ক্যারেক্টার আর্টিস্টরা কখনও ভাইরাল হন না, হলেও বিতর্কিত কারণে, কাজ নিয়ে নয়। তাদের নিয়ে চর্চা হয় না, আলোর রোশনাই এসে পড়ে না তাদের ওপর।

নায়ক-নায়িকা নয়, ভিলেন বা প্রভাবশালী কোন চরিত্রেরও নয়। একটা সিনেমায় অগুরুত্বপূর্ণ রোলে যে মানুষগুলো অভিনয় করে, ভিলেনের পেছনে দাঁড়ায়, নায়কের হাতে মার খায়, গুলি খেয়ে মরে যায়, ক্ল্যাইম্যাক্স সিনে পুলিশের ইউনিফর্ম পরে 'হ্যান্ডস আপ, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না'- বলে ডায়লগ দেয়, সেরকম একটা মানুষের গল্প। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে ৪৯৯টা সিনেমায় চেহারা দেখিয়ে ফেলেছে অভিনয় ছেড়ে দেয়া লোকটা। এই তথ্য যেদিন সে জানতে পারলো, তার পরেই ইচ্ছেটা এসে হাজির হলো তার মনের বারান্দায়- সিনেমার সংখ্যাটা পাঁচশোতে নেয়ার জন্যে আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে সে। এবার আর 'পাসিং শট' বা ক্যারেক্টার আর্টিস্ট নয়, একটু বড় রোলে, গুরুত্বপূর্ণ কোন চরিত্রে!

কামিয়াব- ছোট্ট একটা শব্দ, মানেটা অনেক বড়। সফলতার সংজ্ঞা কী আসলে? সুপারস্টার নায়কের জন্যে বছরের পর বছর ধরে দর্শকের মনে আর বক্স অফিসের পাতায় রাজত্ব করাটা হয়তো সফলতা। কিন্ত ক্যারেক্টার আর্টিস্টের জন্যে? যারা সিনেমাপাড়ায় 'আলু' হিসেবে বিবেচিত হয়; আলু যেমন সব তরকারীর সঙ্গে যায়, ক্যারেক্টার আর্টিস্টরাও তেমনই রোমান্টিক-কমেডি-থ্রিলার-ফ্যামিলি ড্রামা কিংবা খান-কাপুর-কুমার সবার সঙ্গেই মানিয়ে যান। একটু ভালো রোল, আরেকটু বেশি স্ক্রিনটাইম, ভিলেনের সাগরেদের বদলে নায়কের বন্ধুর চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ, পারিশ্রমিক একটু বেড়ে যাওয়া- এটুকুই তাদের জন্যে বিশাল সাফল্য। কিন্ত সবার ভাগ্যে কি সেই সাফল্য জোটে?

সঞ্জয় মিশ্র লোকটাকে যত দেখি, তত অবাক হই। কোন চার্ম নেই, গ্ল্যামার নেই, স্পেশাল মনে হওয়ার মতো আহামরি কিছুই নেই তার মধ্যে। তবুও তিনি স্পেশাল, ক্যামেরাটা ওপেন হলে অন্য একটা জগতে ঢুকে যান এই লোক, কিংবা ক্যামেরার দুনিয়াটাকেই নিজের ভূবন বানিয়ে ফেলেন। সিনেমার নাম 'আঁখো দেখি' হোক, 'মাসান' হোক, 'অ্যাংরেজি মে ক্যাহতে হ্যায়' হোক অথবা হোক 'কামিয়াব'- প্রতিবার, প্রতিটা রোলে তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন।

প্রতিটা রোলে নিজেকে উজাড় করে দেন সঞ্জয় মিশ্র

স্ক্রিনটাইম, চরিত্রের গুরুত্ব- এসব কোন ব্যাপার না সঞ্জয় মিশ্র'র কাছে। গোলমাল সিরিজের 'বাবলি' বা অল দ্য বেস্টের 'রঘু' চরিত্রে তিনি যতটা চিত্তাকর্ষক, ঠিক ততটাই সাবলীল 'কাড়ভি হাওয়া'র হেদু বা নিউটনের ওই ছোট্ট ক্যামিও রোলে। এই ভদ্রলোক গোটা শরীর দিয়ে অভিনয় করেন, এনএসডি প্রোডাক্ট, অথচ প্রায় পুরোটা ক্যারিয়ারজুড়ে ক্যারেক্টার আর্টিস্টই থেকে গেলেন, স্টার হওয়া আর হলো না।

