
দারুণ প্রতিভাবান এবং মেধাবী একটা মানুষ কি করে বিষাক্ত মানসিকতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন, ক্ষমতাবানদের পদলেহন করে টিকে থাকার নোংরা খেলায় মেতে উঠতে পারেন- সেটার একটা চমৎকার কেস স্টাডি হতে পারেন কঙ্গনা রনৌত...
দারুণ প্রতিভাবান এবং মেধাবী একটা মানুষ কি করে বিষাক্ত মানসিকতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারেন, মিথ্যা গুজব রটিয়ে ঘৃণা ছড়াতে পারেন, ক্ষমতাবানদের পদলেহন করে টিকে থাকার নোংরা খেলায় মেতে উঠতে পারেন, সব ব্যাপারে অযথা অযাচিতভাবে নাক গলিয়ে নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন- সেটার একটা চমৎকার কেস স্টাডি হতে পারেন কঙ্গনা রনৌত।
হেট স্পিচ ছড়ানোর দায়ে টুইটার আজ কঙ্গনা রনৌতের একাউন্ট স্থায়ীভাবে বাতিল করেছে। এর আগেও স্বল্প সময়ের জন্য তার টুইটার একাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়েছিল, তার বিতর্কিত টুইট মুছে দেয়া হয়েছিল। কিন্ত তাতে কঙ্গনা দমলে তো? তার মুখ বন্ধ করে, এমন সাধ্য কার! তিনি আবার টুইট করেই টুইটার বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তখন! বলিহারি বটে!
কিন্ত কঙ্গনার সমস্যাটা আসলে কোথায়? কেন তিনি সবার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছেন? শাবানা আজমী থেকে করণ জোহর, মহেশ ভাট থেকে আলিয়া ভাট, কিংবা মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধ্বব ঠাকরে থেকে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দোপাধ্যায়- কেউ কেন রেহাই পাচ্ছেন না তার বিষবাক্য থেকে?
কঙ্গনা এমনিতেই প্রচুর বেঁফাস কথাবার্তা বলেন, ব্যক্তি আক্রমণ করতে গেলেও সীমা ছাড়িয়ে যান। গত দুই বছর ধরে নিজের টুইটার হ্যান্ডেলটি নিজেই ব্যবহার করছেন, ব্যক্তি আক্রমণকে আরও কদর্য একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন তিনি এই সময়ে। ভারতের রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপির একনিষ্ঠ অনুসারী তিনি, একারণে যখন তখন বিজেপির বিরোধীদের নিশাণা করে আক্রমণ হানেন।

এটুকুতে খুব একটা ক্ষতি ছিল না। যে কোন মানুষের রাজনৈতিক আইডিওলজি থাকতেই পারে, তার পছন্দের রাজনৈতিক দল থাকতে পারে, এমনকি তিনি নিজেও রাজনীতি করতে পারেন। এটা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্ত কঙ্গনা সেই অধিকারের এমনই অপব্যবহার করেছেন, সেটা ভাষায় প্রকাশেরও অযোগ্য হয়ে উঠেছে কখনও কখনও। নোংরা ভাষায় তিনি আক্রমণ করেছেন বিরোধী পক্ষকে, তাদেরকে পাকিস্তানী এজেন্ট বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা কেউ করলে তাকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, অথচ নিজেকে ভারতের সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক হিসেবে দাবী করা কঙ্গনার সিনেমাই পাকিস্তানে মুক্তি পাচ্ছে, সেখান থেকে টাকা আয় করছে- তখন তিনি স্বার্থের টানে শীতনিদ্রায় বসে থাকেন!
কঙ্গনা তার বিতর্কিত মন্তব্যের সূত্রপাত করেছিলেন নেপোটিজম ইস্যুকে কেন্দ্র করে। এই নেপোটিজমের ভুক্তভোগী ছিলেন তিনি, এর প্রতি তার বিতৃষ্ণা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু নেপোটিজমের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি যেভাবে সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার ইস্যুটিকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, নিজের প্রতিপক্ষদের সুশান্তের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তুলোধোনার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা স্বাভাবিক নয়।
একইভাবে শুধুমাত্র তার পছন্দের রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করেন বলেই যাকে তাকে গালাগালি করা, আরবান নকশাল, জঙ্গী, ভারতের শত্রু- ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করাটাও কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষের কাজ নয়। দিল্লির শাহীনবাগে যখন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় হাজার হাজার নারী জমায়েত হয়েছিলেন, তাদের পতিতা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন কঙ্গনা।

একইভাবে কিছুদিন আগে কৃষক আন্দোলনের সময় পাঞ্জাব থেকে ট্রাক্টরে চড়ে দিল্লির সীমান্তে আন্দোলনে অংশ নিতে আসা নারীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, এদের ১০০ রূপি দিলেই ভাড়া খাটতে চলে আসে! নিজেকে নারীবাদ আর নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দাবী করা একজনের মুখের ভাষা যে এত জঘন্য হতে পারে, সেটা কঙ্গনা না থাকলে জানা হতো না। এসব করে তিনি ওয়াই ক্যাটাগরির সিকিউরিটি পাচ্ছেন, ভবিষ্যতে হয়তো রাজ্যসভার আসনও বাগিয়ে নেবেন, কিন্তু মানুষের মনে যে চিরস্থায়ী ক্ষত তিনি তৈরি করে চলেছেন, সেগুলোর উপশম তো করা যাবে না কখনও।
কঙ্গনা যেটা করেন, সেটা হচ্ছে বিজেপির উদ্দেশ্য কায়েম করা। কোন একটা বিতর্ক চলার সময় তিনি আলটপকা মন্তব্য করে গোটা ব্যাপারটাকে খেলো করে দেন, ইন্ডিয়ান মিডিয়াও তাকে ফুটেজ দিয়ে আলোচনায় রাখে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কঙ্গনার পছন্দের দল বিজেপিকে উড়িয়ে দিয়ে ভূমিধ্বস জয় পেয়েছে মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস, এই ক্ষোভে তিনি মমতাকে রাবণের সঙ্গে তুলনা করেছেন, বলেছেন, বাংলাদেশী আর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোটেই নাকি জিতেছেন মমতা। যে কথা বিজেপির কারো মুখে আসেনি, টুইটারে সেটিই উচ্চারণ করেছেন কঙ্গনা। এই মহিলাকে মস্তিষ্কবিকৃত ছাড়া আর কি বলা যায়?
অসাধারণ একজন অভিনেত্রী কীভাবে শুধু নিজের মুখটা জায়গামতো বন্ধ রাখতে না পেরে নিজের ইমেজটাকে হাস্যকর একটা প্রতিমূর্তিতে পরিণত করেন, সেটার উদাহরণ কঙ্গনা। তার নামটা কিংবদন্তীদের তালিকায় উচ্চারিত হবার কথা ছিল। কিন্তু আজ থেকে পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর কঙ্গনাকে হয়তো সবাই 'বদ্ধ উন্মাদ' কিন্তু অসাধারণ এক অভিনেত্রী হিসেবেই মনে রাখবে। শুধু প্রতিভা বা পরিশ্রমটাই যে একজন শিল্পীর জন্য সবকিছু নয়, তারও প্রমাণ কঙ্গনা রনৌত।