'ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম' নিয়ে মাস্টওয়াচ পাঁচটি সিনেমা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সময়ের নানা প্রকোষ্ঠে নির্মিত এ চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী ভিন্ন, ধরণ ভিন্ন, বিষয়বৈচিত্র্য ভিন্ন। তবুও মূল সুরে এসে এই পাঁচটি সিনেমাই এক পথের পথিক। সেই সুর; সত্যের অনুসন্ধান...
'ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম' নিয়ে সম্প্রতি বেশ তোলপাড় হচ্ছে দেশে। একটা সময়ে সংবাদ ও সংবাদপত্র ছিলো কোনো একটি দেশের জন্যে সবচেয়ে বড় সম্পদ। কালের বিবর্তনে সমাজ-বৃক্ষের নানা শাখাপ্রশাখার মতন পচন ধরেছে এখানেও। জর্জ অরওয়েলের '১৯৮৪' বইতে যেমন ছিলো, মিডিয়াকে কন্ট্রোল করতে পারলেই কন্ট্রোলে থাকবে মানুষ; আজকাল এ নির্জলা সত্যেরই বাস্তবায়ন দেখি আশেপাশে। তবুও কালে কালে দেশে দেশে সাহসী সাংবাদিকের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিলো না। সেরকমই কিছু সাহসী সাংবাদিক এবং তাদের রুদ্ধশ্বাস সাংবাদিকতার গল্পে ভিত্তি করে নির্মিত পাঁচ সিনেমা নিয়ে আজকের কলম-যাত্রা।
1. Spotlight
'ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম' জনরার সিনেমা নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে 'স্পটলাইট' সিনেমার কথা। টম ম্যাককার্থির এই সিনেমাটা এই জনরার বাকি সব সিনেমার চেয়ে এক আলাদা বেঞ্চমার্কে আসীন হয়ে রয়েছে অনেকদিন ধরে৷ সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত অস্কারজয়ী এই সিনেমায় আমরা দেখি 'বোস্টন গ্লোব' নিউজপেপারের সাংবাদিকদের এক স্পেশাল টিমকে, যাদের ডাকা হয় 'স্পটলাইট' নামে। এই 'স্পটলাইট' দুর্দান্ত এক অনুসন্ধান করে ক্যাথলিক চার্চের 'ধর্ম-ধার্মিক-পবিত্রতা'র আড়ালে হওয়া অমানবিক 'শিশু নির্যাতন'কে নিয়ে আসে সামনে। পুরো আমেরিকা কেঁপে ওঠে এই সংবাদের ভয়ঙ্কর সত্যতায়।

'কেঁচো খুড়তে কেউটে' বাগধারার যেন সার্থক এক মঞ্চায়ন এই সিনেমা। খুব ছোট একটা ঘটনার রেশ ধরে 'স্পটলাইট' টিম পৌঁছে যায় এমন বীভৎস সত্যের সামনে, যা নিয়ে কেউ কোনোদিন কথা তো বলেইনি, বরং বড় বড় শক্তি একত্রিত হয়ে বহুদিন দমিয়ে রেখেছে এ সত্যকে। টিম 'স্পটলাইট' শুরু করে বহু পুরোনো অতীতকে তুলে জনসম্মুখে নিয়ে আসার এক প্রায় অসম্ভব কাজ। যখন অসম্ভবকে তারা সম্ভব করে ফেলে, তখন যে সত্য বের হয় আসে, সে সত্য এমনই ভয়ঙ্কর, ধর্ম-রাজনীতি-আদর্শ-বিশ্বাস সবকিছু একসাথে টলে ওঠে যেন!
এই সিনেমার চমৎকারিত্বের দিক অনেক। অভিনেতারা প্রায় সবাই-ই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন৷ ২০১৬ সালের অস্কারজয়ী ফিল্ম তো হয়েছেই, সে সাথে রোলারকোস্টার স্ক্রিনপ্লে'র জন্যেও অস্কার পেয়েছে 'স্পটলাইট।' মানবিকতা-অমানবিকতা, সত্য-মিথ্যা, আলো-আঁধার...প্রতিকূল অনুষঙ্গের দ্বন্ধমুখর বাস্তবতা নিয়ে এরকম সিনেমা খুব কমই হয়েছে হলিউডে।
2. The Insider
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমার সময়কাল ১৯৯৯ হলেও বর্তমানে দাঁড়িয়ে এ সিনেমার গল্প সে সময়ের চেয়েও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবিক। গুড জার্নালিজম-ব্যাড জার্নালিজম, কর্পোরেট ম্যালফাংশনিং, মোরালিটি ভার্সেস করাপশন এর ভিন্ন ভিন্ন ডেফিনিশন নিয়ে কমপ্লিট এক গল্প 'দ্য ইনসাইডার।'
সিনেমার শুরুতেই আমরা দেখতে পাই জেফ্রি ওয়াইগান্ড (রাসেল ক্রো)কে যিনি “বি এণ্ড ডব্লিউ” নামের একটি টোব্যাকো কোম্পানিতে বেশ উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, এবং যিনি সদ্য চাকরীচ্যুত। তার সাথে একদিন পরিচয় হয় লোয়েস বার্গম্যান (আল পাচিনো) এর সাথে, যিনি সিবিসি নামক একটি টিভি চ্যানেলের বিখ্যাত টকশো ‘”সিক্সটি মিনিটস” এর প্রোডিউসার এবং এডিটর।

বার্গম্যান চান, ওয়াইগান্ড তার টকশোতে আসুক এবং তার কোম্পানির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলুক৷ কিন্তু ওয়াইগান্ড আসতে চান না৷ কারণ তাকে বলা হয়েছে, কোম্পানির ভেতরের কোনো তথ্য যদি সে বাইরে বলে, তাহলে মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে তাকে। কী করবে ওয়াইগান্ড? আপোষ নাকি বিদ্রোহ?
এ সিনেমা অনেকগুলো কারণে ভালো লাগতে বাধ্য। সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় আল পাচিনো, রাসেল ক্রো'র অসাধারণ অভিনয় আসবে প্রথমেই। সে সাথে মাইকেল মান এর দুর্দান্ত পরিচালনা৷ সীমাহীন লোভ, মাত্রাহীন দুর্নীতি, বেশুমার অন্যায়, সেগুলো ঢাকতে কর্পোরেট টাইকুনদের ক্লেদাক্ত অবয়বের প্রকাশ আর বিপরীতে সাহসী সাংবাদিকতার এক জমাটি সত্য আখ্যান যে নৈপুণ্যে পরিচালক তুলে এনেছেন পর্দায়, তা এককথায় ব্রিলিয়ান্ট।
3. All the President's Men
এই টাইটেল দেখে অনেকেরই হয়তো বেশ ক'মাস আগে আল জাজিরার একটি আলোচিত ডকুমেন্টারির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়া স্বাভাবিকও। দুটি নামের মধ্যে নব্বই শতাংশ মিল। না, আল জাজিরা মোটেও নামটির আইডিয়া কপি করেনি এই সিনেমা থেকে। বরং তারা যেটা করেছে, সেটিকে সুন্দর বাংলায় 'অনুপ্রেরণা' বলে। তারা অনুপ্রেরিত হয়েছে এই টাইটেল থেকে।
সিনেমার গল্পে আসি। এ সিনেমাও সত্যঘটনা অবলম্বনে৷ প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এর ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি'র কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পরে ১৯৭৪ সালে নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু সেই পদত্যাগের আড়ালে থাকে একটি মিথ্যে গল্প। একদল সাংবাদিক মিলে সেই মিথ্যে গল্পের সমাপ্তি থেকেই শুরু করে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানের কাজ। এবং সে কাজটি করতে গিয়ে মৃত্যুমুখেও পড়তে হয় সাংবাদিকদের। এবং শেষপর্যন্ত যখন তাদের নিগূঢ় অনুসন্ধানের এ সংবাদটি প্রকাশিত হয়, আমেরিকার প্রশাসনযন্ত্রের ভিত্তিভূমি নড়ে যায়!

সিনেমায় বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন... 'দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট' এর এই দুই সাংবাদিক চরিত্রে দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছিলেন রবার্ড রেডফোর্ড এবং ডাস্টিন হফম্যান। সে সাথে টানটান স্ক্রিনপ্লে এবং অ্যালান জে পাকুলার দুর্দান্ত ডিরেকশন। সবমিলিয়ে মাস্টওয়াচ এক সিনেমা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ১৯৭৬ সালের সেই সিনেমাটি আজও বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক ও বাস্তব! সময় পাল্টায়, পালটায় না দাবার বোর্ডের ঘুঁটি।
4. State of Play
মূল গল্প বলার আগে এই সিনেমার প্রস্তুতিপর্বের একটা গল্প জানাই আগে। সিনেমার 'পারফেকশন' এর জন্যে পরিচালক কেভিন ম্যাকডোনাল্ড, 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এর এক সাংবাদিককে নিয়ে এসেছিলেন সিনেমার সেটে। যে কয়দিন সিনেমার শুটিং চলেছে, এই সাংবাদিক ভদ্রলোক হাতেকলমে টেকনিক্যাল বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা দিয়েছে পুরো টিমকে, সেভাবেই এগিয়েছে পুরো সিনেমা। ঠিক এ কারণেই, সিনেমার অসাধারণত্ব, নিখুঁতত্ব এবং স্বকীয়তা বেড়েছে বহুগুণে।
গল্পে আসি। এক কংগ্রেসম্যানের মিস্ট্রেস এর মৃত্যুর পরে সেই মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন সাংবাদিক ক্যাল ম্যাকাফ্রি। সেই মৃত্যুর সাথে তিনি যোগসূত্র ঘটান আরো কিছু মৃত্যুর। এবং এমন এক 'ব্রেক-থ্রু' পান তিনি, যা যেকোনো সাংবাদিকের জন্যে জ্যাকপট পাওয়ার সমান৷ তিনি নেমে পড়েন তদন্তে। কিন্তু যতই সামনে যেতে থাকেন, পেতে থাকেন একের পর এক প্রতিবন্ধকতা। গল্প মোচড় খায় তখনই।

বেন অ্যাফ্লেক, রাসেল ক্রো, র্যাচেল ম্যাকঅ্যাডামস দারুণ অভিনয় করেছেন পুরো সিনেমা তে। তাদের অভিনয়ের পাশাপাশি দারুণ ছিলো এই সিনেমার স্ক্রিপ্টও। টনি গিলোরি, বিলি রে এবং ম্যাথু মাইকেল মিলে যে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, সেই স্ক্রিপ্ট শেষপর্যন্ত ধরে রেখেছে সাসপেন্স। এবং শেষের টুইস্ট, এককথায় অনবদ্য। সে সাথে সিনেম্যাটোগ্রাফী এবং দারুন থমথমে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর...পিওর টপ নচ৷ এই অনুষঙ্গগুলো খুব চমৎকারভাবে ব্লেন্ড হয়েছে সিনেমার গল্পের সাথে। আল্টিমেটলি 'স্টেট অব প্লে' হয়ে দাঁড়িয়েছে 'ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম' নিয়ে খুব দুর্দান্ত এক ফিকশনাল স্টোরি বেজড মুভি'তে।
মাস্টওয়াচ!
5. A Taxi Driver
আশির দশকের কোরিয়ার এক ছোট্ট শহর গোয়াঞ্জো৷ সেখানে প্রশাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মুক্তিকামী কিছু মানুষ৷ রাষ্ট্রযন্ত্র বন্দুক হাতে পাখির মত মানুষ মারে সেখানে। এই ভয়াল রক্তাক্ত ম্যাসাকার পরিচিত হয় 'গোয়াঞ্জো ইন্সিডেন্ট' নামে। পুরো দেশ থেকে আলাদা করা হয় এই এলাকাটিকে৷ সাংবাদিকরা কেউই সেখানে ঢোকার অনুমতি পায় না। সবকিছু বন্ধ রেখে মানুষ মারার নেশায় মেতে ওঠে দেশের হর্তাকর্তা বিধাতারা।
যখন এক জার্মান সাংবাদিক এই ঘটনার সন্ধান পান, তিনি চলে আসেন কোরিয়াতে। কিন্তু কিভাবে যাবেন সেখানে? সব রাস্তাই তো বন্ধ। বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে এক ড্রাইভারকে নিয়ে দুর্গম পথ পেরিয়ে যান গোয়াঞ্জো'তে। কভার করেন স্টোরি৷ কিন্তু ফেরার পথেই তিনি চোখে পড়ে যান ঘাতকদের। এরপর?

এই সিনেমা ভালো লেগেছে অনেকগুলো কারণে৷ সিনেমার মূলগল্প তো অনেকটাই ইন্টারেস্টিং। সে সাথে সিনেমায় কং হো সং (এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ট্যাক্সি ড্রাইভার) এবং থমাস ক্রেটসম্যান (জার্মান সাংবাদিক) এর রসায়নটাও হয়ে রইলো অনবদ্য৷ তাদের কমেডি, হিউমার, সাসপেন্স, ক্রাইসিস... সব ফুটে উঠলো ধাপে ধাপে। পর্যায়ক্রমে। খুবই সাবলীলভাবে।
সিনেমা যখন শেষ হলো, তখন মন ভরে উঠলো অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে। কেন এ প্রশান্তি, তা জানতে হলে এ সিনেমা দেখতে হবে। সাংবাদিকতার জন্যে কতটা যে ত্যাগ স্বীকার করা যেতে পারে এবং সাংবাদিকতার যে কোনো কাঁটাতার থাকা উচিত না, সেটারও বেশ অনবদ্য এক চিত্রায়ণ হয়ে রইলো 'এ ট্যাক্সি ড্রাইভার।'
সময়ের নানা প্রকোষ্ঠে নির্মিত এ চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী ভিন্ন, ধরণ ভিন্ন, বিষয়বৈচিত্র্য ভিন্ন। তবুও মূল সুরে এসে এই পাঁচটি সিনেমাই এক পথের পথিক। সেই সুর; সত্য অনুসন্ধান। এই সিনেমাগুলো দেখলে অন্য অনেককিছুর পাশাপাশি বেড়ে যাবে নিজেদের বিবেকের দায়ও। সেখানেই এই সিনেমাগুলো সার্থক। এবং ঠিক এজন্যেই দেখা উচিত এ পাঁচটি নির্মান!