সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সত্য ঘটনা অবলম্বনে 'জয় ভীম' নির্মিত। অ্যাডভোকেট চন্দ্রু, যিনি পরবর্তীতে বিচারক হন, সেই মানুষটি তার জীবদ্দশায় ৯৬০০০ কেস সামলেছেন, যার অধিকাংশই হিউম্যান রাইটস কেস। মানবাধিকার কর্মী, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, আইনজীবী কিংবা বিচারক... নানাভাবে পরিচয় দেয়া যায় এ মহৎপ্রাণ মানুষটির। সারাজীবনে তিনি যতগুলো 'হিউম্যান রাইটস কেস' এর সাথে ছিলেন, তার একটিতেও এক পয়সাও ফি নেননি তিনি...

সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্য খানিকটা এরকম- 

জেল থেকে ছাড়া পাওয়া কিছু মানুষ লাইন দিয়ে বের হচ্ছে কারাগার থেকে। বের হওয়ার আগে কারা-পরিদর্শক এই মানুষদের কাছে তাদের গোত্র-পরিচয় জানতে চাইলেন। গোত্র পরিচয় জানার পরে যারা নিচু-স্তরের তাদের তিনি দাঁড়াতে বললেন একপাশে। বাকিদের ছেড়ে দিলেন। দাঁড়িয়ে থাকা নীচু গোত্রের এই মানুষদের এরপর টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করা হলো স্থানীয় কিছু থানার পুলিশ অফিসারদের কাছে। এই পুলিশ অফিসারেরা তাদের অমীমাংসিত কিছু মামলায় এই মানুষদের অপরাধী দেখিয়ে আবার তাদের জেলে পুড়বে। উদ্দেশ্য এটাই। সদ্যমুক্ত হওয়া সেইসব মানুষদের আবার ঢোকানো হলো পুলিশ ভ্যানে... 

সিনেমার এই প্রোলোগ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, জাত-বৈষম্যের বহুল চর্চিত মানবিক গল্পগুলোই 'জয় ভীম' সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র। যেখানে শুধুমাত্র 'নিম্ন-গোত্র' হওয়ার শাপে শোষিত হতে হয় আজীবন। খানিকটা দমে যেতে হলো৷ কারণ জাত-পাত-লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে এত এত সিনেমা হয়েছে, একই জনরার নতুন কোনো সিনেমায় স্বকীয় কিছু আনা তাই অনেকটাই দুরূহ। কিন্তু ভ্রম ভাঙ্গলো একটু পরেই। এই যে মানুষ, যাদেরকে নিচু জাতের বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, তাদের জীবনযাপন যখন এলো পর্দায়, দেখা গেলো- তারা শুধু নিচু জাতেরই না, তাদের নেই কোনো স্থায়ী ভূমি, স্থায়ী আবাস। সহায়সম্বলহীন হয়ে যেভাবে একচিলতে জায়গার মধ্যে অনেকগুলো মানুষ একত্রে জীবনের আয়োজন সাজিয়ে বসেছে, তাতে মানবিকতা-অমানবিকতার বহু উপাখ্যান আছে। স্বকীয় চিন্তার নানা উপকরণ আছে। খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম। 

তৃণমূল এই মানুষদের মধ্যে এক বিশেষ পরিবার এরপর আসে প্রকাশ্যে। সেনগানি এবং রাজাকানুর পরিবার। এই পরিবারকে বিশেষ বলার কারণ, এই পরিবারকে কেন্দ্র করেই সিনেমা সামনে এগোবে ক্রমশ। সেনগানি এবং রাজাকানুর স্বপ্ন, তাদের একটি পাকা বাড়ি হবে। এই স্বপ্নের পেছনেই সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম তাদের। এই পরিবারের সদস্যদের যাপিত স্বপ্ন, প্রেম, আক্ষেপ, বিষাদ মিলেমিশে গল্প যখন একটুখানি স্থিতিশীলতা পাবার উপক্রম করছে, তখনই আচমকা ছন্দপতন।  জানা গেলো, রাজাকানু এক প্রভাবশালী মানুষের আবাসস্থল থেকে স্বর্ণালংকার চুরি করেছে। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে। 

পুলিশ এক পর্যায়ে খুঁজে বের করে রাজাকানু কে। শুধু রাজাকানু না, রাজাকানুর স্ত্রী সেনগাই, তার আত্নীয়স্বজন যাকে যেভাবে পারে, পুলিশ নিয়ে আসে থানায়। অমানুষিক নির্যাতন করে। যৌন নির্যাতনও চলে সেখানে। পুলিশি নির্যাতন নিয়ে অজস্র সিনেমা আছে। কিন্তু এ সিনেমায় পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা যেন ছাড়িয়ে যাবে কাছে-দূরের অনেক সিনেমাকেও। শিউরে ওঠার মতন থমথমে পাশবিকতা ক্ষণেক্ষণে উঠে আসে পর্দায়, বিব্রত হতে হয়। নৃশংসতার এক পর্যায়ে রাজাকানুর পরিবারের বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হলেও আটকে রাখা হয় রাজাকানুকে এবং তার দুই আত্মীয়কে। পুলিশি নির্যাতন চলতে থাকে।

এক ভোরে জানা যায়, জেল থেকে পালিয়েছে এই তিন জন। রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গিয়েছে তারা। সেনগাই বুঝতে পারে, এখানে কোনো রহস্য আছে। সে শরণাপন্ন হয় অ্যাডভোকেট চন্দ্রুর। চন্দ্রু দাপুটে আইনজীবী। তার চেয়েও বড় কথা, সে বিবেকবান মানুষ। অমানবিকতার এই রূঢ় ঘটনা শুনে রোখ চাপে তার। এরপর চন্দ্রুর আইনি লড়াই শুরু হয় নিখোঁজ হওয়া মানুষদের খুঁজে পাওয়ার জন্যে। হাইকোর্টে 'হেবিয়াস করপাস' রিট করা হয়। গল্প ক্রমশই এগোতে থাকে অনিশ্চিত গন্তব্যে। অনিরাপদ সড়কে। 

'অ্যাডভোকেট চন্দ্রু' চরিত্রে সুরিয়া করেছেন দুর্দান্ত! 

'জয় ভীম' প্রথমেই মুগ্ধ করেছে চিত্রনাট্যে। সংলাপ, কাহিনীর পারস্পরিক গতিশীলতা কিংবা চরিত্রের বিন্যাস...খুব একটা খামতি কোথাও নেই। দুই ঘন্টা চুয়াল্লিশ মিনিটের সিনেমার প্রথমাংশে তৃণমূল মানুষদের মিথস্ক্রিয়া দেখিয়ে তাদের ব্যাকস্টোরি বেশ ভালোভাবেই বিল্ডআপ করেন নির্মাতা। এই কাজটি করার পেছনে বেশ গভীর এক কারণও আছে। পরবর্তীতে এই মানুষদের উপর যখন নির্যাতন হচ্ছে, প্রথমেই ব্যাকস্টোরি ডেভেলপ করে রাখার কারণে দর্শক আরো বেশি তাদের সাথে যুক্ত হওয়ার তাগিদ পায়। তাদের বিষাদে সমব্যথী হয়। পরবর্তীতে অ্যাডভোকেট চন্দ্রু যখন তাদের হয়ে লড়াই করছেন আদালতে, প্রচ্ছন্ন থেকে দর্শকও সেখানে দিয়ে যায় সমর্থন। 'জয় ভীম' এর চমৎকারিত্ব এখানেই। নিজে সমব্যথী হয়ে সিনেমার সাথে একাত্মা হওয়ার যে বিষয়, সেটিই খুব দারুণভাবে খাপ খেয়ে যায় এখানে।

চরিত্রগুলোর বিন্যাসও খুব খোলতাই। অ্যাডভোকেট চন্দ্রু (সুরিয়া) যেহেতু প্রোটাগনিস্ট, তাকে চাইলে আরেকটু দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী করা যেতো। কিন্তু সে পথে মোটেও হাঁটেননি নির্মাতা। চন্দ্রু মেধাবী একজন আইনজীবী। যিনি আশেপাশের তথ্য থেকে অসঙ্গতি বের করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেন। তিনি 'লাউড' কোনো ক্যারেক্টার না। বরং সাধারণের মধ্যে থেকেও প্রচন্ড পরিশ্রমী তিনি। এটাই তার এক্স ফ্যাক্টর। এ চরিত্রকে যেভাবে পর্দায় তুলে আনলেন সুরিয়া, মুগ্ধ করার মতন। কিছুদিন আগেই তার 'সুরারাই পতরু' দেখেছিলাম। সে সিনেমার সাথে এ সিনেমায় তার চরিত্রের পার্থক্য খুব ভালোভাবেই দৃশ্যমান। ভালো লেগেছে এ রূপান্তর। সুরিয়ার পাশাপাশি বাকিরাও দুর্দান্ত। লিজো, প্রকাশ রাজ, জয়প্রকাশ...নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনবদ্য।

প্রকাশ রাজ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন! 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সত্যঘটনা অবলম্বনে এ সিনেমা নির্মিত। অ্যাডভোকেট চন্দ্রু, যিনি পরবর্তীতে বিচারক হন, সেই মানুষটি তার জীবদ্দশায় ৯৬০০০ কেস সামলেছেন, যার অধিকাংশই হিউম্যান রাইটস কেস। মানবাধিকার কর্মী, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, আইনজীবী কিংবা বিচারক... নানাভাবে পরিচয় দেয়া যায় এ মহৎপ্রাণ মানুষটির। সারাজীবনে তিনি যতগুলো 'হিউম্যান রাইটস কেস' এর সাথে ছিলেন, তার একটিতেও এক পয়সাও ফি নেন নি তিনি। 'জয় ভীম' সিনেমার মাধ্যমে এরকম এক মানুষ সম্পর্কে যে জানতে পারলো সবাই, এও বা কম কী? 

'জয় ভীম' এ যেমন উঠে আসে জাস্টিস চন্দ্রুর কথা, তেমনি উঠে আসে সেনগাই কিংবা রাজাকানুর কথাও। সিনেমা শেষ হয়। আমরা সন্তুষ্টির তৃপ্তি পাই। এটুকুই প্রাপ্তি। কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলের কোনো এক সহায়সম্বলহীন মানুষের যে জীবন, তা পালটায় না তিলমাত্রও। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সবকিছু কেনাবেচা হয় বিভিন্ন ঘাটে। সংখ্যালঘু হয়ে অপরিসীম ত্রাসে বেঁচে থাকার যে গ্লানি, তা নিয়েই যুঝতে হয় তাদের। 'জয় ভীম' দেখে সন্তুষ্ট হলে তাই আখেরে কোনো প্রাপ্তি নেই। যদি এ সিনেমার আপ্তবাক্যকে ধারণ করা যায় ভেতরে, আরেকটু সংবেদনশীল হওয়া যায় এই অসহায় মানুষদের প্রতি, তাহলেই হয়তো খানিকটা হলেও পাল্টাবে তাদের দিনলিপি। সেটাই চাওয়া। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা