জিতেন্দ্র কুমারকে চাইলে একটা কেস স্টাডি হিসেবে ধরতে পারেন। নিজেদের প্যাশনের পেছনে ছোটার সাহস যারা করে উঠতে পারছেন না, তাদের জন্য এই ভদ্রলোক একটা অনুপ্রেরণার নাম। জিতু প্রমাণ করেছেন, নিজের প্যাশনকে ফলো করেও কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। মার্সিডিজ বেঞ্জের গাড়ি হাঁকানো যায়৷ লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়৷ সবচেয়ে বড় কথা, আত্মতৃপ্তি নিয়ে ভালো থাকা যায়...

ভারতে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রগুলোই সুযোগ পায় 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি' বা আইআইটিতে পড়ার। রাজস্থানের অরওয়াল জেলার খৈরতাল নামের ছোট্ট এক শহরে জন্ম নেয়া জিতেন্দ্র কুমারও জীবনের বারোটা বছরের মেধা আর শ্রম এক করে সুযোগ পেলেন আইআইটি খড়গপুরের ছাত্র হবার। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা কাটলো। ছেলে গুগল-মাইক্রোসফটে না যাক, বেঙ্গালুরুতে ভালো একটা প্রাইভেট ফার্মে নির্ঘাৎ ভালো বেতনে চাকরি পাবেই। 

মফস্বলে বেড়ে ওঠা, ইংরেজী ভাষায় তাই দুর্বলতা ছিল; তারচেয়ে বেশি ছিল জড়তা, ভয়। তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিনেমার ডায়লগ দিতে কোন জড়তা ছিল না জিতুর, অভিনয়ের ভক্ত তিনি সেই ছোট্টবেলা থেকেই। ফার্স্ট ইয়ারের শেষ দিকে যখন অ্যানুয়াল কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই, জিতু ভিড়লেন হিন্দি ড্রামা গ্রুপে। ইংলিশ ড্রামায় কম্পিটিশন কম, কিন্তু ইংরেজীটা তো জিতুর আসে না তেমন। 

কলেজে নাটক করতে করতেই পরিচয় হলো বিশ্বপতি সরকারের সঙ্গে। বিশ্বপতি তখন টিভিএফ (দ্য ভাইরাল ফিভার) নামের একটা ইউটিউব চ্যানেলে স্ক্রিপ্ট লেখেন৷ বিশ্বপতি জিতুকে প্রস্তাব দিলেন তাদের চ্যানেলের ছোট ছোট নাটিকায় অভিনয় করার। টিভিএফ তখনও স্ট্রাগল করছে, তাদের নাম জানে না খুব বেশি মানুষ৷ জিতু দুয়েকটা নাটিকায় অভিনয় করলেন, তারপর গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়ে গেল, আইআইটির সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি চলে এলেন রাজস্থানে, নিজের বাড়িতে৷ কিছুদিনের মধ্যে একটা চাকরিতেও ঢুকলেন। 

জিতেন্দ্র কুমার

মাস ছয়েক চাকরিটা করতে পেরেছেন, এরপর হাঁপিয়ে উঠলেন। এই নয়টা-পাঁচটার জীবন বড্ড সেকেলে, ভীষণ বিরক্তিকর। জিতু বুঝলেন, তার জীবনের অক্সিজেন হচ্ছে অভিনয়, বেঁচে থাকতে হলে তাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে। চব্বিশ ঘন্টার সিদ্ধান্তে রেজিগনেশন লেটার জমা দিলেন, ব্যাগ গুছিয়ে ফিরলেন বাড়ি। বাবা-মা ভাবলেন ছুটিতে এসেছে ছেলে। দু'দিন পর ডাইনিং টেবিলে বসে বাবাকে জিতু জানালেন চাকরি ছেড়ে দেয়ার খবর। বললেন, তিনি অভিনয় করতে চান। ক্ষেপে উঠলেন বাবা। ফাজলামো নাকি? বছর পঁচিশের ঢ্যামনা ছেলে এসব কী বলছে! 

জিতু নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বাবার কাছ থেকে একটা পয়সাও নিলেন না, ছয় মাসের বেতন থেকে যা জমিয়েছেন, সেটা নিয়েই উঠে পড়লেন মুম্বাইয়ের ট্রেনে, এসে নামলেন ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনালে। অনেক বছর আগে ঠিক এই জায়গাটাতে এসে নেমেছিলেন দিল্লির এক তরুণ, পিঠে একটা ব্যাগ ছিল, দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন ছিল, আর ছিল নিজেকে প্রমাণের তীব্র বাসনা। সেই ছেলেটা পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্মস্টারে পরিণত হয়েছেন, সারা বিশ্বের মানুষ তাকে শাহরুখ খান নামে চেনে। 

জিতু শাহরুখ হতে চাননি হয়তো, বরং জিতেন্দ্র কুমার নামেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। টিভিএফের সাথে তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হলো। মুম্বাইয়ের ঘিঞ্জি জীবনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগলো, দাঁতে দাঁত চেপে টিকে রইলো ছেলেটা। বিকল্প কোন রাস্তায় হাঁটার ইচ্ছে নেই তার, নেই পেছনে তাকানোর উপায়। আগুনের দিন শেষ হলো একদিন, জিতু আর টিভিএফ, দুটোরই জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো সময়ের সাথে সাথে। একটা সময় তো টিভিএফের সমার্থক শব্দ হয়ে গেলেন তিনি। গজরাজ রাওয়ের সঙ্গে তার বাবা-ছেলের জুটিটা লুফে নিলো দর্শক। 

টিভিএফের ভিডিওতে জিতেন্দ্র কুমার

ছক্কা হাঁকানোটা তখনও বাকি ছিল। জিতেন্দ্র কুমার জাত চেনালেন কোটা ফ্যাক্টরি দিয়ে। কোচিং টিউটর হয়ে নিজের নামেই হাজির হলেন তিনি, জিতু ভাইয়াকে এক লহমায় লুফে নিলো তরুণ প্রজন্ম। এমন শিক্ষককেই তো নিজের আশেপাশে চায় ছাত্ররা, পাঠ্যবই গেলানোর সীমারেখা অতিক্রম করে যিনি বন্ধু হয়ে উঠবেন, হবেন পথপ্রদর্শক। সাদা আর কালোর তফাৎটা যিনি বোঝাবেন, ধূসর আর বাদামীর ব্যবধানটা যিনি ঢুকিয়ে দেবেন মাথায়। পরীক্ষার ভালো মার্কস অর্জনের বাইরেও যে বিশাল একটা দুনিয়া আছে, সেই দুনিয়ায় প্রতিটা পদক্ষেপে যিনি দিশারী হবেন। জিতু ভাইয়া তো সেরকমই একজন। 

কোটা ফ্যাক্টরির পর সিনেমার লিড রোলেই সুযোগ মিলে গেল, নাম 'শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান'। সমকামী ভালোবাসার পটভূমিতে নির্মিত এই সিনেমায় তিনি হাজির হলেন আয়ুশমান খুরানার বিপরীতে, ছাপ রেখে গেলেন নিজের প্রতিভার। তারপর ওয়েব সিরিজ 'পঞ্চায়েত' এলো, আরও একবার নিজের পারফরম্যান্সে মাতিয়ে দিলেন জিতেন্দ্র কুমার৷ ফুলেরা গ্রামের পঞ্চায়েত সচিবের চরিত্রে দারুণ উপস্থিতি তার। অভিষেক ত্রিপাঠির হতাশা, রাগ, অভিমান, খুশি- সবকিছুই যেন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। 

কোটা ফ্যাক্টরির জিতু ভাইয়া

জিতেন্দ্র কুমারের আউটলুকে আহামরি কিছু নেই। আমাদের আশেপাশের পাঁচ-দশটা মানুষ যেমন, তিনিও তেমন দেখতে। অ্যাভারেজ চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রঙ- কোনো কিছুতেই তাকে আলাদা করা যাবে না৷ তফাৎটা বোঝা যাবে শুধু তিনি যখন কোনো চরিত্রের ভেতর ঢুকে পড়েন, তখন। রিয়াল লাইফের জিতেন্দ্র কুমারকে আর তখন খুঁজে পাওয়া যায় না৷ আপনি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সস্তা ভার্সনটাকে পাবেন, জিতু ভাইয়াকে পাবেন, অভিষেক ত্রিপাঠিকেও পাবেন, জিতেন্দ্র কুমারকে পাবেন না সেখানে। এখানেই জিতু অনন্য। 

জিতেন্দ্র কুমারকে চাইলে একটা কেস স্টাডি হিসেবে ধরতে পারেন। নিজেদের প্যাশনের পেছনে ছোটার সাহস যারা করে উঠতে পারছেন না, তাদের জন্য এই ভদ্রলোক একটা অনুপ্রেরণার নাম। জিতু প্রমাণ করেছেন, নিজের প্যাশনকে ফলো করেও কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। মার্সিডিজ বেঞ্জের গাড়ি হাঁকানো যায়৷ লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়৷ সবচেয়ে বড় কথা, আত্মতৃপ্তি নিয়ে ভালো থাকা যায়। দরকার শুধু কঠোর শ্রম, আর অধ্যবসায়। জিতু তার প্যাশনকে ফলো করেছেন, সফল হয়েছেন৷ আপনি করছেন তো?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা