রিহান্নাকে কঙ্গনা বলেছেন পর্নস্টার, গ্রেটা থানবার্গকে বলেছেন দুই টাকার ভাড়াটে আন্দোলনকারী, মিয়া খলিফাকে উল্লেখ করেছেন দেহ ব্যবসায়ী হিসেবে। নিজের আখের গোছানোর জন্য কাউকে অশ্লীল ভাষায় ব্যক্তি আক্রমণ করতে যার একটুও বিবেকে বাঁধে না, তিনি কি করে নারীদের আইডল হন?

সামিরা সুদ নামের জনৈক ভারতীয় টুইটারে লিখেছেন, করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য তো ভ্যাক্সিন আবিস্কার হয়েছে, কিন্ত 'কঙ্গনা ভাইরাস' থেকে মুক্তির উপায় কী? এই ভাইরাসের কোন ভ্যাক্সিন কি দয়া করে আবিস্কার করবেন বিজ্ঞানীরা? 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার ভারতে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে শিক্ষিত এবং সচেতন নাগরিকদের একটা বড় অংশ টুইটার ব্যবহার করেন, নানা ইস্যুতে নিজেদের অনুভূতি এবং অভিব্যক্তির জানান তারা দেন এই প্ল্যাটফর্মে। কিন্ত গত কিছুদিন ধরেই কঙ্গনা রনৌত নামের উপদ্রবটিকে সহ্য করতে হচ্ছে তাদের। একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বলিউডি এই অভিনেত্রী। ক্রিকেট থেকে মহাকাশ অভিযান, নাগরিকত্ব আইন থেকে কৃষি বিল আন্দোলন, নেপোটিজম থেকে রাম মন্দির- সবকিছু নিয়েই তার মন্তব্য করতে হবে। শুধু মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না কঙ্গনা, বিরুদ্ধ মতকে আক্রমণ করছেন, ব্যক্তি আক্রমণ করে অসভ্যতার সীমা ছাড়াচ্ছেন প্রতিনিয়তই। নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই যে কাউকে গালাগালি করছেন, দেশদ্রোহী আখ্যা দিচ্ছেন, যেন কে দেশপ্রেমী আর কে দেশদ্রোহী- সেটার সার্টিফিকেট প্রদানের ভার তার ওপ্প্রেই ন্যাস্ত করা হয়েছে! 

হিমাচলের পাহাড়ি এক শহর থেকে উঠে এসে মাত্র ষোলো বছর বয়সে বলিউডে পা রেখেছিলেন কঙ্গনা। নিজের মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে রঙ্গমঞ্চের জগতে একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন, পরিণত হয়েছেন তারকায়। ফিল্মফেয়ার জিতেছেন, জিতেছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। অভিনয়টা যে তিনি দারুণ করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্ত অভিনেত্রী কঙ্গনার বাইরে গিয়ে ব্যক্তি কঙ্গনাকে মাপতে বসলেই আকাশ পাতাল তফাৎ চোখে পড়বে। ব্যক্তি কঙ্গনা এলাকার ঝগড়াটে চরিত্রটির মতো, সবার সাথেই যে সেধে সেধে ঝামেলা পাকাতে যায়। 

নতুন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে গত কয়েক মাস ধরেই ভারত উত্তাল। কৃষি বিল বাতিলের দাবীতে ভারতের নানা অঞ্চল থেকে চাষীরা এসে দিল্লির সীমানায় জড়ো হয়েছেন, তীব্র শীতে খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করে তারা প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে নিজের ঘরে আরামদায়ক পরিবেশে বসে কঙ্গনা এই কৃষকদের বিরুদ্ধে একের পর এক টুইট করে যাচ্ছেন। কখনও কৃষকদের বলছেন খালিস্তানী, কখনও বলছেন জঙ্গী, কখনও বা চীনা বা পাকিস্তানী এজেন্ট হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন। এমনকি কৃষকদের আন্দোলনকে যারা সমর্থন দিচ্ছেন, তাদেরও নোংরাভাবে আক্রমণ করছেন কঙ্গনা। 

এই হচ্ছে কঙ্গনার টুইটের ভাষা!

মার্কিন পপ তারকা রিহান্না ভারতের কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে টুইট করেছিলেন, টুইটারে কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থানবার্গ, সাবেক পর্ন তারকা মিয়া খলিফারাও। কঙ্গনা এদের সবাইকেই টুইটারে গালাগালি করেছেন ইচ্ছেমতো। রিহান্নাকে তিনি বলেছেন পর্নস্টার, গ্রেটা থানবার্গকে বলেছেন দুই টাকার ভাড়াটে আন্দোলনকারী, মিয়া খলিফাকে উল্লেখ করেছেন দেহ ব্যবসায়ী হিসেবে। কঙ্গনা আরও অভিযোগ করেছেন, কৃষকদের হয়ে টুইট করার জন্য রিহান্না নাকি আড়াই কোটি ডলার ঘুষ পেয়েছেন! 

কৃষকদের আন্দোলনে অংশ নিতে পাঞ্জাব থেকে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যেসব নারীরা এসেছেন দিল্লি বর্ডারে, কঙ্গনা তাদের উদ্দেশ্য করে টুইট করেছেন, এরা নাকি একশো রূপির বিনিময়ে ভাড়া খাটতে এসেছে এখানে! নিজেকে নারীবাদ, নারী স্বাধীনতা আর নারীর অগ্রগতির আইডল হিসেবে দাবী করেন যে কঙ্গনা, যিনি নিজেকে বলেন বলিউডের 'কুইন', তিনিই কিনা অন্য নারীদের প্রতি এমন তীব্র ঘৃণা আর আক্রোশ পুষে রাখেন! শুধুমাত্র নিজের আখের গোছানোর জন্য যে কাউকে তীব্রভাবে, অশ্লীল ভাষায় ব্যক্তি আক্রমণ করতে যার একটুও বিবেকে বাঁধে না, তিনি কি করে নারী জাগরণের আইডল হন? 

টুইটারে যেসব কদর্য ভাষা ব্যবহার করেন কঙ্গনা, সেগুলো টুইটার নিজেই সহ্য করতে পারে না সবসময়, সীমা ছাড়ানো অভব্যতা হয়ে গেলে মাঝেমধ্যেই তার টুইট ডিলিট করে দেয় টুইটার কর্তৃপক্ষই। একবার তো কয়েকদিনের জন্য তার একাউন্টই সাসপেন্ড করে রাখা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, টুইটারে বিরাট দেশপ্রেমিক সেজে যুদ্ধ করা কঙ্গনাই দুই বছর আগে বলেছিলেন, তিনি কখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করবেন না, কারণ তার ধারণা, শুধু বেকার এবং অকর্মের ঢেঁকিরাই ফেসবুক-টুইটারে বসে থাকে। সেই সূত্রমতে গত দুই বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে বেকার এবং অকর্মার ঢেঁকিটির নাম কঙ্গনা রনৌতই হওয়ার কথা! 

কঙ্গনা রনৌত

কঙ্গনার এসব হিপোক্রেসি অবশ্য নতুন নয়। গত বছর সুশান্ত সিং রাজপুত যখন আত্মহত্যা করলেন, তখন প্রথমে কঙ্গনা নেপোটিজমকে ধুয়েছেন, বলেছেন, করণ জোহর, সালমান খান সহ বলিউড বিগিরাই নাকি সুশান্তের মৃত্যুর জন্য দায়ী! সেটার প্রমাণ যখন পাওয়া যায়নি, তখন সুর পাল্টে কঙ্গনা বকবক করেছেন বলিউডের ড্রাগ সংযোগ নিয়ে। অথচ কঙ্গনার বিরুদ্ধেই তার সাবেক প্রেমিক অভিযোগ এনেছিলেন, কঙ্গনা নাকি তাকে জোর করে কোকেন নিতে বাধ্য করেছিলেন এক পার্টিতে! এসব বক্তব্য যে কঙ্গনা রাগের মাথায় দেন, এমনটা নয়। সবই স্ক্রিপ্টেড থাকে, টাইমিং করা থাকে, কখন কঙ্গনা কিছু একটা বলবেন, আর মিডিয়া সেটা নিয়ে মেতে উঠবে, মূল বিষয় থেকে ফোকাসটা নড়ে যাবে। এসব করে পদ্মশ্রী বাগিয়েছেন কঙ্গনা, পেয়েছেন জেড ক্যাটাগরির সিকিউরিটি, যেটা ভারতের বিরোধী দলীয় নেতা বা সাবেক প্রধানমন্ত্রীরাও পান না! 

কঙ্গনার প্রতিটা বক্তব্যে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দল বিজেপির সুর খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকেই বলেন, কঙ্গনা এসব করছেন শুধু বিজেপি থেকে সংসদ নির্বাচন বা রাজ্যসভার একটা টিকেট নিশ্চিত করার জন্যেই। সেটা তিনি করতেই পারেন, অনেক সাবেক ক্রিকেটার বা অভিনেতা-অভিনেত্রীই রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্ত রাজনীতিতে যোগ দেয়ার জন্য কঙ্গনার মতো এমন নোংরামির পথ বেছে নেননি কেউই। করোনার ভ্যাক্সিন তো আবিস্কার হয়েছে, কিন্ত কঙ্গনার ভ্যাক্সিন আবিস্কার হবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না কোথাও... 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা