পাঞ্জাবে বড় হয়ে ওঠা, বাবার মৃত্যু, পরিবারের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়া, মুম্বাইয়ে এসে 'কমেডিয়ান' হিসেবে স্ট্রাগল, প্রেম, বিয়ে, টুইটার কেলেঙ্কারি, মেন্টাল হেলথ, পলিটিক্যাল সারকাজম... কপিল শর্মার জীবনের বহুকিছুই ক্রমশ উঠে আসে ঘন্টাখানেকের এই বিশেষ শো'র আনকনভেনশলান সারকাস্টিক ম্যানারে! সময় যত গড়ায়, এই মানুষটিকে ঘিরে সহমর্মিতা বাড়ে। বাড়ে বিষাদও।
যদিও বলা হয়- কমেডি ইজ দ্য লোয়েস্ট ফর্ম অব আর্ট, কিন্তু তবুও লোক হাসানোই যে সবচেয়ে শক্ত, সেটাও সর্বজনবিদিত। আবার যারা এই হাসানোর কাজটি করেন, তারাও যে ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখেশান্তিতে থাকেন, এমনটাও হলফ করে বলা যায় না। চার্লি চ্যাপলিন থেকে রবিন উইলিয়ামস...পর্দায় ঠিক যতটা হাসিয়েছেন মানুষকে, ভেতরে যেন ঠিক ততটাই পুড়ে খাক হয়েছেন তারা। ব্যক্তিগত জীবনের নানাবিধ যন্ত্রণার যে জীবন তাদের, সে জীবন ক্রমশই দগ্ধ হয়েছে যাপিত নানা অসঙ্গতিতে। এমনকি, এখন যারা 'কমেডি শো' করেন কিংবা আলো-ঝলমলে মঞ্চে 'স্ট্যান্ডআপ কমেডি' করেন, তাদের জীবনও কি কণ্টকাকীর্ণ নয়? মখমলের মসৃণ পথে হাঁটার সুযোগ জীবন কি তাদের দিয়েছে কখনো? অথবা, দেবে কোনোদিন?
সাম্প্রতিক সময়ে এই উপমহাদেশে যারা 'কমেডি শো' করেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সম্ভবত কপিল শর্মা। 'কমেডি নাইটস উইথ কপিল', 'ফ্যামিলি টাইম উইথ কপিল' কিংবা 'দ্য কপিল শর্মা শো', যখনই যে নামে প্রোগ্রাম করেছেন, সেই প্রোগামকে হিট বানিয়েছেন৷ 'কমেডি' করে যে নিজের নামকে এক বড়সড় ব্রাণ্ডে রূপান্তরিত করা যায়, সেটিরই বেশ সার্থক এক উদাহরণ কপিল শর্মা। কিন্তু প্রশ্ন আসে, এই কপিল শর্মার জীবনও কি নিস্তরঙ্গ শান্তির? নাকি সেখানেও আছে অস্বস্তির চোরাবালি? এবং এই প্রশ্নগুলোর উত্তর মেটাতেই যেন কপিল শর্মা আসেন নেটফ্লিক্সের বিশেষ স্ট্যান্ড-আপ কমেডি শো 'কপিল শর্মাঃ আই অ্যাম নট ডান ইয়েট' এ।
প্রায় ঘন্টাখানেক চলা এ 'কমেডি শো'তে কপিল শর্মা কথা বলেন নিজের জীবনের বহু চড়াই-উতরাই নিয়ে। এবং সেসব চড়াই-উতরাইয়ের বয়ানটাও হয় বেশ আনকনভেনশনাল। অর্থাৎ, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়েই কথা বললেও তার কথার সুরে ক্রমশই মিশে থাকে রস-রূপক-রহস্যের একেকটা দিক। পাঞ্জাবে বড় হয়ে ওঠা, বাবার মৃত্যু, পরিবারের বিশাল দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়া, মুম্বাইয়ে এসে 'কমেডিয়ান' হিসেবে স্ট্রাগল, প্রেম, বিয়ে, টুইটার কেলেঙ্কারি, মেন্টাল হেলথ, পলিটিক্যাল সারকাজম... আনেন বহুকিছুই। যারা 'কপিল শর্মা'কে নিয়ে আগে থেকেই জানেন, তাদের কাছে এই তথ্যগুলোর কোনোটিকেই ঠিক নতুন বলে মনে হবে না৷ তবে কপিল শর্মার 'রসাত্মক' বয়ানে সে গল্পগুলো খুব যে চর্বিতচর্বণ লাগে, সেরকমও না।
কিন্তু তবুও টিভিতে যে 'কপিল শর্মা'কে দেখে আমরা অভ্যস্ত, সে 'কপিল শর্মা' যেন অনেকটাই অনুপস্থিত থাকেন এই স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান 'কপিল শর্মা'র অবতারে। তিনি যে জোকগুলো বলছেন, সেগুলোর সবগুলোই ঠিক 'কপিল শর্মা' স্ট্যান্ডার্ডের হয় না। রিহার্সালের অভাবও যেন ধরা পড়ে কিছু জায়গায়। এবং যে গল্প, যেটাকে কেন্দ্র করে পুরো কমেডি শো, সে গল্পের বিন্যাসেও রয়ে যায় বিস্তর 'যদি-কিন্তু'র আক্ষেপ। গল্পবয়ানে শৃঙ্খলার অভাব বেশ প্রকট হয়েই ধরা পড়ে। হয়তো অন্য কোনো কমেডিয়ান হলে, এই ভুলগুলো ধর্তব্যই হতোনা। কিন্তু মানুষটি কপিল শর্মা বলেই ছোট ছোট বিচ্যুতিগুলো বেশ মহীরূহ'সম হয়ে ধরা দেয় সামনে। আক্ষেপ বাড়ে।
তবে এটুকু আক্ষেপ যদি সরিয়ে রাখা যায়, তাহলে 'কপিল শর্মা'র জীবনগল্পের যে নির্যাসটুকু পাওয়া যায় এই শো থেকে, সেই নির্যাসে উপলব্ধির ক্ষেত্র থাকে বিস্তর। 'জিরো' থেকে শুরু করে কমেডি'র মাধ্যমে একজন মানুষের ন্যাশনাল ব্রাণ্ড হয়ে ওঠা, আপাতদৃষ্টিতে সফল এক মানুষের 'মেন্টাল ট্রমা' নিয়ে সংগ্রাম, পরিবারের নানাবিধ সংকটকে টক্কর দিয়ে হার না মানার বার্তা... এসবের মিলিত মিশিলে যে 'কপিল শর্মা'র প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে সমুখে, সে কপিল শর্মার জন্যে খানিকটা হলেও সহমর্মী হতে ইচ্ছে করে। পর্দার সামনে হাসিখুশি মানুষটির পর্দার পেছনের গল্পে যে বিষাদ, তা কোথাও গিয়ে আহত করে সাধারণ দর্শককেই। এবং ঠিক এভাবেই, ঝালে-ঝোলে-অম্বলে 'কপিল শর্মাঃ আই অ্যাম নট ডান ইয়েট' হয়ে থাকে এক কৌতুকশিল্পীর জীবনভর সংগ্রামেরই খেরোখাতার নিদান।