এখনও মানুষ সিনেমা হলে সিটি বাজাতে চায়, নায়কের ক্রোধের সাথে মেলাতে চায় নিজের আক্ষেপ। মারামারির দৃশ্যে দর্শকের রক্ত গরম হয়, দুঃখের দৃশ্যে এখনও ভেজে চোখ। অর্থাৎ, ইমোশন বহাল তবিয়তেই আছে। কিন্তু, এই ইমোশনগুলোকে ঠিকঠাক সার্কুলেট করার জন্যে যে গ্রান্ড স্টেজের দরকার, সেটাই নেই। মূলত, সেটা করাই কঠিন। এবং যে কঠিন কাজটিই করেছে 'কেজিএফ' ফ্রাঞ্চাইজি!

'কেজিএফ' এর শুরু থেকেই পরিচালক প্রশান্ত নীল বলে এসেছিলেন- এই সিনেমা হবে 'অ্যান্টি-গ্রাভিটি' সিনেমা। অর্থাৎ, আকাশে গরু উড়ুক কিংবা মাটিতে উড়োজাহাজ... যা কিছুই হোক না কেন, প্রশ্ন করা যাবেনা। দেখতে হবে। দেখে বিস্মিত হতে হবে। তা, সেটা আমরা হয়েছিও। যখন পুরোদস্তুর এক কমার্শিয়াল সিনেমা দেখার সুযোগ হয়, যুক্তিকে সেখানে 'ডু নট ডিস্টার্ব' মোড এ রেখেই দেখতে বসি।  'বাহুবলি'তে মহাকর্ষের টান থোড়াই কেয়ার করে উড়ে যাওয়া পাথর দেখে আমরা তাই প্রশ্ন করিনা। 'কেজিএফ' এর 'রকি' যখন একাই এক হাতে একশো শত্রুকে ঘায়েল করেন, আমরা তখনও মাথা খাটাই না। খাটাই হাত। তাও হাততালির জন্যে। 

কমার্শিয়াল সিনেমার সন্তুষ্টি এখানেই। মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারকে ঘরের ফ্রিজের শীতল প্রকোষ্ঠে তুলে রেখে এরপর মুখোমুখি হওয়া যায় এসব সিনেমার। নায়ক বন্দুক হাতে কয়জকে মারলো, সেটা না, বরং, নায়কের হাতে বন্দুক কেন, মূলত সেটা নিয়েই তোলা যায় প্রশ্ন। মাস অডিয়েন্সকে কানেক্ট করার মত এরকম জমজমাট পটবয়লার সিনেমার ভাঁড়ারে টান তো আছেই। তবুও সে রিক্ত ভাঁড়ারের অন্দরমহল থেকে যখন এরকম 'কেজিএফ' বেরোয়, তখন বোধহয় প্রাপ্তির গর্জন হয় বজ্রপাতের চেয়েও সশব্দ। মূলত, তখনই ওঠে শোরগোল। যেটাকে আমরা বলি 'হাইপ।' 

রকি ভাই

'কেজিএফ' মুক্তির পরে যে হাইপ উঠেছিলো, সে হাইপের প্রতিক্রিয়াতেই কি না জানিনা, সিনেমাটা সেবার খুব একটা ভালো লাগেনি। মায়ের প্রতিজ্ঞা রাখতে এক রগচটা ছেলে গণ্ডায় গণ্ডায় মানুষকে শুইয়ে দিচ্ছে, ভায়োলেন্স আর লাউড অ্যাকশনে সবকিছুর দফারফা করে যাচ্ছে... এসব খুব একটা বিস্ময়কর কিছু মনেও হয়নি। যদিও 'কেজিএফ' নামের জায়গাকে যেভাবে গ্লুমি এক কালারটোনে বিল্ড করা হয়েছিলো, সেখানে 'মৃত্যু'র উপদ্রব যেভাবে তক্কে তক্কে ওঁত পেতে ছিলো, সে অংশটুকু ভালো লেগেছিলো। সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে রকি যেভাবে পরাক্রমশালী গারুদা'কে ট্যাকটিক্যালি নিকেশ করেছিলো, ভালো লেগেছিলো সেটিও। কিন্তু, স্রেফ ওটুকুই। সবকিছু মিলিয়ে, 'কেজিএফ'কে গড়পড়তা সিনেমার চেয়ে খানিকটা অন্যরকম মনে হয়েছে। এর বেশি কিছু না। 