অনেক প্রতিভার দামই বলিউড ঠিকঠাক দিতে পারেনি। তালিকা করলে দীপক দোবরিয়ালের নামটা ওপরের দিকেই থাকার কথা। ওমকারা, তানু ওয়েডস মানু সিরিজ, হিন্দি মিডিয়াম, অ্যাংরেজী মিডিয়ামের মতো সিনেমায় দারুণ সব কাজ করেও তিনি উপেক্ষিত। এই দুই 'বাতিলের' যুগলবন্দীতেই কামিয়াবের গল্পটা এগিয়ে গেল তরতর করে। দুই ঘন্টার সিনেমা শেষে মনে হলো, একটা সেকেন্ডও অপচয় হয়নি। গল্পের বুনন, অভিনয়, আবহ সঙ্গীত, পরিচালনা- সব মিলিয়ে পারফেক্ট একটা প্যাকেজ। বঞ্চিত আর পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে এমন গল্প বলিউড এর আগে কখনও বলেনি, ভবিষ্যতেও কবে বলবে ঠিক নেই।

সঞ্জয় মিশ্র'র পাঁচশো নম্বর ফিল্মের আকাঙ্ক্ষার সাথে এসে মিশছে ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস আর জাব কোয়ি বাত বিগাড় যায়ে। প্রবীণ এক অভিনেতার ফিরে আসার চেষ্টা মিলে যাচ্ছে উঠতি এক তরুণীর একটা ব্রেক পাওয়ার চেষ্টার সঙ্গে- একটা অসমবয়েসী বন্ধুত্ব, কিংবা ভরসার জায়গা তৈরী হচ্ছে কোথাও- সেটা কিন্ত রোমান্টিক কোন আবহে নয়। সমান্তরালে চলছে জীবনের গল্প, পরিবারের গল্প, কাজ আর শুটিংয়ের গল্পও। ৫০০- একটা সংখ্যা বা মাইলফলক নয় শুধু, একটা স্বপ্নেরও নাম। সেই স্বপ্ন পূরণ হবে কি?

দিনশেষে লোকে নায়ককে মনে রাখে, নায়কের পেছনে কে দাঁড়িয়েছিল, সে কয়টা সিনেমা করেছে, কী তার অর্জন- এসব মনে রাখতে দর্শকের বয়ে গেছে! নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী আজকের জায়গায় না এলে কে মনে রাখতো মুন্নাভাই এমবিবিএসে তার ওই পকেটমারের রোলটা? কিংবা সারফারোশে আমির খানের হাতে তার মার খাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপটা কি ভাইরাল হতো কখনও? ক্যারেক্টার আর্টিস্টরা কখনও ভাইরাল হন না, হলেও বিতর্কিত কারণে, কাজ নিয়ে নয়। তাদের নিয়ে চর্চা হয় না, আলোর রোশনাই এসে পড়ে না তাদের ওপর।

ক্যারেক্টার আর্টিস্টরা কখনও ভাইরাল হন না

ক্ল্যাইম্যাক্স সীনটা অনেকদিন মনে গেঁথে থাকবে। এমন প্রত্যাশিত, কিন্ত নজরকাড়া এন্ডিং খুব বেশি দেখা যায় না। দশ সেকেন্ড আগেও সঞ্জয় মিশ্র'র পারফরম্যান্সে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখ আচমকা ঘুরে যাচ্ছে, নায়কের আগমনে সবটুকু আলো চলে যাচ্ছে তারকার দিকে, মঞ্চে পর্দা নামছে, মাঝখানটায় পড়ে আছেন ক্যারেক্টার আর্টিস্ট, তার দিকে তাকিয়ে আছে শুধু তার পরিবারের তিন সদস্যই। একজন ক্যারেক্টার আর্টিস্টের পুরোটা জীবনের একটা পোর্টফোলিও কি আঁকা হয়ে গেল না ওই কয়েকটা সেকেন্ডে?

শাহরুখ খানের রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট 'কামিয়াব' সিনেমাটা প্রযোজনা করেছে, 'আঁখো দেখি' আর 'অ্যাংরেজি মে ক্যাহতে হ্যায়' এর পরে এই সিনেমা দিয়ে আরও একবার সঞ্জয় মিশ্র ফিরেছেন লিড রোলে। যতোক্ষণ পর্দায় ছিলেন, প্রশান্তি ছড়িয়ে গেছেন, মুগ্ধ করেছেন। ছোট-বড় প্রতিটা চরিত্রই দারুণ পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে, এই সিনেমার ক্যারেক্টার আর্টিস্টরাও হতাশ করেননি কোথাও। পরিচালক হার্দিক মেহতার প্রথম সিনেমা এটা, এর আগে 'ট্র‍্যাপড' মুভির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন তিনি, লুটেরা, মওসুম, কুইনের মতো সিনেমার স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজর হিসেবেও কাজ করেছেন।

অন্যদের সিনেমা প্রযোজনার বেলায় শাহরুখ সেরাটাই বেছে নেন, অথচ নিজের সিনেমা বাছতে গিয়ে কেন আবর্জনায় হাত দেন- এই প্রশ্নের উত্তর তিনিই ভালো দিতে পারবেন!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা