্রয় ছিল। আজ থেকে একশো বছর আগে যে প্রেমিক প্রেমিকাটি ভালোবেসে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এজন্যেই নিয়েছিল কারণ তারা একে অন্যের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। ১৯৮০ সালেও তাই, ১৯৯০ সালেও তাই, ২০০০ সালেও তাই, এই দুই হাজার বাইশেও তাই...'
ভালোবাসা দিবসের কল্যাণে ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প সুপরিচিত একটি নাম। পাঠকের পাঠানো গল্প থেকে প্রতি বছর ভালোবাসা দিবসে আমরা তিনটি গল্পের রূপায়ণ দেখতে পাই পর্দায়। তবে এই পুরো আয়োজনে যেই মানুষটা পর্দার পেছনে থাকেন, তাকে কি আমরা চিনি? আজ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সেই মানুষটার সাথে, নাম তার পুলক অনিল। গত চার বছর ধরে তিনি ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু তাই নয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের নাটকে যতগুলো গান আমরা দেখেছি, সবগুলো গানই তার লেখা। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টারের ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসারও তিনিই ছিলেন।
সিনেগল্প মুখোমুখি হয়েছিল বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করা পর্দার পেছনের এই মানুষটার। চলুন, জানা যাক এই মানুষটার ভাবনা, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে...
প্রশ্ন- প্রথমবার যখন ক্লোজআপ কাছে আসার গল্পের ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, তখন প্রথম চ্যালেঞ্জটা কী ছিল?
পুলক- প্রথমত আমরা যেটা চেয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে আগের বছর দর্শকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ গল্প আমাদের কাছে এসেছিল, তার চেয়ে অন্তত দশ পার্সেন্ট গল্প বেশি আসুক।যাতে আমাদের কাছে আরও কোয়ালিটি স্টোরি আসে এবং এজন্য টেলিভিশন কমার্শিয়ালটা এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে সেটা মানুষের মনে নাড়া দেয়৷ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আমাদেরই গল্পে একটা চমৎকার টিভিসি নির্মাণ করলেন, এবং তার ফলশ্রুতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছিল। আমাদের টার্গেট ছিল আগের বছরের চেয়ে লেখার পরিমাণ দশ পার্সেন্ট বাড়ানো, আল্লাহর রহমতে সেটা ডাবল হয়ে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় টার্গেট যেটা ছিল, সেটা হচ্ছে ফরম্যাটে পরিবর্তন আনা৷ কাছে আসার গল্পটা ধীরে ধীরে রেগুলার নাটকের মতো হয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকে আমরা ঠিক করি যে এটার দৈর্ঘ্যকে শর্টফিল্মে নামিয়ে আনব৷ সেই জায়গা থেকে আমরা ফিল্মমেকার, আরও এক্সপেরিয়েন্সড মেকার, বা ভিন্নধর্মী নির্মাতা যারা আছেন, তাদেরকে এনে ভিন্নতা আনতে চাচ্ছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় অনম বিশ্বাস, রায়হান রাফী, শঙখ দাসগুপ্ত, অমিতাভ রেজার মতো নির্মাতারা কাছে আসার গল্প নিয়ে কাজ করেছেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আমরা প্রোডাকশন ভ্যালুটা বদলে ফেলব। নানা লিমিটেশনের মধ্যে থেকে আমাদেরকে কাজ করতে হয়। কিন্তু গল্পগুলোর যথাযথ ট্রিটমেন্ট যাতে আমরা দিতে পারি, সেজন্যেই এত আয়োজন।
প্রশ্ন- ভালোবাসার গল্পে তো কমন একটা ফরম্যাট থাকে বলে মনে করেন অনেকেই। ছেলে-মেয়ের দেখা হবে, তারপর একটা স্ট্রাগল, তারপর হয়তো দুজনের মিল হবে কিংবা হবে না। সেই জায়গা থেকে বছরের পর বছর ধরে ভালোবাসার গল্প নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে কাজ করাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং?
পুলক- এটা বেশ কঠিন একটা প্রোসেস। শুধু এবছরই যে পরিমাণ গল্প এসেছে, আর যে পরিমাণ গল্প আমি পড়েছি, সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য৷ আমাদের একটা প্রাইমারি টিম থাকে, যারা গল্প পড়ে, ভালো লাগলে আমার কাছে পাঠায়। এবার আমার কাছে এরকম শ-তিনেক গল্প এসেছে, যেগুলো আমি পড়েছি।
প্রেমের গল্পের কিন্তু সুন্দর একটা ফরম্যাট আছে। প্রথম দেখা, তারপর একটা মিউচুয়াল অ্যাট্রাকশান তৈরি হওয়া, এবং সেই অ্যাট্রাকশনকে অ্যাকশনে রূপান্তর করা, মাঝখানে কোনো বাধা থাকলে সেই বাধাটা ডিঙিয়ে কাছে যাওয়া। পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের গল্পের বেসিক ফরম্যাট কিন্তু এটাই৷ আমরা খুঁজি সাবজেক্টটা ইন্টারেস্টিং কিনা, সেটা। যত ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট পাই, যত ইন্টারেস্টিং বাধা পাই, আমাদের গল্পটা তত পাওয়ারফুল হয়। যে বিশ-একুশদিন ধরে গল্প আসে, আমরা তখন পাগলের মতো গল্পগুলো পড়ি। তখন উদভ্রান্তের মতো লাগে একটা সময়ে।
প্রশ্ন- কাছে আসার গল্পের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে যে, এখানে অভিনেত্রী হিসেবে ঘুরেফিরে অল্প কয়েকটা মুখকেই দেখা যায়। অভিনেতা পরিবর্তিত হলেও, অভিনেত্রীরা খুব একটা পরিবর্তিত হন না। এই অভিযোগ কতটুকু সত্যি?
পুলক- গত চার বছরে অভিনেত্রী হিসেবে আমরা চারটা নতুন মেয়েকে ট্রাই করেছি, এবং সেগুলো ক্লিকও করেছে। কেউ কেউ আবার ক্লিক করেওনি। আমি প্রথম যেবছর কাজ করেছিলাম, ২০১৯ সালে, সেবার মনোজ প্রামাণিকের বিপরীতে সারওয়াত আজাদ বৃষ্টিকে নিয়েছিলাম। সে ছিল লাক্স সুপারস্টারের সেকেন্ড রানার আপ। ২০২০ সালে আমরা আইশা খানকে নিয়েছিলাম, যে এখন বেশ ভালো কাজ করছে। সেবছরই আমরা রা সুনেরাহ বিনতে কামালকে নিয়েছিলাম, 'ন ডরাই' রিলিজের আগেই কিন্তু তাকে নিয়ে আমরা কাজ করেছি। আমরা খাইরুল বাশারকে লঞ্চ করেছি লিড রোলে, একদম নতুন ছিল সে তখন। সাইদ জামান শাওনও কিন্তু কাছে আসার গল্প করেই জনপ্রিয় হয়েছে। এবার যেমন সুদীপ বিশ্বাস দীপ আছে, তাকেও কিন্তু নতুন বলা চলে। জুনায়েদ বোকদাদীও কিন্তু কাছে আসার গল্প দিয়েই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রতি বছরই আমাদের টার্গেট থাকে মেধাবী নতুন মুখ কাউকে তুলে আনা। কেউ কেউ ক্লিক করে যায়, কেউবা করে না।

আর গল্পের ওপরও তো অনেককিছু ডিপেন্ড করে। গল্পটা কেমন পাচ্ছি, গল্পের ওপরেও অভিনেতা বা অভিনেত্রীর পারফরম্যান্সের ভালো-মন্দ খানিকটা নির্ভর করে। বিষয়টা এমন না যে আমরা ঘুরেফিরে অল্প কয়েকজনকেই বারবার কাস্ট করি। টয়া কিন্তু ২০১৯-২০ এ ছিল না। ২০২১-২২ এ সে আছে। সাফা গত বছর ছিল নাক্স এবছর আছে। এই নতুনত্বটাই আমাদেরকে আলাদা করেছে অন্যান্য প্রোডাকশন থেকে।
প্রশ্ন- আরেকটা জিনিস, কাছে আসার গল্পে পরিচালক হিসেবে আমরা বরাবর পুরুষদেরকেই পেয়ে আসছি৷ নারী পরিচালকদের কেন এখানে দেখা যায় না। ভালোবাসার গল্প বলার অধিকার তো তাদেরও আছে।
পুলক- খুবই ভালো প্রশ্ন। আমাদের এবারের তিন ডিরেক্টরের একজন কিন্তু মেয়ে৷ রাকা নওশীন নায়ার, ও কিন্তু নারী। আমরা কিন্তু নারী-পুরুষ ভেদাভেদ করি না। এবছর এই প্রোডাকশনটা নামানোর সামর্থ্য যার আছে বলে মনে হয়, আমরা তার শরপণাপণ্ণ হই৷ এখানে কিন্তু সময়ের একটা ব্যাপার আছে, অভিজ্ঞতাও একটা বড় ফ্যাক্টর। অনেক কিছু চিন্তা করেই ডিরেক্টরের ব্যাপারটায় আমরা হাত দেই। এবারের ডিরেক্টর প্যানেল কিন্তু আমাদের কাছে আসার গল্পের ইতিহাসেরই সবচেয়ে ভিন্নধর্মী পরিচালক প্যানেল। আবার গত বছরের কাছে আসার গল্পের যে তিনটা টিভিসি বানানো হয়েছিল, সেগুলোর নির্মাতা ছিলেন একজন নারী। এই অভিযোগগুলো তাই ভিত্তিহীন বলেই মনে করি আমি।
ছোট ফরম্যাটের কন্টেন্ট নির্মাণে আমাদের দেশে ভালো মানের পরিচালকই আছেন অল্প কয়েকজন। টিভিসি বা সিনেমার ভালো নির্মাতা অনেক আছেন, কিন্তু পঁচিশ মিনিটে একটা প্রেমের গল্প বলার মতো ডিরেক্টরের সংখ্যা কম। নারী ডিরেক্টরের সংখ্যা আরও কম। সাবরিনা এবং রাকা দুজনকেই আমরা এপ্রোচ করেছিলাম। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সাবরিনা করতে পারেননি এবার, রাকা করছেন।
প্রশ্ন- বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি আপনি একজন কবি, গানও লেখেন। কাছে আসার গল্পের গত তিন সিজনের নয়টি গান আপনার লেখা। গান লেখার সময় কোন বিষয়টিকে প্রাধাণ্য দেন আপনি?
পুলক- আমি আসলে ক্যাম্পেইনের থিম লক হওয়ার পরে গান লিখি। এধরণের গানগুলো লিখতে আমার খুব বেশি সময় লাগে না। ক্যাম্পেইনের থিমটা জানার কারণেই সময়টা কম লাগে।
নিজেকে কোন পরিচয়ে দেখতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে? গীতিকার, কবি, নাকি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী?
পুলক- আমি দুপুর বারোটার দিকে অফিসে ঢুকি। তখন থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আমি বিজ্ঞাপনকর্মী। রাত দশটা থেকে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত আমি কবি। কবি হিসেবে আমার এক ধরণের সামাজিক পরিচয় আছে, সেটা আমি উপভোগ করি। যারা আমাকে কবি মনে করেন, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। নিজেকে নিজে কবি বললে তো কবি হবো না আমি, আমাকে মানুষের কবি বলতে হবে।
প্রশ্ন- যে মানুষটা এত বছর ধরে কাছে আসার গল্পের মতো একটা প্রোজেক্টের সাথে জড়িত আছেন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে, তার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী? ভালোবাসা আগে কেমন ছিল, আর এখন কেমন হয়েছে? ভবিষ্যতে কেমন হতে পারে?
পুলক- ভালোবাসা চিরকালই আমার কাছে আশ্রয়। ভালোবাসা মানে ভালো থাকা, ভালোবাসা মানে ভালো রাখা। ভালোবাসা গতকালও আশ্রয় ছিল, ভালোবাসা আজও আশ্রয়, আগামীকালও আশ্রয় থাকবে। আমাদের যখন মন ভালো হয়, যখন মন খারাপ হয়, যখন মন কেমন কেমন করে, অথবা যখনই আমাদের মন উচাটন করে, যখনই মন বেদনায় কাতর হয়, সুখে আপ্লুত হয়, আমরা বারবার ভালোবাসার কাছেই ছুটে যাই, ভালোবাসার মানুষটার কাছেই ফিরে যাই। ভালোবাসাকে এক বাক্যে ব্যাখ্যা করাটা খুব মুশকিল।
ভালোবাসা আসলেই আশ্রয়, চিরকালই আশ্রয় ছিল। আজ থেকে একশো বছর আগে যে প্রেমিক প্রেমিকাটি ভালোবেসে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এজন্যেই নিয়েছিল কারণ তারা একে অন্যের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। ১৯৮০ সালেও তাই, ১৯৯০ সালেও তাই, ২০০০ সালেও তাই, এই দুই হাজার বাইশেও তাই। ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গিটা হয়তো বদলেছে, ভালোবাসা হয়তো তার রূপ বদলেছে, কিন্তু ভালোবাসা কখনও ধরণ বদলায়নি। ভালোবাসা কখনও তার ধর্ম বদলায়নি। ভালোবাসা সবসময় একই রকম, আশ্রয়। আশ্রয় খুঁজে পায় বলেই মানুষ অন্যের কাঁধে মাথা রাখে। অন্যের বুকে মাথা রাখে।