'কেজিএফ' এর সেকেন্ড চ্যাপ্টার মুক্তির আগে ও পরে যেভাবে আবার শোরগোল শুরু হলো, তাতে সিনেমা দেখতে বসার আগে খানিকটা তটস্থই রইলাম। আবার না মিডিওকার একটা কাজের মুখোমুখি হতে হয়। এবং, সে কারণেই, খুব একটা এক্সপেকটেশন না রেখে শুরু করলাম দেখা। এবং, মূলত, এবারেই হলো বিস্ময়। স্রেফ চমকে যেতে হলো 'কেজিএফ' এর দ্বিতীয় খণ্ডে। চমকানো ছাড়া উপায়ও বা কি? এই সিনেমার প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট যেভাবে ধরে ধরে টপ নচ ব্রিলিয়ান্স দেখালো, যে ম্যাচুউরড টোন রইলো পুরো সিনেমায়, তাতে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায়ও তো ছিলোনা মোটে! 

যেমন, গল্পের এক্সিকিউশনের এক্সিলেন্স দিয়েই শুরু করি। রকি এখন কেজিএফ এর সর্বেসর্বা। কিন্তু, যদিও তিনি সর্বেসর্বা, তবুও তিনি একজন আউটসাইডার। আর যেহেতু তিনি একজন আউটসাইডার, সেহেতু তাকে অনেকেই মেনে নিতে পারবে না। সেটাই হলো। অনেকেই অনাস্থা জানালো। এবং এই অবাধ্য মানুষদের কিভাবে রকি বশ করলেন, নিজের অধীনে নিয়ে এলেন, বিশাল বড় এক সিন্ডিকেট করলেন, এবং, পাশাপাশি চললো শত্রুদের সাথে মুখোমুখি দ্বৈরথ...সেসবের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই সিনেমা এগোলো।

'কেজিএফ-টু' এর গল্পও পুরোদস্তুর গড়পড়তা কমার্শিয়াল ফিল্মের মতই, কিন্তু এখানে আন্ডারওয়ার্ল্ড সিন্ডিকেট, গ্যাংস্টার কালচার, ভায়োলেন্সকে যেভাবে ইনকর্পোরেট করলেন পরিচালক, স্ক্রিনপ্লে অন্য লেভেলে চলে যেতে সময় লাগলো না। পাশাপাশি রইলো লাউড অ্যাকশন আর ডায়লগও। সবকিছুই ওভার দ্য টপ, কিন্তু উশখুশ করার সুযোগ রইলো না একরত্তি। 'কেজিএফ' এর গল্প আহামরি না, তা প্রশান্ত নীলেরও জানা৷ কিন্তু 'কেজিএফ' নামের যে ফ্যান্টাসি জগৎ তিনি বানিয়েছেন এবং সেখানের দন্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে যে 'রকি ভাই'কে তিনি তৈরী করেছেন, তাদের গল্প যে অভিনব স্বকীয়তায় তিনি বললেন, মূলত সেই মুন্সিয়ানাতেই ক্ষণেক্ষণে থমকাতে হলো।

দ্য বিস্ট 'আধিরা' 

ক্যারেক্টার ডেভেলপমেন্টেও রইলো চমক। যেকোনো প্রোটাগনিস্টকে গ্লোরিফাই করতে গেলে তার প্রতিপক্ষ অ্যান্টাগনিস্টকে যে হতে হয় ভীষণ ভয়ঙ্কর, সে তো সবারই জানা। কিন্তু 'রকি ভাই' এর এবারের প্রতিপক্ষ 'আধিরা'রূপী সঞ্জয় দত্ত যেন ভয়ঙ্করের সংজ্ঞাকেও ছাড়ালেন। যেভাবে পরাবাস্তব এক আবহ নিয়ে এন্ট্রি হলো তার, আগুনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ যেভাবে তিনি আবির্ভূত হলেন পর্দায়, রক্তচোখ আর ভাইকিং'দের মত ধড়াচূড়া নিয়ে যেভাবে ত্রাস সঞ্চার করলেন মুহুর্মুহু, নড়েচড়ে বসতেই হলো। 'রকি'র সাথে তার প্রথম সিনটাই এত ইনটেন্স, যদি এটাই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স হতো, হলফ করে বলা যায়, দর্শক এই সিন দেখেই নিশ্চিতভাবে হাততালির বন্যা বইয়ে দিতো! 'আধিরা'র পাশাপাশি, 'রামিকা সেন' রাভিনা টেন্ডনও করলেন প্রাসঙ্গিক অভিনয়। অন পয়েন্ট। ক্যালকুলেটিভ। 'রকি'র ক্যারেক্টার আর্ক এবারে আরেকটু স্টাবলিশ হলো। প্রকাশ রাজ, রাও রমেশ, অচ্ছুত কুমারও করলেন দারুণ। যদিও হতাশ হলাম হিরোইনের অংশে। 'রিনা' চরিত্রে শ্রীনিধি শেঠি ততটুকুই অভিনয় করলেন, যতটুকু কোনো নায়ক-সর্বস্ব সিনেমায় নায়িকারা করেন। যেহেতু তাকে নিয়ে প্রত্যাশা ছিলো খানিকটা, সেহেতু, অপ্রাপ্তির এ বিষয়টাতে হতাশ হতে হলো কিঞ্চিৎ।

