জয়া আহসান দ্বিতীয়বারের মতো ফিল্মফেয়ার বাংলায় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন এবছর। 'রবিবার’ ও ‘বিজয়া’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সমালোচকদের রায়ে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করেছেন বাংলাদেশী এই অভিনেত্রী। গতবার জয়া পপুলার ক্যাটাগরিতে ‘বিসর্জন’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জয় করেছিলেন।

জয়া অনেকদিন ধরেই কলকাতায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করছেন, দর্শকদের মন জয় করছেন, জিতছেন পুরস্কারও। জি সিনে অ্যাওয়ার্ডস, ফিল্মফেয়ার কিংবা হইচই বেস্ট অ্যাক্ট্রেস অ্যাওয়ার্ড- সব পুরস্কারই ঝুলিতে পুরেছেন বাংলাদেশের এই অভিনেত্রী। কিন্ত আমাদের দেশের নির্মাতারা তার প্রতিভাকে ব্যবহার করতে পারছেন না, জয়া অনেকটা অনাবিষ্কৃতই রয়ে যাচ্ছেন তাদের কাছে।

জয়া অভিনীত 'এক যে ছিল রাজা' সিনেমাটা কলকাতায় মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে। সিনেমা মুক্তির পরে আনন্দবাজারে প্রকাশিত রিভিউটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। কলকাতার দৈনিকটি লিখেছিল- "যীশু তার ক্যারিয়ারের সেরা অভিয়টাই করেছেন এই সিনেমায়, কিন্ত দিনশেষে ম্যান অব দ্য ম্যাচ কিন্ত জয়া আহসান!" জয়ার অভিনয়ের জাদুটা এই এক বাক্যেই বোঝা যাচ্ছিল পরিস্কার। 

কলকাতায় এখন জয়া আহসানের তুমুল জনপ্রিয়তা। ব্যস্ততাও প্রচণ্ড। একটার পর একটা সিনেমায় অভিনয় করছেন সেখানে, তুমুল প্রশংসিত হচ্ছে তার প্রতিটা কাজই। 'রাজকাহিনী', 'বিসর্জন' দিয়ে যে জনপ্রিয়তার শুরু, সেটা তিনি দিনকে দিন বাড়িয়ে তুলেছেন 'বিসর্জন', 'বিজয়া', 'ক্রিসক্রস', 'এক যে ছিল রাজা' বা 'রবিবারে'র মতো সিনেমাগুলো দিয়ে। তার সিনেমা জিতেছে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। কাজের সুবিধার্থে সেখানে বাড়িও নিয়েছেন, কলকাতার দর্শকদের কাছে জয়া এখন সেখানকারই একজন, অভিনয়ের মাধ্যমে তাদের এতই আপন হয়ে উঠেছেন তিনি! 

এর উল্টো চিত্রটা বাংলাদেশে। জয়া এখানকার মেয়ে, ঢাকার আলো বাতাসে তার বেড়ে ওঠা। অথচ এদেশেই এখন তার কাজের পরিমাণ কম, কলকাতাতেই বেশিরভাগ কাজ করছেন তিনি। কিন্ত কেন? অভিনয়ের ক্ষিধেটা একটা বড় কারণ অবশ্যই। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এক্সপেরিমেন্টের পরিমাণটা কম, প্রায় নেই বললেই চলে। গৎবাঁধা পথের বাইরে হেঁটে এখানে কেউ ঝুঁকি নিতে চাননা সেভাবে। চেনা ছক বা গণ্ডি ছেড়ে বেরুতেও চান না খুব বেশি নির্মাতা। জয়া যে টাইপের সিনেমা করেন, যে ধরণের চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে মুখিয়ে থাকেন, সেসব চরিত্র বা সিনেমা তো ঢাকাই চলচ্চিত্রে নির্মাণ হয় না খুব বেশি। 

রবিবার সিনেমার একটি দৃশ্যে জয়া ও প্রসেনজিত

বাংলাদেশে জয়া আহসান কাজ করেছেন ব্যাচেলর, ডুবসাঁতার, গেরিলা, চোরাবালি, জিরো ডিগ্রি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী(১+২) এবং খাঁচা সিনেমায়, কাজ করেছেন নিজের প্রযোজিত দেবী সিনেমাতে, আর তার সবশেষ সিনেমা হচ্ছে সরকারী অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্র 'অলাতচক্র'। ফিল্মোগ্রাফিটা যথেষ্টই ছোট। আর এই সিনেমাগুলোর মধ্যে চোরাবালি আর পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী বাদে কোনটাই মোটাদাগে মেইনস্ট্রিম কমার্শিয়াল সিনেমা নয়। অথচ তিনি এই কাজগুলোই করতে চান, কারণ এখানে অভিনয়ের সুযোগটা থাকে, নিজের প্রতিভার ঝলক দেখানো যায় এই সিনেমাগুলোতে। কিন্ত সেগুলোর অফার তো বাংলাদেশে তিনি খুব বেশি পাচ্ছেন না। 

কলকাতায় তাকে কেন্দ্র করে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে। কৌশিক গাঙ্গুলির মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী নির্মাতা জয়া আহসানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যে তাকে বিসর্জনে নিয়েছেন, অরিন্দম শীল বা সৃজিত মূখার্জীরা নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করছেন জয়াকে নিয়ে, গল্প বোনা হচ্ছে তাকে ঘিরে। নন্দিতা-শিবপ্রসাদও তাকে নিয়ে বানিয়ে ফেলেছেন সিনেমা। একটা চ্যালেঞ্জিং রোলে অভিনয় করে একজন শিল্পী যে তৃপ্তিটা পান, সেটার সাথে অন্য কোনকিছুরই তুলনা হয় না। জয়া আহসানকে সেই তৃপ্তিটা উপহার দিতে পারছে কলকাতা, ঢাকা সেভাবে পারছে কই? 

বাংলাদেশে জয়া আহসানের সেরা কাজ সম্ভবত নূরুল আলম আতিকের 'ডুবসাঁতার' সিনেমায়। এই সিনেমাটা ক'জনে দেখেছে বলুন? কিংবা কয় হাজার মানুষ এটার নাম শুনেছে? দেবী'র আগে জয়া আহসানের সবশেষ যে সিনেমাটা বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে, সেটার নাম ছিল খাঁচা। প্রযোজক সংস্থার অদ্ভুত সিদ্ধান্তে হুট করেই তাড়াহুড়ো করে সেটাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, কোন আগাম সংবাদ না জানিয়েই! দেশভাগের ওপরে নির্মিত এই সিনেমাটায় জয়া আহসান চমৎকার অভিনয় করেছিলেন, কিন্ত সেটা দেখার সুযোগটা মানুষ পায়নি। স্টার সিনেপ্লেক্সের মতো জায়গা থেকে এক সপ্তাহ পরেই সিনেমাটা নেমে গিয়েছিল, কারণ দেখার মানুষ নেই। থাকবে কি করে? মানুষকে তো জানাতে হবে যে ভালো একটা সিনেমা এসেছে। সেটা জানানোর দরকারও মনে করেনি প্রযোজকেরা। 

জয়া আহসান

এই যে জয়া আহসানকে দারুণভাবে ব্যবহার করছেন কলকাতার নির্মাতারা, সেটা দেখে ভালো লাগে, গর্ব হয়, আমাদের দেশের একজন অভিনেত্রী সেখানে গিয়ে দারুণ কাজ করছেন, প্রশংসা পাচ্ছেন, পুরস্কৃত হচ্ছেন, এই জিনিসটা অবশ্যই ভালো লাগার একটা অনুভূতি সৃষ্টি করে মনের ভেতরে। কিন্ত সেইসঙ্গে আফসোসও হয়, জয়া আহসানকে আমাদের নির্মাতারা ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না, তার মতো দুর্দান্ত একজন অভিনেত্রীকে নিয়ে পর্যাপ্ত কাজ তারা করতে পারছেন না, তাকে ঘিরে গল্প বানাতে পারছেন না- এই আক্ষেপটাও তো আমাদের সঙ্গী।

বিউটি সার্কাস' নামের একটা সিনেমায় অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। এই সিনেমাটার কাজ অনেকবার বাধাগ্রস্থ হয়েছে নানা কারণে, এখনও আটকে আছে শুটিং। কবে যে এটা দর্শক দেখতে পাবে, আদৌ পাবে কিনা- সেটাও নিশ্চিত নয়। জয়া আহসানের অভিনীত সিনেমাগুলোর কোনটা প্রচারণার অভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছায় না, কখনও আবার আর্থিক সমস্যায় শুটিং বন্ধ হয়ে থাকে। নিজেদের প্রতিভাকে এভাবে অপচয় বোধহয় আর কেউ করে না, যেভাবে আমরা করি।

সেজন্যেই হয়তো জয়া এখন নিজেই সিনেমার প্রযোজনায় নেমে গিয়েছেন। দর্শককে ভালো একটা কাজ উপহার দেয়া হলো, অভিনয়ের তৃপ্তিটাও পাওয়া গেল। দেবী যারা দেখেছেন, তারা জানেন, সেখানে কি দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন জয়া আহসান। পুরো সিনেমাটাকে একাই টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। দেবী-কে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয়ার জায়গাটাতেও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেটেছেন জয়া। দেবী'র মতো এরকম আরও পঞ্চাশ-একশোটা সিনেমা হবার কথা ছিল আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে, তাহলেই হয়তো জয়া আহসানকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারতাম আমরা। সেটা আর হচ্ছে কই? 

বিজয়া সিনেমায় জয়া ও আবীর

অনেকেই অভিযোগ করেন, জয়া নাকি টাকার জন্য কলকাতার ছবিতে অভিনয় করেন। অভিনয়টা জয়া আহসানের কাছে নেশা, সেইসঙ্গে পেশাও। এই কাজটার বাইরে তিনি আর কিছুই করেন না। তার কোন বিউটি পার্লার নেই, তিনি কোন রেস্টুরেন্টের মালিক নন, তার কোন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও নেই। যতোটুকু তার আয়, সবটাই অভিনয় থেকে। খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হলে অভিনয়টা তাকে করতেই হবে। সেটা এপার বাংলায় হোক, কিংবা ওপারে।

জয়ার নাম শুনলে অনেকেই গেরিলা এবং দেবীর বাইরে আর কিছু খুঁজে পান না। তার সব কাজ নাকি ভারতে। অথচ এদেশে তার সেরা কাজগুলো আলোচনার বাইরেই পড়ে থাকে বরাবর। খাঁচা সিনেমাটার কথাই ধরা যাক, কয়টা মানুষ এই মাস্টারপিস সিনেমাটা দেখেছে? ডুবসাঁতার দেখেছে কয়জন? মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ নেই, কিন্তু 'তবুও আঙুরলতা নন্দকে ভালোবাসে', 'বিকল পাখির গান' কিংবা 'গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প' নাটকে জয়া যে মন্ত্রমুগ্ধ আবেশ তৈরি করেছিলেন অভিনয়ের ইন্দ্রজালের মাধ্যমে, সেই অনুভূতির সিকিভাগও কি পূরণ করতে পারবে ওইসব মিলিয়ন ভিউজের তৃপ্তি? 

এমনটা নয় যে আমাদের নির্মাতারা জয়ার কাছে সিনেমার প্রস্তাব নিয়ে যান না, স্ক্রীপ্ট তো তিনি অনেক পান। কিন্ত সেগুলো তাকে কনভিন্স করতে পারে না সেভাবে। অভিনয়ের যে ক্ষিধেটা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, সেই ক্ষিধে মেটানোর মতো চরিত্র তো ঢাকাই সিনেমায় খুব বেশি পান না তিনি। যে সিনেমার গল্পে জয়া নিজেই বিশ্বাস করতে পারেন না, সেখানে তিনি কেন কাজ করবেন? এজন্যেই কলকাতায় জয়ার ব্যস্ততা বেড়েছে, আর কমেছে ঢাকায়। আর এই বাস্তবতাটা মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করারও নেই। জয়া আহসান তাই একই সাথে আমাদের কাছে গর্ব, পাশাপাশি বড়সড় একটা আক্ষেপেরও নাম। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা