কিয়ানু রিভস: মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়ে চলেছেন যিনি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

হয়তো আচমকাই চলে গেলেন কোনো আইসক্রিম শপে। সবার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম কিনলেন৷ হট্টগোলের মাঝে বসে তৃপ্তি নিয়ে আইসক্রিম খেলেনও। তখন ভাবলে বিস্ময়বোধ হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, যাকে 'মার্ভেল স্টুডিওস' এখন পর্যন্ত তাদের প্রায় প্রত্যেকটি সিনেমাতেই সুপারহিরো হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে! এই মানুষটিই সে মানুষ, যিনি হলিউডের প্রভাবশালী সুপারস্টারদের মধ্যে প্রধানতম...
পৃথিবী দিনদিনই উত্তপ্ত হচ্ছে। সে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হোক, গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে হোক অথবা প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে হোক৷ কমলালেবু গোলকের এই ক্রমবর্ধমান উত্তাপে এখানের অধিবাসীরাও ক্রমশ হয়ে পড়ছে অসহিষ্ণু, অধৈর্য। সবাইকে নিয়েই সবার অভিযোগ, সবাইকে নিয়ে সবার অসন্তোষ। তবে সবাই-ই যে এরকম, তাও না। এদের মধ্যেও ব্যতিক্রম আছেন। চারপাশের এত সব উত্তপ্ত মানুষের মধ্যেও একপশলা ঠাণ্ডা বাতাসের মতন এমন একজন আছেন, যিনি প্রবল বৈপরীত্যে ভরা। প্রবল ক্ষমতাবান হওয়া সত্বেও যিনি বরাবরই মাটির মানুষ। আমরা অনেকেই জানি, প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে যখন একপশলা স্বস্তির বাতাস আচমকা বয়ে যায়, সে বাতাসকে বলে লিলুয়া বাতাস। এই ক্ষমতাবান মানুষটির মানবিক নানা কাজেও সেরকম হাওয়া বয়, তবে তা লিলুয়া বাতাস না। তা পাহাড়ের বাতাস। আক্ষরিক অর্থে৷ ভাবার্থেও। এই মানুষটির বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন কিয়ানু রিভস। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের ভাষায় 'কিয়ানু' শব্দের অর্থ পাহাড় থেকে নেমে আসা হাঁড়কাপানো বাতাস। নামের মতন কিয়ানু বাস্তবেও একইরকম; শীতল একপশলা বাতাস!

খেয়াল করলে দেখা যাবে, সামান্য প্রভাব, প্রতিপত্তি, খ্যাতি হলেই আজকাল অধিকাংশ মানুষ ধরাকে সরাজ্ঞান করেন। প্রবল আমিত্বে ভোগেন। ক্ষমতার প্রবল উত্তাপে তারা নিজেরাও ঝলসান, আশেপাশের মানুষকেও দগ্ধ করেন৷ গিজগিজে ক্ষমতালিপ্সু মানুষের এ পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে সুপার সেলিব্রেটি কিয়ানু রিভসেরও হয়তো এরকম ক্ষিপ্ত, দাপুটে হওয়ারই কথা ছিলো। কিন্তু আগেই বললাম, তিনি অন্য ধাতুর মানুষ। সে কারণেই হয়তো তাকে মাঝেমধ্যেই দেখা যায় পাবলিক বাসে। গড়পড়তা যাত্রীদের মাঝে বসে আছেন, হাতে বই নিয়ে পড়ছেন, পাশের মহিলা সহযাত্রীকে নিজের সীট বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার হয়তো আচমকাই চলে গেলেন কোনো আইসক্রিম শপে। সবার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম কিনলেন৷ হট্টগোলের মাঝে বসে তৃপ্তি নিয়ে আইসক্রিম খেলেনও। তখন ভাবলে বিস্ময়বোধ হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, যাকে 'মার্ভেল স্টুডিওস' এখন পর্যন্ত তাদের প্রায় প্রত্যেকটি সিনেমাতেই সুপারহিরো হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে! এই মানুষটিই সে মানুষ, যিনি হলিউডের প্রভাবশালী সুপারস্টারদের মধ্যে প্রধানতম!
