ভারতে কেন কারিনা কাপুরকে বয়কটের আহবান জানানো হচ্ছে?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

নিজে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে এক মুসলমান নায়ককে বিয়ে করার কারণে কারিনার ওপর তেতেই ছিলো বিশেষ একটা মহল। এখন আবার আরেক ঘটনায় গোঁড়া রক্ষণশীল লোকজন নোংরা আক্রমণে মেতে উঠেছে কারিনার বিরুদ্ধে। কিন্তু কারিনার দোষটা কি? নাকি সবটাই উগ্র ধর্মান্ধদের অহেতুক আস্ফালন?
সম্প্রতি ফিল্ম ক্রিটিক অনুপমা চোপড়ার করা ২০২১ সালের দশটি সেরা সিনেমার লিস্ট দেখে একটু চমকেই গিয়েছিলাম। চমকে যাওয়ার কারণ বলি। সেরা দশ সিনেমার বিশেষ এই লিস্টে নেই কোনো বলিউডি সিনেমা! বছরের পর বছর ধরে একই ক্লিশে স্ট্রাকচার আর বস্তাপঁচা কনসেপ্ট দিয়ে আর যা-ই হোক বাজার যে ধরে রাখা যায় না, তার দুর্দান্ত এক উদাহরণ বি টাউন। এখানে চোখে পড়ার মতন ভালো কোনো সিনেমা নির্মিত হচ্ছে না৷ পাশাপাশি, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন বি-টাউনের অডিয়েন্স নানা ইস্যুতে প্রতিদিন মত্ত হাতির মত উন্মাতাল আচরণ করছে। কারণে অকারণে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে তারা বিভিন্ন সিনেমার শুটিং বন্ধ করাচ্ছে। সিনেমা রিলিজে বাধা দিচ্ছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বয়কটের ডাক দিচ্ছে। মনোজ বাজপাই'র 'ফ্যামিলি ম্যান', অক্ষয় কুমারের 'পৃথ্বীরাজ' এর পর এবার এই ফ্যানাটিকদের তোপের মুখে পড়লেন কারিনা কাপুর খানও।
অলৌকিক দেশাই একটি পিরিয়ড ড্রামা ফিল্ম বানাবেন৷ 'সীতা' নামের এই সিনেমায় মহাকাব্য 'রামায়ণ'কে দেখানো হবে সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে। এটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিলো সব। গোল বাঁধলো যখন মিডিয়ায় চাউর হলো, এই 'সীতা' চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে যাওয়া হয়েছিলো কারিনা কাপুর খানের কাছে। তিনি এই চরিত্রে কাজ করার জন্যে রাজিও হয়েছেন। কিন্তু পারিশ্রমিক দাবি করেছেন ১২ কোটি রূপি। সচরাচর বিভিন্ন সিনেমায় তিনি ৬-৭ কোটির বেশি পারিশ্রমিক দাবি করেন না। তাহলে এখানে বেশি কেন?
ভস্মে যেন ঘি পড়ে গেলো এই সংবাদে। কারিনা নিজে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে মুসলমানকে বিয়ে করা নিয়ে হয়তো তেতেই ছিলো এক বিশেষ মহল। তারা যখন দেখলো এই নায়িকাই হিন্দু ধর্মের পূজনীয় দেবী চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে এরকম আকাশচুম্বী পারিশ্রমিক দাবি করছেন, তারা মওকা পেয়ে গেলো। শুরু হলো টুইটারে কারিনাকে বর্জনের ডাক। বয়কট কারিনা কাপুর হ্যাশট্যাগে গত কয়েকদিন ধরে রীতিমতো মোচ্ছব চলছে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোয়।
উপমহাদেশে তারকাদেরকে আক্রমনের যে বিধান তা মেনে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করা হচ্ছে তাকে। যার ছেলের নাম তৈমুর (ঐতিহাসিক চরিত্র তৈমুর ভারত বিজয় করতে এসে প্রচুর নিরীহ মানুষকে মেরেছিলেন। সে সাথে হিন্দুধর্ম নির্মুলের চেষ্টাও চালিয়েছিলেন), সে কিভাবে এরকম শ্রদ্ধার এক চরিত্রে অভিনয় করতে পারে, আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটিও। এর পাশাপাশি কারিনা কাপুরের স্বামী সাইফ আলী খানের 'তাণ্ডব'কেও টেনে আনছেন কেউ কেউ এই আলোচনায়। আক্রমণ করা হচ্ছে সাইফ আলী খানকেও।

আমি ঠিক বুঝতে পারি না, এই উন্মাসিক মানুষগুলো আসলে কী চায়? কে কোন চরিত্রে অভিনয় করবে কী না, কত টাকা নেবে কী না, সেটা যে অফার দিচ্ছে এবং যাকে দেয়া হচ্ছে, সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার। এখানে অন্যরা নাক গলানোর মতন এত অবাধ সময় কিভাবে পাচ্ছেন, প্রশ্ন থেকে যায় তা নিয়েও। তাছাড়া যারা 'সীতা' চরিত্রটি নিয়ে এত সংবেদনশীল, ধর্মরক্ষার মহান ক্রুসেডে তাদেরকে কেই বা নামিয়েছে? পান থেকে চুন খসলেই কেন এরকম তেড়েফুঁড়ে আসতে হচ্ছে এক বিশেষ শ্রেণির মানুষকে? মানুষ থেকে ক্রমশই বির্বতিত হয়ে আমরা কি অন্য কোনো প্রাণীতে রূপান্তরিত হচ্ছি?
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে লেখার ইতি টানি৷ গত রাতে ঢালিউডের অভিনেত্রী পরীমণি তার পেইজ থেকে স্ট্যাটাস দিলেন, তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিলো। এখন তিনি অসহায় এক সময় পার করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চান। আপনি যদি এই লেখার কমেন্ট সেকশনটা একটু স্ক্রল করেন, গা গুলিয়ে উঠবে আপনার। কদর্য মানুষের মানসিকতা খানিকটা হলেও বিব্রত করবেই আপনাকে। অদ্ভুত বিষয় হলো, ঠিক এই মানুষেরাই আবার 'ধর্ম' নিয়ে মহাপুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সময়ে সময়ে। এই মানুষেরাই আবার যৌনকাতর হয়ে অকথ্য সব ভাষায় ভরিয়ে রাখে সেলিব্রেটিদের কমেন্ট বক্স।

এসব দেখা পরে আসলেই মনে হচ্ছে ইদানীং, আমরা কি দিনদিন অমানুষে রূপান্তরিত হচ্ছি? নাকি শুরু থেকেই আমরা এরকম ছিলাম? সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে আমাদের এই ক্লেদাক্ত চেহারা যে এভাবে নগ্ন হয়ে ধরা পড়ছে সবখানে, আমাদের বিবেক কি তাতে একটুও কুন্ঠিত হচ্ছে না? আমরা কি কোনোদিন 'মানুষ' হবো না?