অভিনয়ের জাদুতে দুই বাংলা জয় করা জয়ার গল্প
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

বাংলাদেশের একজন অভিনেত্রী হিসেবে ভিন্ন একটি দেশে গিয়ে নিজের সততা, মেধা এবং অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয়া নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন এক অন্য উচ্চতায়৷ যা অনেকের কাছে স্বপ্ন, জয়া সেটি করে দেখিয়েছেন নিজ স্বতন্ত্রতায় ভর করে...
বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দক্ষ অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন তিনি। নিজ দেশে সফলতা এবং জনপ্রিয়তা লাভ করার পাশাপাশি ওপার বাংলার চলচ্চিত্রেও নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। একটি সিনেমায় তিনি থাকা মানেই সেটি ভিন্নকিছু হবে এই ধারনাটা দর্শকমনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা, কাজের দক্ষতা, মেধা এবং অসাধারন সৌন্দর্য্য দিয়ে।
বলা হচ্ছে জয়া আহসানের কথা। নিজের দেশের গুনী মানুষটাকে এই দেশে তেমনভাবে কাজে না লাগানোর জন্য কিছুটা কষ্ট আর ক্ষোভ থাকলেও গর্বের বিষয়টা ঠিক ততোটাই বেশি কারন, তিনি যেমন আমাদের দেশের সবার প্রিয় জয়া আহসান তেমনি অসাধারন কিছু সিনেমায় তার দক্ষতা আর চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার কল্যানে তিনি ওপার বাংলার চলচ্চিত্রের এই সময়ের সেরা অভিনেত্রী জয়া আহসান ও বটে। আজ দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিন।
অভিনয় শুরুর আগে থেকেই জয়া আহসান নাচ ও গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। আকর্ষন এতোটাই ছিলো যে, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর ডিপ্লোমা করেছিলেন এবং আধুনিক সঙ্গীতের ওপর প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। তিনি একটি সংগীত স্কুলও পরিচালনা করেছেন।
নব্বই দশকের শেষ দিকে জয়া মডেলিং শুরু করেন যার মাধ্যমে মিডিয়াতে তার আগমন। মডেলিং এর সুত্র ধরেই তার নাট্যজগতে পদচারনা শুরু। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জয়া আহসান বলেছিলেন, আসলে আমি সেই সময় অভিনয়টা তেমন বুঝতাম না। অভিনয়কে ভালোবাসাটা তখনো সেভাবে তৈরী হয়নি। তাই আমার প্রথমদিকের কাজগুলো সেভাবে মনোযোগ দিয়ে করাও হয়নি। তবে একটা সময় আমি বুঝে গেলাম যে, আমি এই মাধ্যমেই কাজ করতে চাই। এবং তখন থেকেই অভিনয়ের প্রতি আমার ভালোলাগা বা ভালোবাসা শুরু।
'অফবিট' নাটকের মাধ্যমে তিনি সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। কাছাকাছি সময়েই ধারাবাহিক 'এনেছি সূর্যের হাসি' এবং 'হাটকুঁড়া' নাটক দিয়ে অভিনেত্রী জয়ার ঝলক দেখা যায়। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এরপর একে একে মেগা সিরিয়াল ৬৯, কয়েকটি নীল রঙ পেন্সিল, গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প, শঙখবাস, চৈতা পাগল, তারপর ও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে, পাঞ্জাবীওয়ালা, ফেরার পথ নেই থাকেনা কোনো কালে, আমাদের গল্প'র মতো জনপ্রিয় এবং আলোচিত নাটকে কাজের মধ্য দিয়ে টেলিভিশন জগতের অন্যতম সেরা অভিনেত্রীর খেতাব পান জয়া।

ছোট পর্দার অভিনেত্রী জয়া আহসানের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ২০০৪ সালে জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলর’ সিনেমার মাধ্যমে। তারপর প্রায় ছয় বছর পর ‘ডুবসাঁতার’। এই সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় তার অভিনয় প্রশংসা পায় সবার কাছ থেকেই। ২০১১ সালে ‘ফিরে এসো বেহুলা’ এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’ তে অভিনয় করেন। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় ‘গেরিলা’ সিনেমায় তার অসাধারন অভিনয় তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর করে রাখবে একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে নেন জয়া আহসান।
২০১২ সালে রেদোয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’ সিনেমাতে একজন সাংবাদিকের চরিত্রে আবারো মনোমুগ্ধকর অভিনয় করেন জয়া। ফলাফল এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য টানা দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জয়া বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি কলকাতার চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান। কলকাতার অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘আবর্ত’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ওপার বাংলায় তার পথচলা শুরু হয়। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি কলকাতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ নবীন অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান। এবং এই সিনেমার কল্যানেই জয়া আহসান ২০১৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে নিমন্ত্রণ পান। বাংলাদেশের 'পূর্নদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী' সিনেমা বক্স অফিসে সফলতা পেলেও অভিনেত্রী হিসেবে সেভাবে আলোচিত হননি তিনি।
২০১৫ সালে জয়া অভিনয় করেন অনিমেষ আইচ পরিচালিত ‘জিরো ডিগ্রী’ সিনেমাতে। এবার প্রশংসা এবং আলোচনা দুটোই জুটেছিলো জয়ার। একই বছর কলকাতার ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’ ও সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ নিয়ে নির্মিত ‘রাজকাহিনী’ সিনেমাতে অভিনয় করেন। ‘রাজকাহিনী’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য কলকাতার ১৬তম টেলি সিনে পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে মুক্তি পায় সাফি ইকবাল পরিচালিত ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী ২’। ওই বছর আরও অভিনয় করেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপ্যাধ্যায় রচিত অরিন্দম শীল পরিচালিত কলকাতার ‘ঈগলের চোখ’ সিনেমাতে। এই সিনেমায় তার অভিনয় দক্ষতার ফলাফল দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জয়া বন্দনা শুরু হয় কলকাতার মাটিতেও। কলকাতার সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বরেন্য পরিচালক এবং অভিনয় শিল্পীরা তার প্রশংসা করেন অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার জন্য।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে মুক্তি পায় 'খাঁচা' সিনেমাটি। এই সিনেমায় জয়ার নান্দনিক অভিনয় প্রশংসিত হলেও অজানা কারনে আলোচনায় ছিলো না এটি। একই বছর তিনি অভিনয় করেন কলকাতার কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘বিসর্জন’ সিনেমাতে। আবির চ্যাটার্জি আর কৌশিক গাঙ্গুলীর মতো জাদরেল অভিনেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামের মেয়ে পদ্মা'র চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া। পদ্মা চরিত্রটি যেনো জয়ার জন্যই লেখা। তার সৌন্দর্য্য আর চরিত্রের সাথে একাত্মতা তাকে দুই বাংলার জনপ্রিয় এবং সেরা অভিনেত্রীর খেতাব এনে দেয়। এই সিনেমার মাধ্যমেই জয়া আহসান কলকাতার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। এই পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের জন্য নিয়ে এসেছিলেন এক গর্ব এবং আনন্দের ক্ষন। ২০১৯ সালে এই সিনেমার সিক্যুয়েল ‘বিজয়া’তেও অভিনয় করেন তিনি। এবারো তার অসাধারণ কাজের জন্য প্রশংসা পান তিনি।
২০১৮ সালে প্রযোজক হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে জয়ার। হুমায়ূন আহমেদের ‘দেবী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন সফল সিনেমা ‘দেবী’। সিনেমায় রানু চরিত্রের রহস্য আর জয়ার অভিনয় দক্ষতা সিনেমাটিকে নিয়ে যায় এক অন্য উচ্চতায়। এই সিনেমার প্রমোশন আইডিয়া তাকে প্রযোজক হিসেবেও আলোচনায় নিয়ে আসে। এই সিনেমার জন্য আবারো লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
২০১৮ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত আরেকটি সিনেমা ‘পুত্র’। একই বছর বিরসা দাশগুপ্ত পরিচালিত কলকাতার নারীবাদী চলচ্চিত্র ‘ক্রিসক্রস’ এ তার অভিনয় আলোচনায় আসে। এই বছরের আরেকটি আলোচিত এবং জনপ্রিয় সিনেমা 'এক যে ছিলো রাজা' তে তিনি প্রমান করেন যে তিনি সব ধরনের সব চরিত্রেই নিজেকে তুলে ধরতে পারেন অবলীলায়।
২০১৯ সালে শিবু-নন্দিতার 'কন্ঠ' এবং অতনু ঘোষের 'রবিবার' তাকে কলকাতার এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে তার আসন আরো শক্তিশালী করে। 'রবিবার' সিনেমায় তিনি প্রথমবারের মতো জুটি বাধেন কলকাতার জীবন্ত কিংবদন্তি প্রসেনজিৎ এর সাথে। ওপারের প্রসেনজিৎ এর মতো শক্তিশালী আর জনপ্রিয় শিল্পীর সাথে 'রবিবার' সিনেমায় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন আমাদের জয়া আহসান। স্বয়ং প্রসেনজিৎ জয়ার অভিনয় এবং ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছেন এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সেটি বলেছেন নিজেই। এবং স্বীকৃতি স্বরূপ বিজয়া এবং রবিবার এই দুই সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য সমালোচকদের রায়ে সেরা অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জয় করেছেন দ্বিতীয় বারের মতো।
এবছর করোনার মাঝেই আহমদ ছফার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম থ্রিডি সিনেমা 'অলাতচক্র'তে তার অভিনয় দক্ষতার ঝলক মিললেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রচারনার অভাব এবং করোনা পরিস্থিতির কারনে সব শ্রেনীর দর্শকদের কাছে পৌছায়নি এই অসাধারণ কাজটি। বাংলাদেশ বা ভারত নয় জয়ার অভিনয় দক্ষতার সুনাম এখন পাশ্চাত্যেও। স্পেনের ‘মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২০২০’ এ ‘রবিবার’ সিনেমার জন্য বিদেশি ভাষার সিনেমা বিভাগে ‘সেরা অভিনেত্রী’ নির্বাচিত হয়েছেন জয়া আহসান।

নানা ধরনের চরিত্রে সহজভাবে মিশে যাওয়া এবং অসাধারন ভাবে সেটি পর্দায় তুলে ধরা ধরা নিয়ে এক অনুষ্ঠানে জয়া আহসান বলেছিলেন,
‘সিনেমা করার আগে কখনো ভাবি না, এটা হিট হবে কিনা। কাজ করার সময় আমি কেবল চরিত্র অনুধাবন করি এবং সেই চরিত্রে ডুবে যাই। যখন সিনেমাটি দর্শকপ্রিয় হয়, হিট হয়, তখন সবারই ভালো লাগে। কিন্তু সিনেমা হিট না হলেও অভিনয়শিল্পীরা তার সর্বোচ্চ কাজটুকুই দেন। তাই আমার জায়গায় আমি অনেস্ট থাকি। এটাই হয়তো আমার মূল শক্তি।'
বাংলাদেশে চারটি জাতীয় পুরস্কার সহ সাতটি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, এবং বাচসাস পুরস্কার সহ অর্জন করেছেন দেশসেরা প্রায় সব পুরস্কার। ভারতের ফিল্মফেয়ার সহ আরো বেশকিছু পুরস্কার তার ঝুলিতে। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বাংলা ভাষায় দুইটি সেরা সিনেমার অভিনেত্রী তিনি। জয়া সামনে যাবেন যে অনেকদূর তা বলার প্রয়োজন নাই।
কিছুদিন আগে জয়া আহসানকে পশ্চিমবাংলার বক্স অফিসের রাণী হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ভারতের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তাদের বিনোদন ও লাইফস্টাইল ভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘ইনডালজ’-এ জয়া আহসানকে নিয়ে দীর্ঘ একটি ফিচার প্রকাশ করেছে। আর সেখানেই জয়াকে বলা হয়েছে- ‘দ্য বক্স অফিস কুইন’।
আসলেই তো তাই বাংলাদেশের একজন অভিনেত্রী হিসেবে ভিন্ন একটি দেশে গিয়ে নিজের সততা, মেধা এবং অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয়া নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন এক অন্য উচ্চতায়৷ যা অনেকের কাছে স্বপ্ন জয়া সেটি করে দেখিয়েছেন স্বতন্ত্রতায় ভর করে। অভিনয়ের পাশাপাশি করোনার সময়ে পশুপ্রেমী হিসেবেও দুই বাংলায় তার নেয়া কিছু পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে।
সামনে মাহমুদ দিদারের 'বিউটি সার্কাস', নূরুল ইসলাম আতিকের 'পেয়ারার সুবাস' কলকাতার নামকরা অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের প্রযোজনায় 'ভূতপরী', শিলাদিত্যের ‘ছেলেধরা’ এবং কৌশিক গাঙ্গুলীর ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমায় দেখা যাবে জয়াকে। নিজের প্রযোজিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘রইদ’ সরকারি অনুদান পেয়েছে কিছুদিন আগে। শিগগিরই শ্যুটিং শুরু হবে এটির। জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইলো জয়া আহসানের জন্য। দুই বাংলা দাপিয়ে বেড়ানো গুনী অভিনেত্রী জয়া'র জয়যাত্রা চলবে আরো অনেক দিন, এই প্রত্যাশা করি।