কিয়ানুর গল্প তো সবাই জানেন। তবু আরেকবার বলি। যদিও জীবনানন্দ দাস হৃদয় খুঁড়ে বেদনা না জাগাতে বলেছিলেন। সে নিষেধবাচক বার্তাকে উপেক্ষা করে জানা যাক- কিয়ানুর বয়স যখন তিন, তখন তার বাবা ত্যাগ করেন তাকে এবং তার মা'কে৷ দারিদ্র্যের কষাঘাত শুরু তখন থেকেই। পেটের তাগিদে কিয়ানু রিভস ড্রাগ বিক্রি করেছেন একসময়ে। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে জেলও খেটেছেন৷ তার মা একাধিক বিয়ে করেছেন। একপর্যায়ে মাও কিয়ানুর থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। ঠিক এভাবেই জন্মের পরে খুব অল্প সময় থেকেই কিয়ানু রিভস দেখেছেন মূদ্রার রূঢ় উল্টোপিঠ। এভাবেই শুরু।
বাবা-মা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর কিয়ানু আশ্রয় নেয় এক বন্ধুর কাছে৷ সে বন্ধুর সাথে কিয়ানুর সখ্যতা ক্রমশ বাড়ছিলো। কিন্তু সেই বন্ধুও বাঁচে না বেশিদিন। মারা যায় খুব অল্পবয়সে। কিয়ানু ভেঙ্গে পড়েন। কিয়ানুর সাথে এরপর প্রেম হয় একজনের। সেই প্রেমিকার সাথে কিয়ানু ঘরও বাঁধে। কিয়ানু ও তার প্রেমিকার ঘর আলো করে সন্তান আসার উপলক্ষ্য তৈরী হয়। কিন্তু, সে সন্তান পৃথিবীর আলোবিমুখ হয়ে গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ট্রাজেডির এখানেই শেষ না। এই ঘটনার আঠারো মাস পরে কিয়ানুর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, প্রেমিকাও গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। আমরা জানি, কয়লা প্রবল চাপে হীরকখণ্ডে রূপান্তরিত হয়। কিয়ানু রিভসের জীবনের এরকম বহুবিধ যাপিত যন্ত্রণাও হয়তো ঠিক এভাবেই তাকে পরিণত করে এমন এক মানুষে, যে হাসতে হাসতে বলেন-
এখন সম্পর্কে জড়াতে ভয় পাই।
সম্পর্কের হিসেবে তার জীবন খুব টালমাটাল। ব্যক্তিগত সম্পর্কে কাউকেই খুব বেশিদিন আগলাতে পারেননি তিনি৷ সে কারণেই হয়তো বাইরের মানুষের উপর প্রবল টান তার। একবার যেমন এক অপরিচিত অসহায় মানুষকে পৌঁছে দিলেন নিজের বাড়ির উল্টোদিকে, পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরত্বের গন্তব্যে! একবার এক ক্লাবে ঢোকার সময়ে ক্লাবের সিকিউরিটি তাকে চিনতে না পেরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো বিশ মিনিটের মতন! কিয়ানু রিভস কিছু বলেননি। চুপটি করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়েছিলেন!
যখন 'কিয়ানু রিভস' জনপ্রিয় হননি তেমন, তখন রাস্তার পাশের একদল হকি খেলোয়াড়ের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। সে বন্ধুত্ব বজায় আছে এখনও। শুটিং এর ফাঁকে সময় পেলে কিয়ানু রিভস চলে আসেন সেই বন্ধুদের সাথে হকি খেলতে৷ লস অ্যাঞ্জেলস এর কোনো অখ্যাত রাস্তার পাশের ফুটপাতে একদঙ্গল মানুষের ভীড়ে দেখা যায় এমন একজনকে, যিনি 'জন উইক' 'ম্যাট্রিক্স' এর মতন ফ্রাঞ্চাইজির প্রোটাগনিস্ট!
কিয়ানু রিভস এরকমই। ব্যক্তিগত সমুদ্রের তীব্র ঝড়ে বারংবার নাকাল হয়েছেন বলেই হয়তো ক্রমাগত ঠাঁই গেড়েছেন ভিন্ন ভিন্ন জংশনে। এই মানুষটি যেন ব্রত করেই নিয়েছেন, ব্যক্তিগত জীবনে যত প্রবল ঝড়ঝাপটার মুখোমুখি হবেন, ততই তিনি মানুষের জন্যে নিবেদিত করবেন জীবন! সে কারণেই হয়তো, ম্যাট্রিক্সের সিক্যুয়েল এর সময় নিজের পারিশ্রমিকের ৭০ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়ন দিয়ে দিলেন স্পেশাল এফেক্টস এবং মেকআপ টিমকে। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে বললেন-
এত টাকাপয়সা দিয়ে কী করবো? যা টাকাপয়সা আছে, তা যথেষ্ট।
সিনেমায় তার বিপজ্জনক স্টান্টগুলো যারা করেন, সেই স্টান্টম্যানদের জন্যে ধন্যবাদস্বরূপ একবার নিয়ে এলেন এক ডজন হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল। একবার শুনলেন, এক বিশেষ সিনেমায় কোনো একজন অভিনেতাকে আনতে হবে। কিন্তু তিনি যে পারিশ্রমিক দাবী করছেন, তা বাজেট ক্রস করে যাচ্ছে। তখন কিয়ানু রিভস নিজের পারিশ্রমিক কমিয়ে সেই অভিনেতাকে সিনেমায় আনানোর ব্যবস্থা করলেন!
মানুষের জন্যে হাত বাড়ানোর, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গল্প আরো অজস্র আছে তার। তবে সেসব নিয়ে বলার আগে, পাগলাটে কিয়ানু রিভসের গল্পও জানা যাক খানিকটা। হুটহাট করেই যে তিনি অদ্ভুতুড়ে নানা কাজ করেন, তা নেটদুনিয়ার কল্যানে সবারই জানা। একবার যেমন তিনি বসে পড়লেন ফুটপাতে। যাযাবর এক মানুষের পাশে৷ সারাদিন তার সাথে সময় কাটালেন। শুনলেন তার গল্প। একসাথে খাবার খেলেন। আশ্রয়হীন সেই মানুষের সাথে কিয়ানু রিভসের সময় কাটানোর সে ছবি ভাইরাল হলো নেটদুনিয়ায়। এরকম আরেকটি ছবি ভাইরাল হলো। যেখানে তিনি পার্কের বেঞ্চে বসে আছেন একা। হাতে এক টুকরো স্যান্ডউইচ। মাথা নিচু। পায়ের কাছে এক ধূসর কবুতর। তাঁর চোখমুখ বিষন্ন, পাণ্ডুর। যেন তাঁর সারাজীবন ফুটে উঠছে এই একটি মাত্র ছবিতেই। যে ছবির নাম হয়ে গেলো- স্যাড কিয়ানু। বিখ্যাত হয়ে গেলো অল্পসময়েই।

এই মানুষটি ঘরে থাকেন না৷ বলা ভালো, ঘরে থাকতে পারেন না৷ ঘর তাকে টানেও না। হোটেলে হোটেলেই জীবন কাটে তার। শুটিং এর ফাঁকে একটু সময় পেলে নেমে পড়েন বাইক নিয়ে। অ্যাডভেঞ্চারে। বাইক নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে বহুবার অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন৷ পাঁজরের হাড় ভেঙ্গেছেন। তবুও তাকে আটকানো যায় না। এরকম অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে যখনই যার সাথে দেখা হয়, সে যত সাধারণই হোক, তার সাথে কথা বলেন, হাত মেলান, ছবি তোলেন, অটোগ্রাফ দেন। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি সবসময় এরকম 'ডাউন টু আর্থ' কেন? হাসতে হাসতে বলেন-
কে জানে! হয়তো গ্রাভিটির জন্যে!
নীরবে নিভৃতে অজস্র কাজ করেছেন তিনি। এখনো করছেন। সেসব কাজের খবর খুব কম মানুষই জানে। বাচ্চাদের লিউকেমিয়া ক্যান্সারের চিকিৎসা ও গবেষণার জন্যে তিনি এক ফাউন্ডেশন নির্মাণ করেছেন ৬-৭ বছর আগে। এই ফাউন্ডেশনের খবর সবাই জানে, কিন্তু এই ফাউন্ডেশন যে তার, সে তথ্য তিনি খুব যত্নের সাথেই করেছেন গোপন। তিনি চান, ফাউন্ডেশন তার কাজ ঠিকঠাক করুক৷ তার নাম প্রকাশ্যে এলে/ না এলে তাতে কীই বা আসে যায়!

মনে পড়ছে স্টিফেন কোলবার্ট এর সাথে কিয়ানু রিভসের সেই কথোপকথন। যেখানে হাসতে হাসতে কোলবার্ট প্রশ্ন করেছিলেন-
What do you think happens when we die, Keanu Reeves?
একটু ভেবে কিয়ানু রিভস উত্তর দিয়েছিলেন-
I know the ones who love us will miss us.
কিয়ানু রিভস পঞ্চান্ন পার করেছেন৷ স্রষ্টার পরিকল্পনা-মাফিক তিনি আর ক'বছর বাঁচবেন, তা আমরা কেউই জানি না। কিয়ানু রিভস নিজেও জানেন না। তবে এটা আমরা জানি, এই মানুষটিকে ভালোবাসে সবাই। নিজগুণেই তিনি আদায় করে নিয়েছেন সবার সে ভালোবাসা। ভালোবাসা আদায় করার পাশাপাশি তিনি মানুষকে জীবনভর দিয়েছেন এক শিক্ষা। মানুষকে নিস্বার্থ ভালোবাসার শিক্ষা৷ এই টালমাটাল পৃথিবীর সাপেক্ষে যে শিক্ষার প্রয়োগ খুবই বিরল। অথচ পৃথিবীর সাম্যাবস্থার জন্যে যে শিক্ষার প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি জরুরি।