'রামিকা সেন' চরিত্রে রাভিনা টেন্ডন মুগ্ধ করেছেন

তবে এসব ছোটখাটো হতাশা বেমালুম উবে গেলো সিনেমার এডিটিং আর ন্যারেটিভের চমকে৷ অ্যারিয়াল শট, ক্রস কাটিং, নন-লিনিয়ার ডার্ক ন্যারেটিভ কিংবা স্লো-মো... প্রত্যেক জায়গাতেই এ সিনেমার 'নেক্সট লেভেল' এর কাজ বিস্ময়কর রকমের সুন্দর। বিশেষ করে মুগ্ধ হলাম সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ। প্রতিটা মাইক্রো অবজেক্টস এর সাউন্ডও যেভাবে প্রাইমারি সাউন্ডের সাথে ব্লেন্ড করা হলো, তা উপমহাদেশের সিনেমা বিবেচনায় অনেকটাই বিরলতম অভিজ্ঞতা। পাশাপাশি, সিজিআই, সিনেম্যাটোগ্রাফী, কালার টোনে শুরু থেকে শেষতক যে 'বিজারে অ্যাস্থেটিজম' ধরে রাখা হলো, সে অভিজ্ঞতায় 'চক্ষু চড়কগাছ হয়নি', এমনটা যদি কেউ দাবী করেন, তাহলে তা ডাহা মিথ্যাচারই হবে। 

এবং 'কেজিএফ-টু' ঠিক এভাবে স্টোরি, ন্যারেটিভ, ক্যারেক্টার, কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট, টেকনিক্যাল সাইড... সবখানেই গ্রাণ্ড একটা অ্যাটমোস্ফিয়ার রাখলো। এবং সিনেমার ডিজাইনও এমনভাবে  করা হলো, আপার ক্লাসের অডিয়েন্স থেকে লোয়ার ক্লাস... খুশি হওয়ার রসদ রইলো সবার জন্যেই। এখানে ভাবার মত মেটাফোর যেমন রইলো, কাহিনী না বুঝলে স্পুন ফিডিং করারও ব্যবস্থা রইলো। এভাবে সব অডিয়েন্সকে কানেক্ট করা, তাও আবার একই ইমোশনাল কম্পার্টমেন্ট থেকে, তা যে কতটা টাফ জব, সেটা সচেতন দর্শকমাত্রেই জানেন। এবং এখানেই রইলো মূল ব্রিলিয়ান্স।  

'কেজিএফ টু' এর শেষে এসে আরেক পর্ব আসার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। হয়তো আসবে, হয়তো আসবেনা৷ সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু, সেসব আলোচনা ইস্তফা রেখে যদি 'কেজিএফ' এর এই দুই খণ্ডের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো, সিনেমাদুটি মিলেমিশে এটা ঠিকই বুঝিয়েছে, কমার্শিয়াল সিনেমার আবেদন ফুরোয়নি আজও। এখনও মানুষ সিনেমাহলে সিটি বাজাতে চায়, নায়কের ক্রোধের সাথে মেলাতে চায় নিজের আক্ষেপ। মারামারির দৃশ্যে দর্শকের রক্ত গরম হয়। দুঃখের দৃশ্যে এখনও ভেজে চোখ। অর্থাৎ, ইমোশন বহাল তবিয়তেই আছে। কিন্তু, এই ইমোশনগুলোকে ঠিকঠাক সার্কুলেট করার জন্যে যে গ্রান্ড স্টেজের দরকার, সেটাই নেই। মূলত, সেটা করাই কঠিন। যে কঠিন কাজ করেছে 'কেজিএফ' ফ্রাঞ্চাইজি। বানিয়েছে গ্রাণ্ড স্টেজ। সেখানে দেখিয়েছে গল্প-বয়ানের চমৎকারিত্ব। এবং, এরকম এক অসাধ্যসাধন করেই উঠিয়েছে হাইপ। মাতামাতি। শোরগোল। এবং হলফ করেই বলা যায়, 'কেজিএফ' টিম এই শোরগোল, এই হাইপ ডিজার্ভ করে। শতভাগ ডিজার্ভ করে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা