এর মধ্যে কোনোটি কি মিস গেছে আপনার?

বেঁচে থাকলে গত জানুয়ারীতে ৫৪তম জন্মদিনের কেকটা কাটতেন ইরফান, সঙ্গে থাকতেন স্ত্রী সুতপা এবং দুই ছেলে। জন্মদিন নিয়ে আদিখ্যেতা পছন্দ ছিল না তার, তবে প্রিয় বন্ধু তিগমানশু ধুলিয়া নিশ্চয়ই নিমন্ত্রণ পেতেন সেই ঘরোয়া আড্ডায়। থাকতেন আরও কয়েকজন কাছের মানুষ। গল্পটা এমন হলেও হতে পারতো। কিন্ত হয়নি, আর কখনও হবেও না। গত বছরের এই দিনে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত ইরফান পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে, আচমকা, কোন আগাম সংকেত না দিয়েই হারিয়েছেন অদেখা ভুবনে। 

জীবদ্দশায় একশোর বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ইরফান, বলিউড ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছেন হলিউডেও, নিয়মিত তাকে দেখা গেছে সেখানকার সিনেমায়। পাশাপাশি ভারতেই আলাদা আলাদা কয়েকটা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা করেছেন ইরফান, তামিল-তেলুগু সিনেমাতেও রেখেছে দুর্দান্ত অভিনয় প্রতিভার প্রমাণ। ১৯৮৮ সালে 'সালাম বোম্বে!' সিনেমা দিয়ে যে জার্নিটা শুরু হয়েছিল, ২০২০ সালে 'অ্যাংরেজি মিডিয়াম' দিয়ে সেটা শেষ হয়েছে। মাঝের এই পথটায় তিনি জিতেছেন ফিল্মফেয়ার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, অভিনয়ে অবদানের জন্য পেয়েছেন পদ্মশ্রী খেতাবও। 

এই লেখায় যে পাঁচটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হবে, সেগুলোকে ইরফানের ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচটি সিনেমা ভাবলে ভুল করবেন। সেরার কোন মানদণ্ড নেই আসলে। বরং আমরা চেষ্টা করেছি, গল্প, নির্মাণ এবং পর্দায় ইরফানের উপস্থিতি, তার চরিত্রের প্রভাব- সবকিছু মিলিয়ে ইরফানের ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য পাঁচটি সিনেমা বেছে নেয়ার। সেই চেষ্টাতেও যে আমরা পুরোপুরি সফল হয়েছি, এমন দাবী করব না, এই তালিকা নিয়েও অসন্তোষ থাকতে পারে, দ্বিমত থাকতে পারে। আপনাদের কাছ থেকে গঠনমূলক সমালোচনা সবসময়ই কাম্য। 

মকবুল (২০০৪)

শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটিকা ম্যাকবেথের হিন্দি অ্যাডাপশন নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন পরিচালক বিশাল ভরদ্বাজ, সিনেমার নাম মকবুল। কেন্দ্রীয় চরিত্র মিয়া মকবুল হিসেবে বিশাল বেছে নিলেন ইরফানকে। আর ইরফানও নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সটা ঢেলে দিয়েছিলেন এই চরিত্রে, করেছিলেন দুর্ধর্ষ অভিনয়। এত ভয়ংকরভাবে তিনি মুসলিম আন্ডারগ্রাউন্ড ডনের চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন মকবুলে, শেক্সপীয়ার বেঁচে থাকলে তার পারফরম্যান্স দেখে হয়তো ম্যাকবেথের জন্যেই ইরফানকেই কাস্ট করতেন তিনি! নাসিরউদ্দিন শাহ, ওম পুরি, পঙ্কজ কাপুর বা টাবুর মতো দুর্দান্ত অভিনেতারা ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন এক ইরফানের সামনে, মকবুল সিনেমায় এতটাই প্রভাবশালী ছিল তার বিচরণ!

মিয়া মকবুলের চরিত্রে দুর্ধর্ষ অভিনয় করেছিলেন ইরফান

দ্য নেমসেক (২০০৬)

মীরা নায়ারের পরিচালিত এই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। বাঙালি এক পিতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি, চরিত্রের নাম ছিল অশোক গাঙ্গুলী। সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত আর জীবনের নিশ্চয়তার আশায় যে মানুষটা পরিবার নিয়ে ভারত ছেড়ে আমেরিকায় থিতু হবার চেষ্টা করছেন, কিন্ত প্রতিটা মুহূর্তে তাকে নতুন দেশ, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার সংগ্রাম করতে হয়। 

দ্য নেমসেক সিনেমায় ইরফান ও টাবু

অশোক গাঙ্গুলীর মধ্যে আমরা যেন চিরাচরিত উপমহাদেশীয় বাবাদেরকেই খুঁজে পাই, সন্তানদের জন্য যিনি নিজের সুখ, স্বপ্ন সবকিছু একপাশে সরিয়ে রাখেন। যে মানুষটা বই পড়তে পছন্দ করেন ভীষণ, যার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে মাথা উঁচু করে বাঁচার সাধ, নিজের নামে বুক ফুলিয়ে বাঁচার তীব্র ইচ্ছে। ইরফানের বিপরীতে এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন টাবু। সমালোচকদের কাছ থেকে দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল দ্য নেমসেক। 

পান সিং টোমার (২০১২) 

ভারতে তখনও গণ্ডায় গণ্ডায় স্পোর্টস বায়োপিক বানানো শুরু হয়নি। সেই ২০১২ সালে ইরফান অভিনয় করেছিলেন স্বর্ণজয়ী অ্যাথলেট এবং সেনা সদস্য থেকে আচমকা দস্যু বনে যাওয়া পান সিংয়ের চরিত্রে। সত্যিকার ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল এই সিনেমাটা, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত কীভাবে একজন নিরীহ গোবেচারা গোছের সহজ-সরল মানুষকে ডাকাত হতে বাধ্য করে, সিস্টেম যখন একজন অসহায়ের গলা চেপে ধরে চারপাশ থেকে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সেই অসহায় মানুষটাই কি দুর্ধর্ষ হিয়ে উঠতে পারে, পান সিং টোমার যেন সেটারই প্রামাণ্য দলিল। 

ইরফান যখন ডাকু পান সিং টোমার

এই সিনেমাটা পরিচালনা করেছিলেন তিগমাংশু ধুলিয়া, এনএসডির সময় থেকেই যিনি ইরফানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ক্যামেরার সামনে আর পেছনে দুজনের জুটিটা আলো ছড়ালো তীব্রভাবে। পান সিং টোমার- এ অভিনয় করেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেছিলেন ইরফান, ফিল্মফেয়ারে ক্রিটিক্স চয়েজে হয়েছিলেন সেরা অভিনেতা। অনেকেই এটাকে ইরফানের ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমাও বলে থাকেন। পান সিং টোমার দেখে থাকলে এই লাইনের সঙ্গে দ্বিমত করার উপায়ও পাওয়া যায় না সেভাবে। 

দ্য লাঞ্চবক্স (২০১৩)

বিপত্নীক এক সরকারী চাকরিজীবীর সঙ্গে স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এক গৃহবধুর অন্যরকম বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে এগিয়েছে দ্য লাঞ্চবক্স সিনেমার গল্প। পরিচালক রিতেশ বাত্রা খুব সহজ ভাষায়, কোন আড়ম্বর না রেখেই মুম্বাইয়ের শহরতলীর পটভূমিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন গল্পটা, যে গল্প এগিয়েছে লোকাল ট্রেন আর মেট্রোর ঢিমেতাল গতিতে, ক্যাসেট প্লেয়ারে বা ভিখিরির কণ্ঠে বাজতে থাকা 'ও মেরে সাজন' গানের সুরে। 

দ্য লাঞ্চবক্স- এর সাজন ফার্নান্ডেজ

প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সাজন ফার্নান্ডেজের চরিত্রে ইরফানের অনবদ্য অভিনয় কি কখনও ভোলা সম্ভব? সিনেমাজুড়ে যে অতৃপ্তি আর একাকীত্বের চাষ করেছেন ইরফান ও নিমরাত কৌর, সেটার সঙ্গে প্রতিটি মনযোগী দর্শকই কানেক্ট করতে পারবেন, শেষ পর্যন্ত দুজন একসঙ্গে থাকতে পারলেন কিনা, সেটা দেখার আগ্রহে বুঁদ হবেন। ধীরগতির এই সিনেমাটা একই সাথে বিষাদ আর আনন্দের রেণু ছড়িয়ে গেছে প্রত্যেকটা সেকেন্ডজুড়ে, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দাঁড়িয়ে একটা অন্যরকম প্রেমের গল্প বলেছে আশির দশকের স্টাইলে। ভারতের হয়ে ২০১৩ সালে অস্কারে প্রতিনিধিত্ব করেছিল দ্য লাঞ্চবক্স, জিতেছিল অসংখ্য পুরস্কার, ফিল্মফেয়ারে হয়েছিল সেরা সিনেমা। 

পিকু (২০১৫)

তিনজন আলাদা আলাদা মানুষের গল্প, একটা শহর আর একটা বাড়ির গল্প, একটা রোগের গল্প, আর প্রায় এক হাজার কিলোমিটার লম্বা একটা জার্নির গল্প। সবগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে পরিচালক সুজিত সরকার বানিয়েছিলেন পিকু সিনেমাটা। অমিতাভ বচ্চনের প্রভাব আর দীপিকার গ্ল্যামারের ভীড়ে ইরফান কতটা নজরে আসবেন, সেই সন্দেহ ছিল। কিন্ত যে মানুষটা শুধু চোখ দিয়েই অভিনয় করতে পারেন, তাকে শুধু একটা গল্প আর একটা চরিত্র দিলেই চলে, ফ্রি হিটে ছক্কা মারার কাজটা তো তিনি হেসেখেলেই করে দেন! পিকু সিনেমায় সেটাই করেছেন ইরফান। 

পিকু সিনেমায় ইরফান ও দীপিকা

দীপিকার সঙ্গে তার 'আনইউজ্যুয়াল' জুটিটাকেই কী অসম্ভব মায়াময় লাগলো দেখতে! মেড ফর ইচ আদার নয়, যেন 'রাইট ফর ইচ আদার'! অমিতাভের সঙ্গেও অদ্ভুত একটা পার্টনারশীপ হলো, তাতে সিনেমার গল্প দিল্লি থেকে তরতর করে চললো কলকাতার পানে। এই সিনেমাটা মোটেও প্রেমের সিনেমা নয়, বরং জীবনবোধে পরিপূর্ণ একটা সিনেমা। পিকু শুধু বাবা-মেয়ের গল্প বলেনি  পিকু বা ভাস্করের সম্পর্কটাই এখানে সবকিছু নয়। পিকুর সঙ্গে রানার, কিংবা রানার সঙ্গে বদমেজাজি ভাস্কর ব্যানার্জীর সম্পর্কটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো গল্পের তালে তালে। পিকু দেখা যেন চোখ আর মন, দুটোরই প্রশান্তি। 

ইরফান নেই, আছে তার কাজগুলো। সশরীরে বেঁচে কি করতে পারতেন, আরও কি কি উপহার দিতে পারতেন আমাদের, সেসব হিসেবে আজ না যাই। বরং ইরফানকে মনে করার চেষ্টা করি অশোক গাঙ্গুলী, পান সিং, মিয়া মকবুল, সাজন ফার্নান্ডেজ, রানা চৌধুরী, রাজ বাত্রা বা যোগীর মতো চরিত্রগুলোর মাঝে, ইরফান তো এসব চরিত্র হয়েই আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা