যদি 'পাখির চোখ' থেকে এই সিরিজকে দেখি, তাহলে এই সিরিজের যে তিন গল্প, সে তিনটি গল্পেই এমন কিছু প্রসঙ্গ এসেছে, যেগুলো এই জেনারেশনই সবচেয়ে বেশি রিলেট করতে পারবে। জৈবিক ক্ষুধার প্রেম, একা থাকার মিথ্যে আত্মগরিমা কিংবা অনুভূতির টানাপোড়েন... জানিনা এই সিরিজ দেখে কয়জন কতটুকু বুঝবে কিংবা বুঝলেও কতটুকু প্রয়োগ করবে নিজের জীবনে। তবে যদি প্রয়োগ করা যায়, তাহলে তা মঙ্গলই বয়ে আনবে বিস্তর!

কোনো একজন নির্মাতা যদি নিয়মিতভাবে ভালো গল্প বলে যাবার সামর্থ্য দেখাতে পারেন এবং সে গল্পগুলো যদি জনপ্রিয়তা এবং গুণগতমানের মানদণ্ডে উতরেও যায়, তাহলে , সে নির্মাতার কাজ নিয়ে যে আলাদা এক আগ্রহ তৈরী হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এবং বাংলাদেশে যে কয়জন নির্মাতা তাদের নির্মান-সূত্রে এরকম ভরসার ক্ষেত্র তৈরী করতে পেরেছেন এবং যাদের নির্মাণ নিয়ে আসলেই গঠনমূলক আলোচনার সুযোগ থাকে, তাদের সংখ্যা এতটাই কম যে, হাতের আঙুল গুনে বলে দেয়া যাবে তা। এবং এই নগণ্য-সংখ্যক নির্মাতার মধ্যে অন্যতম যিনি, তিনি শাফায়াত মনসুর রানা। 

সেই শাফায়াত মনসুর রানা ভালোবাসা দিবসে তিন পর্বের সিরিজ 'কে কখন কিভাবে' বানাচ্ছেন জেনে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী হয়েছিলাম। এবং এটাও ধারণা করেছিলাম-  'ভালোবাসা দিবস' এ যেমন অজস্র গতানুগতিক কাজ হয়, এসবের ভীড়ে হয়তো খানিকটা নিরীক্ষাধর্মী কাজই তিনি করবেন। এবং সিরিজের পুরোটুকু শেষ করার পর এটাই প্রাথমিক উপলব্ধি- নিরীক্ষা ও নির্মাণের যে চমৎকারিত্ব, সেখানে তিনি আপোষ তো করেননি মোটেও, বরং বিস্তর মুগ্ধ করেছেন। এবং সে মুগ্ধতার নানা বিষয়-আশয় নিয়েই কথাবার্তা এবার। 

হট প্যাটিস

'হট প্যাটিস' তো খেয়েছি সবাই-ই৷ কাঁচ-ঘেরা বয়ামের মধ্যে মুখব্যাদান করে বসে থাকা এই জাঙ্কফুড অনেকের বেশ পছন্দেরও৷ সেই 'হট প্যাটিস'ই রূপক হয়ে এলো গল্পে। আমাদের এই প্রচণ্ড যান্ত্রিক সময়ে ক্ষনস্থায়ী দেহসর্বস্ব প্রেমের যে জটিল সমীকরণ, সে সমীকরণ খানিকটা সারকাস্টিক মেটাফোরে যেভাবে আসে এক জোড়া যুবক-যুবতীর মধ্যে, চমৎকৃত হতে হয় সেখানেই। বিত্তবান এক অন্তঃসার যুবক, যার অঢেল অর্থকড়ি থাকা সত্বেও মাথায় ছটাকখানেক ঘিলুও নেই, এরকম এক অথর্ব মানুষকে কিভাবে নাস্তানাবুদ করে প্রচণ্ড বিচক্ষণ এক তরুণী, সে নিয়েই পুরো গল্প। এবং গল্পের প্রধান চরিত্রদুটিতে সালমান মুক্তাদির এবং সাবিলা নূর'কে এনে যেন গল্পের হিউমারকে বাস্তবেও প্রয়োগ করেন নির্মাতা। গল্পের স্বকীয়তা, প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিক মিশেল এবং অন্তর্নিহিত গূঢ়বার্তা... সবমিলিয়ে 'হট প্যাটিস' বেশ দারুণ।

হট প্যাটিস

ব্ল্যাক বক্স

ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা বিজ্ঞানমূলক নানা গবেষণায় 'ব্ল্যাক বক্স কনসেপ্ট' এর কথা বহুবার শুনেছি। পরে জেনেছিলাম, মনস্তত্বেও 'ব্ল্যাক বক্স থিওরি' বলে এক বিষয় আছে। সেই থিওরি অনুসারে এই যে নাটক, এ নাটক দেখার আগে 'ব্ল্যাক বক্স থিওরি' নিয়ে একটু পড়াশোনা করে এলে নাটক দেখার তৃপ্তি বেড়ে যাবে কয়েকগুণ৷ গল্পে যেমনটা দেখি- অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রেমিককে ফেলে নিশ্চিত ভবিষ্যতের এক ছেলের দিকে পা বাড়ায় প্রেমিকা। প্রেমিক ভাবে সেও হয়তো সামলে উঠবে সব। দু'জনেই উপরে উপরে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিন্তু ভেতরে কী চলছে- তা 'ব্ল্যাক বক্স' থিওরির মত থেকে যায় তাদেরই কাছে, একান্ত নিভৃতে৷ যদিও গল্পটা আরেকটু বড় হতে পারতো, আরো কিছু অনুষঙ্গ যুক্ত হতে পারতো, তাহলে সন্তুষ্টির ক্ষেত্র আরো বিষদ হতো৷ তবুও যতটুকু এলো, তাতেও অসন্তুষ্টি নেই৷ ইয়াশ রোহান এবং সামিরা খান মাহি অল্পসময়ে খুব একটা খারাপও করলেন না। সবমিলিয়ে ছিমছাম, উপভোগ্য। 

ব্ল্যাক বক্স

অপ্রকাশিত

এই যে বিক্ষুদ্ধ সময়, এই সময়ে আমরা সবাই-ই কেন যেন দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাই, 'অসামাজিক' হতে চাই, জনতার মাঝে নির্জনতা চাই। প্রযুক্তি, মহামারী কিংবা মানসিকতা... সবকিছুর মিশেলে এমন এক সময়ে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, 'একা থাকাই শান্তি' কিংবা 'আমি আমার মতই ভালো আছি' নামক কিছু মিথ্যে ন্যারেটিভের গিমিকে বুঁদ হয়ে আমরা ভুলেই গিয়েছি পারস্পরিক সহাবস্থান মানে কী, প্রচণ্ড দমবন্ধ সময়ে অন্যের হাত শক্ত করে ধরার তৃপ্তি কী, একজন মানুষের সুখ-অসুখের সাথে নিজেকে জড়ানোর অর্থ কী। এই সব যাপিত টালমাটাল ভাব-বুদ্বুদকে এক বোতলে বন্দী করার গল্পই 'অপ্রকাশিত।' যে গল্পে ইরফান সাজ্জাদ এবং ফারিয়া ফারিন প্রোটাগনিস্ট, যাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যেখানে একজন একা থাকতে চায়, আরেকজন চায় মিলেমিশে থাকতে। গল্পে হুট করে আসে বিচ্ছিন্ন এক চমক৷ সে চমকে পালটে যায় 'জীবন' নিয়ে একেকজনের সংজ্ঞা, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি। নাটক এগোয়। খানিকটা প্রত্যাশিত চমক হলেও খুব একটা খারাপও লাগে না সবমিলিয়ে। 

অপ্রকাশিত

যদি 'পাখির চোখ' থেকে এই সিরিজকে দেখি, তাহলে এই সিরিজের যে তিন গল্প, সে তিনটি গল্পেই  এমন কিছু প্রসঙ্গ এসেছে, যেগুলো এই জেনারেশনই সবচেয়ে বেশি রিলেট করতে পারবে। জৈবিক ক্ষুধার প্রেম, একা থাকার মিথ্যে আত্মগরিমা কিংবা অনুভূতির টানাপোড়েন... জানিনা এই সিরিজ দেখে কয়জন কতটুকু বুঝবে কিংবা বুঝলেও কতটুকু প্রয়োগ করবে নিজের জীবনে। তবে আহমদ ছফা যেমন বলেছিলেন- প্রত্যেক শিল্পীরই দায় আছে, নিজের সময়কে গল্পে বলে যাওয়ার, নির্মাতা শাফায়াত মনসুর রানা যেন ঠিক সেভাবেই তার নির্মাণে এই অস্থিতিশীল সময়কে বলার আপ্রাণ চেষ্টাই করেছেন। এবং ঠিক সে কারণেই, তিনি আলাদা এক ধন্যবাদের যোগ্য দাবীদার। এবার যদি দর্শক-প্রসঙ্গে আসি, এই নির্মাণ থেকে কে কতটুকু নেবে অথবা নেবে না, এবং ভেতরে তা ধারণ করবে কিংবা করবে না, তা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত বিষয়৷ সেখানে কারো হাত নেই। তাই সেসব নিয়ে কথা না বলাই সমীচীন৷ তবে এটুকু বলাই যায়, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলে এ নির্মাণ থেকে প্রাপ্তি হতে পারে বহুকিছু। তবে শর্ত একটাই, গভীর মনোযোগ! এবং সেটুকু কয়জন দেবেন, বিস্তর প্রশ্ন সেখানেই। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা