যখন ডিস্ট্রিবিউটররা এই সিনেমা কিনতে চাচ্ছিল না, তখন শাহরুখ কো-প্রডিউসার হয়ে নিজের সিনেমা নিজেই কিনে নেন। মুম্বাইয়ে নিজের সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, একদিন সিনেমা হলে টিকেট বিক্রি করতে নিজেই বসে পড়েছিলেন, টিকেটের সঙ্গে অটোগ্রাফ ফ্রি!

তখন স্কুলে পড়ি মাত্র। গ্রাম থেকে উপজেলা শহরের থাকার সুবাদে, হাতে তখন ডিশ লাইন ছিলো আত্মীয়র বাসায়। স্টার গোল্ড, জি সিনেমা আর ইটিসি’র যুগ তখন রমরমা। ভিসিডি ভাড়া করে বাদেও এসব চ্যানেলের সিনেমা আর সিনেমা সংক্রান্ত খবরাখবর রাখা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। সেই যে ভালোবাসা শুরু সিনেমার প্রতি তা আজো থামেনি; আমৃত্যু থামবে বলে মনে হয় না! 

সিনেমার প্রতি এই ভালোবাসা সত্যিকার অর্থে যিনি যুগিয়েছিলেন, তিনি হলেন গত ১১ বছর ধরে কোন হিট কিংবা বলার মতো সিনেমা না দেয়া; বলিউডের বাদশা শাহরুখ খান। ভিসিডি, স্টার গোল্ড আর জি সিনেমার সৌজন্যে তার ডিডিএলজে, কুচ কুচ হোতা হ্যায়, মোহাব্বতে, দিল তো পাগল হ্যায়, বাদশা সহ প্রায় সব সিনেমা ততদিনে দেখা শেষ। একদিন হটাত করেই স্টার গোল্ড অথবা জি সিনেমায় (ঠিক মনে নেই) শাহরুখের একটা সিনেমা দেখা শুরু করলাম। সিনেমার নাম কাভি হা কাভি না।

শাহরুখের সিনেমা মানেই তিনিই সব। নায়ক বলে কথা, হবেই না কেন! কিন্তু এ কোন সিনেমা আমি দেখা শুরু করলাম! যখন অন্য সব নায়ক ভিলেন কে পিটানোর কাজে ব্যস্ত, সেখানে তিনি নিতান্তই একজন লুজারের চরিত্রে। যার কাছ থেকে সবকিছু হারিয়ে যায় হাতের মুঠোয় রাখা বালির মতো। তখনকার সময়ে এমন কনসেপ্ট স্রোতের বিপরীতে হলেও, যখন পর্দায় শাহরুখ আসেন; তখন তার অভিনয় দক্ষতা আর একপ্রেশনে কিছু একটা ছিলো, যা প্রত্যেক কে বলতে বাধ্য করে ‘দেয়ার ইন সামথিং এবাউট দিজ গাই’। 

তবু তিনি স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন লুজারের চরিত্র করলেন। নায়ক হয়েও প্বার্শচরিত্রে পরে রইলেন এক কোণে। বলিউডের সিনেমার ইতিহাসের অল্প যে কয়েকটা সিনেমা আছে যেখানে হিরো একজন সর্বস্বহারার চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম ‘কাভি হা কাভি না’। কথাটা হয়তো আহামরি লাগবে কিন্তু বলিউডের সিনেমা সম্পর্কে জানেন তারা একমত হবেন এটা কতখানি! তার উপর একজন উঠতি নায়ক, আর সময়টা যখন ১৯৯৪, তখন এটা অবিশ্বাস্যই বলা যায়।

শাহরুখের নিজের কাজের মধ্যে সবচেয়ে পছন্দের সিনেমা কিন্তু কাভি হা কাভি না। এটা শাহরুখ নিজেই স্বীকার করেন। শুধু স্বীকারই না তিনি এই সিনেমার ডিস্ট্রিবিউট করেছেন। কুন্দন শাহ পরিচালিত এই কমার্শিয়াল সিনেমা আর দশটা সাধারন বলিউডি ধাঁচের ছিলো না। তাই ডিস্ট্রিউবিউটররা রিস্ক নিতে চাননি। রিস্ক নিয়েছিলেন শাহরুখ নিজেই। গল্পটা বলি… যখন ডিস্ট্রিবিউটররা এই সিনেমা কিনতে চাচ্ছিলো না তখন শাহরুখ একদিন প্রযোজক বিজয় গিলানি কে বলেন সিনেমাটা তিনি কিনতে চান। তারপর কো-প্রডিউসার হয়ে নিজের সিনেমা নিজেই কিনে নেন। মুম্বাইয়ে নিজের সিনেমার ডিস্ট্রিবিউট এর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। 

কাভি হা কাভি না সিনেমার একটি দৃশ্য

শুধু তাই নয়, একদিন গ্যাইতি সিনেমা হলে টিকেট বিক্রি করতে নিজেই বসে যান। টিকেটের সাথে থাকতো তার অটোগ্রাফ। আরেকদিন প্রযোজক কে সাথে করে চলে যান হায়দ্রাবাদে। সিনেমা চলার মাঝে পৌছে কথা বলেন হলের দর্শকদের সাথে; শুধু কথা না, এরপর বাকি সিনেমাটাও তাদের সাথে বসে দেখেন। সিনেমা মার্কেটিংটা বোধহয় শুরুর লগ্ন থেকেই জানেন শাহরুখ। শুরুতেই বলেছিলাম এটা তার নিজের করা সবচেয়ে পছন্দের সিনেমা। এতোটাই পছন্দের যে, এই সিনেমার কপিরাইটও তিনি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। 

কুন্দন শাহ যখন প্রথম এই সিনেমার কথা ভাবেন তখন লিড রোলে ছিলেন আমির আর জুহি। আর শাহরুখ ছিলেন সেকেন্ড লিডে। কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথে আমির আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এই সিনেমা করার জন্য। তখন শাহরুখ কে অফার করা হলে তিনি সানন্দে লুফে নেন। আর জুহি শিডিউল জটিলতার কারনে করতে পারেননি। তবে গেস্ট এপিয়ারেন্সে কিন্তু ঠিকই এসেছিলেন। পুরো সিনেমা করতে শাহরুখ নেন মাত্র ২৫ হাজার রুপি, যার সাইনিং মানি ছিলো মাত্র ৫ হাজার রুপি। সিনেমা সাইন করার জায়গায়টাও শাহরুখের জন্য খুবই পয়া। তৎকালীন টিউলিপ স্টার হোটেল যা জুহু সেন্টার নামেই বেশি পরিচিত। আর এখানেই ‘দিওয়ানা’ সিনেমারও মহরতও হয়েছিলো।

৩৯তম ফিল্মফেয়ারে শাহরুখ এই সিনেমার জন্য বেষ্ট সমালোচক সেরা অভিনেতার খেতাব জয় করেন। সিনেমাও সমালোচকদের দৃষ্টিতে সেরা ছিলেন। তবে মজার ব্যাপার হলো সেই একই অনুষ্ঠানে বাজিগর সিনেমার জন্যও সেরা নায়কের ফিল্ম ফেয়ার জিতেন শাহরুখ। যদিও বাজিগর আর ডর সিনেমার পরে রিলিজ হয়েছিলো। ইদানীং যখন সাউথের সিনেমা বলিউডে রিমেকের ছড়াছড়ি হচ্ছে। তৎকালীন সময়ে শাহরুখের এই অবিখ্যাত সিনেমা সাউথে রিমেক হয়েছিলো ‘স্বপ্নলোকাম’ নামে। যেখানে অভিনয় করেছিলেন জগপতি বাবু।

আজকে ২৭ বছর পূর্ণ হলো এই সিনেমার। যতীন-ললিতের মিউজিকে, কুমার শানুর গাওয়া ‘অ্যায় কাশ কে হাম’ আর ‘ও তোহ হ্যায় আলবেলা’ এখনো প্লেলিস্টে বাজে। সুনীলের সেই অসহায় চাহনি এখনো চোখে ভাসে। কাভি হা কাভি না সিনেমার কথা বলতে গিয়ে সিনেমার আশেপাশের কথাই অনেক বলে ফেললাম। কারণ হিসেবে যদি বলি, এখনো অনেকেই আছেন শাহরুখের এই সিনেমা দেখননি। শাহরুখের এতো জনপ্রিয় সিনেমার ভিড়ে তারই সবচেয়ে বেশি প্রিয় সিনেমাটি হয়তো অনেক শাহরুখ ভক্তেরও দেখা হয়ে উঠেনি।

গত ১১ বছর ধরে হয়তো হিট কিংবা বলার মতো সিনেমা দিতে পারেননি। কিন্তু জীবনে এমন কিছু সিনেমা দিয়েছেন যার জন্য আজীবন মনের মধ্যে রাজত্ব করবেন। তেমনি একটা সিনেমা হলো, কাভি হা কাভি না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা