যদি কেউ 'আয়রন-ম্যান' এর প্রথম কিস্তি লক্ষ্য করেন, দেখবেন- 'টনি স্টার্ক' পার্টিতে পার্টিতে ঘুরছেন, অল্প সময়ের পরিচয়েই কাউকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছেন, মদ্যপ হয়ে ভাংচুর করছেন। যিনি নিজেকে 'প্লেবয়' হিসেবেও গর্বের সাথে প্রচার করছেন! সেই প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব মানুষটি সময়ের ফেরে যেভাবে নিজেকে পাল্টেছেন, হয়েছেন বাকি সব 'অ্যাভেঞ্জারস' এর অভিভাবক, তা বিস্ময়কর। এবং শুধুমাত্র এই একটি কারণেই যদি মার্ভেলের সুপারহিরোদের মধ্যে আয়রন ম্যানকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়, তা মোটেও অত্যুক্তি হবে না!

'মার্ভেল স্টুডিওস' তখন 'আয়রন-ম্যান'কে পর্দায় আনার চিন্তাভাবনা করছে। যদিও 'আয়রন-ম্যান' চরিত্রে কে অভিনয় করবে, তা নিয়ে চিন্তা আছে বিস্তর। চাপা ফিসফিস রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে ঘিরে। কিন্তু রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে এ সিনেমায় নিলে যে সমূহ বিপদ হতে পারে, সে সংশয়ও ঠিক উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।  কারণ, 'রবার্ট' এর ড্রাগস-সংক্রান্ত কিসসা-কাহিনি তখন মানুষের মুখে মুখে। এরকম এক নিন্দিত মানুষকে 'সুপারহিরো' চরিত্রে নিলে সে চরিত্র কতটুকু জনপ্রিয় হবে, কতটুকুই বা সমালোচিত হবে- তা নিয়ে দোটানার কালো মেঘ ছিলো। থাকাটা স্বাভাবিকও। কিন্তু তবুও শেষমেশ 'মার্ভেল স্টুডিওস' ঝুঁকি নিলো। 'রবার্ট ডাউনি জুনিয়র' এলেন 'আয়রন ম্যান' হয়ে। এবং এরপর যা হলো, তা প্রত্যেকেরই জানা৷ এই চরিত্রে নিজের সর্বস্ব এমনভাবে ঢেলে দিলেন রবার্ট জুনিয়র,  'আয়রন-ম্যান' কিংবা 'টনি স্টার্ক' যেন একবিন্দুতেই মিলে গেলো 'রবার্ট ডাউনি জুনিয়র' এর সাথে। সমস্ত বিভেদরেখা ধুয়েমুছে গেলো চমৎকারিত্বের জলে। 

'ডিসি কমিকস' এবং 'মার্ভেল কমিকস' এর চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দ্বৈরথ সবসময়েই থাকে৷ 'ওয়ার্নার ব্রোস' এবং 'মার্ভেল স্টুডিওস' এর মধ্যেও থাকা চাপা রেষারেষি। 'জাস্টিস লীগ' ভালো নাকি 'অ্যাভেঞ্জারস'... তুমুল রশি টানাটানি চলে তা নিয়েও। তবে এসবের পাশাপাশি নিজ নিজ শিবিরের অভ্যন্তরেও চলে নানা যোগ বিয়োগ। 'অ্যাভেঞ্জারস'দের যে এই টিম, এখানে কে সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাভেঞ্জার... তা নিয়েও ওঠে নানারকম প্রশ্ন। এবং এই প্রশ্ন এলে 'খোদ মারভেল ভক্ত'রাও পৃথক হয়ে অবস্থান নেন নানামুখী শিবিরে৷ মূলত থর, ক্যাপ্টেন আমেরিকা কিংবা আয়রন-ম্যানের মধ্যেই চলে প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে এটাও ঠিক, শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ সূচকে 'আয়রন-ম্যান'কেই রাখেন অধিকাংশ মানুষ। কেন রাখেন, সেটাই মূলত আজকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। কেন 'আয়রন-ম্যান'ই সবাইকে ছাপিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষস্থানে? তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণও বা কি? নানাবিধ প্রশ্ন। সেগুলোর উত্তর? আসুন, খুঁজে দেখি। 

প্রথমত, যদি অন্যান্য সুপারহিরোর সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে 'আয়রন-ম্যান' খানিকটা স্বকীয় অবয়বেই হাজির হবেন সামনে। ঈশ্বর-পুত্র 'থর' কিংবা সুপার সোলজার সেরামে রূপান্তরিত 'ক্যাপ্টেন আমেরিকা'কে যেমন বাস্তবের সাথে মেলাতে খানিকটা কষ্টকল্পনা হয়, বিলিওনিয়ার টনি স্টার্ক ওরফে 'আয়রন-ম্যান' এর পোর্ট্রেয়াল সেদিক থেকে খুবই বাস্তব। বিলিওনিয়ার একজন মানুষ, যার অঢেল অর্থবিত্ত, যিনি নিজেই প্রযুক্তির সাথে সময় কাটিয়ে কাটিয়ে, প্রযুক্তির বদান্যতায় রূপান্তরিত হচ্ছেন ভারী বর্মের আড়ালের 'আয়রন-ম্যান' এ, এটা ভাবাটা মোটেও দুরূহ কিছু না৷ 'ডিসি কমিকস' এর ব্যাটম্যান ওরফে ব্রুস ওয়েনের মতই তিনিও অঢেল সম্পদশালী। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, 'আয়রন-ম্যান', 'ব্যাটম্যান' এর মতই জ্বলজ্যান্ত এক মানুষ৷ সেই মানুষই যখন প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের কল্যানে করছেন একের পর এক অসাধ্যসাধন, সেটার পোর্ট্রেয়ালের জন্যেই 'আয়রন-ম্যান' হয়ে যাচ্ছেন সবার খুব কাছের সুপারহিরো। যে সুপারহিরোর জন্যে সমীহ যেমন জাগে, জাগে ভালোবাসাও।

দ্বিতীয়ত, টনি স্টার্ক থেকে 'আয়রন-ম্যান' হওয়ার ট্রান্সফর্মেশন৷ যদি কেউ 'আয়রন-ম্যান' এর প্রথম কিস্তি লক্ষ্য করেন, দেখবেন- 'টনি স্টার্ক' পার্টিতে পার্টিতে ঘুরছেন, অল্প সময়ের পরিচয়েই কাউকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছেন, মদ্যপ হয়ে ভাংচুর করছেন। যিনি নিজেকে 'প্লেবয়' হিসেবেও গর্বের সাথে প্রচার করছেন! সেই প্রচণ্ড আত্মকেন্দ্রিক ইন্দ্রিয়সর্বস্ব মানুষটি সময়ের ফেরে যেভাবে নিজেকে পাল্টেছেন, হয়েছেন বাকি সব 'অ্যাভেঞ্জারস' এর অভিভাবক, তা বিস্ময়কর। মুগ্ধকরও।

তিনি 'অ্যাভেঞ্জারস'দের বাঁচাতে গিয়ে বহুবারই হয়েছেন মৃত্যুর মুখোমুখি। কার্পণ্য করেননি। বিশেষ করে মনে পড়ছে 'অ্যাভেঞ্জারসঃ এজ অব আলট্রন' এর বিশেষ এক দৃশ্যের কথা, যেখানে ওয়ান্ডা ম্যাক্সিমঅফ নামের এক চরিত্রের বরাতে আমরা জানতে পারি, টনি স্টার্ক তার বন্ধুদের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত থাকেন পুরোটা সময়ে। তার চিন্তাভাবনার পুরোটাজুড়েই থাকে তার সহকর্মী এবং বন্ধুরা। এবং এই চিন্তার নজিরই পরবর্তীতে পাই, যখন বন্ধুদের নিরাপত্তার জন্যে 'অ্যাভেঞ্জারসঃ এন্ডগেম' এ নিজের প্রাণই উৎসর্গ করেন তিনি। এবার, এই যে ট্রান্সফরমেশন, নার্সিসিস্ট এক লোফার থেকে সেল্ফলেস এক সুপারহিরো... এই ট্রান্সফরমেশনটা হয়েছে খুব কম সুপারহিরোর ক্ষেত্রেই। 'আয়রন-ম্যান' এর উৎকর্ষের কিংবা জনপ্রিয়তার এও এক কারণ! 

নিঃস্বার্থ আয়রন-ম্যান! 

তৃতীয়ত, 'টনি স্টার্ক' বরাবরই সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতেন। এই যে দলনেতা হয়ে সবাইকে একাট্টা করে রাখা, এটাও 'আয়রন-ম্যান' এর অন্যতম এক ইউএসপি! আয়রন-ম্যান শুধু যে সবাইকে দলবদ্ধ করে রাখতেন, তাও না,  টীম-মেম্বারদের সুবিধার জন্যে নিবেদিতও রাখতেন নিজেকে। অ্যাভেঞ্জারসদের নানাবিধ টেক-গ্যাজেটস বানিয়ে দিতেন তিনি। 'স্পাইডারম্যান' এর স্যুট কিংবা 'হাল্কবাস্টার'ও তারই বানানো। 'টাইম ট্রাভেল' এর গেরোটাও প্রথমবার ধরা পড়েছিলো তার চোখেই। এবং সেটা জানানোর পরেই থর এবং ক্যাপ্টেন আমেরিকা বিষয়টা নিয়ে হয়েছিলেন উদ্যোগী৷ 'ক্রেডিট' নেওয়ার চিন্তা না, বরং প্রকৃত একজন নেতার মত 'টিম অ্যাভেঞ্জারস' এর দেখভালেই পুরোটা সময়ে মনোযোগী থাকতেন আয়রন-ম্যান। 

চতুর্থত, 'আয়রন-ম্যান' চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে কাস্ট করা। প্রথমেই লিখেছি, 'মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স' এর শুরুতেই এই ঝুঁকি ছিলো বেশ মারাত্মক। কিন্তু 'মার্ভেল স্টুডিওস' এই ঝুঁকি নিয়ে শুধু যে জিতেছেই তা না, 'আয়রন-ম্যান' চরিত্রে এমন একজনকে পেয়েছে, যে কিছুক্ষেত্রে নির্ধারণ করে দিয়েছে 'এমসিইউ' এর ভাগ্যও৷ এরকম বৈচিত্র্যময় 'আয়রন-ম্যান' না থাকলে, 'মার্ভেল স্টুডিওস' এর জৌলুশ যে অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতো, তা বলাই বাহুল্য। এবং যেভাবে এ চরিত্রে অভিনয় রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের, এরকম 'ফান-সারকাজম-সিরিয়াসনেস' এর পারফেক্ট মিশেলটাও বা দিতে পারতো ক'জন, প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া, যে সময়ে 'আয়রন-ম্যান' আসে পর্দায়, সে সময়ে নানা কেলেঙ্কারিতে এমনিতেও রবার্ট ডাউনি জুনিয়র নাজেহাল, আবার, পর্দার টনি স্টার্কেরও কুৎসা কিংবা কিসসা কম না মোটেও... বাস্তবের সাথে পর্দার এরকম যুগপৎ মেলবন্ধনে কখন যে চরিত্র আর চরিত্রের অভিনেতা মিলেমিশে হয়েছেন লীন... সেটাও বিস্ময়কর!  

'অ্যাভেঞ্জারস'দের দলনেতাও তিনি! 

এসব ছাড়া আরো কিছু ছোটখাটো বিষয়ও আছে, যেসব 'আয়রন ম্যান' এর শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষেই সাফাইসাক্ষী দেবে। বলা যেতে পারে- ডক্টর স্ট্রেঞ্জকে বাঁচানো,  'নিউক্লিয়ার মিসাইল' কে রুখে দেয়া কিংবা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ভিলেনের মুখোমুখি হওয়ার সাহসের কথাও৷ কিন্তু এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মূলত একজন মানুষের বিবর্তনের সমীকরণ! বিবর্তিত হয়ে যে মানুষটি 'শূন্য' থেকে পৌঁছেছেন 'শতক' এ। বিশাল ক্ষমতা থাকা না সত্বেও মানুষের জন্যে ভালোবাসা ও বন্ধুদের জন্যে টান যাকে বানিয়েছে সবার প্রিয় চরিত্রে। যে চরিত্র সময়ের ফেরে পরিণত হয়েছে এমন এক কিংবদন্তিতে, রক্তমাংসের মানুষ হওয়া সত্বেও নিজের গণ্ডিকে যিনি নিয়ে গিয়েছেন এমনই এক ধরাছোঁয়া সীমানার বাইরে, সে মানুষটির জন্যে মূলত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকাটাই সমীচীন। এবং এই ভালোবাসাই মূলত তাকে রূপান্তরিত করেছে সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যাভেঞ্জার এ। অন্যতম শ্রেষ্ঠ 'সুপারহিরো'তে। সেটাই মূলত 'আয়রন-ম্যান' এর শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা