গুজবাম্প দেয়া এমন ট্রেলার কবে বানাতে পারবো আমরা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
'কেজিএফ' কিংবা 'আরআরআর' এই দুই সিনেমার পেছনে আছে বিশাল বড় এক টিম, তারা ট্রেলার দিয়ে চমকে দেবে, এটা প্রত্যাশিতই ছিলো। কিন্তু যদি সাউথের খুব গড়পড়তা সিনেমার কথাও বলা হয়, সেখানেও তারা খামতি রাখেনা ট্রেলারে। এতটাই পেশাদার তারা! 'ট্রেলার মেকিং টিম' ও 'ট্রেলার মার্কেটিং এজেন্সি' নামে আলাদা টিমই থাকে প্রত্যেক সিনেমার। তারা ট্রেলার বানিয়ে সেই ট্রেলার ইন্টারনালি সবাইকে দেখায়। সবার ফিডব্যাক নিয়ে এরপর তা প্রকাশ করে জনসম্মুখে...
'সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমা মানেই ধুন্ধুমার মারামারি আর হুলস্থুল প্রেম' এই ন্যারেটিভ থেকে যেভাবে খোদ সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মই সরে এসেছে, তা দেখলে অবাক হতে হয়৷ এমন না, দক্ষিন ভারতের সব সিনেমাতেই মারামারি আর মাসালার একচ্ছত্র আধিপত্য ছিলো। কিন্তু, অধিকাংশ সিনেমাই যে এই রেসিপি অনুসরণ করতো নিয়মিত, উপেক্ষা করার উপায় নেই সেটিও। কিন্তু মহামারীর সময়ে এবং মহামারীর পরবর্তী সময়ে যেভাবে পাল্টেছে তারা, যেভাবে পাল্টেছে তাদের গল্প বলার ধরণ, পাশাপাশি প্রযুক্তির সাথে সখ্যতা যেভাবে গাঢ় হয়েছে তাদের- তা বিস্মিত করেনি, এমন সিনেমাপ্রেমী বোধহয় নেই একজনও।
সাউথ ইন্ডিয়ান সিনেমার সৌকর্য নিয়ে কথা বলতে গেলে কয়েক খণ্ড রামায়ণ শেষ হয়ে যাবে অবলীলায়। সে বাসনাও নেই আজ। বরং, চোখ রাখি তাদের প্রমোশনাল ট্রেলারগুলোর ব্রিলিয়ান্সের দিকে৷ এটা তো ঠিক, আড়াই বছর ধরে বানানো একটা সিনেমা কীরকম ব্যবসা করবে বক্সঅফিসে, তার অনেকটুকুই নির্ভর করে আড়াই মিনিটের ট্রেলারের পারফরম্যান্সের উপরে। এবং ঠিক সে কারণেই, ভারতে 'ট্রেলার মেকিং'কে নেয়া হয় খুব গুরুত্বের সাথে। কিন্তু দক্ষিন ভারতের সিনেমায় ক্ষেত্রে এই সিরিয়াসনেসের বিষয়টা হয়ে যায় আরো এককাঠি সরেস৷ এখানে সিনেমার ট্রেলার যারা বানায়, তারা এতটাই যত্ন নিয়ে কাজটি করে, অনেক ক্ষেত্রে তা মূল সিনেমার প্রত্যাশাকেই বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
বেশিদূরে যাচ্ছি না, ক'মাস আগে মুক্তি পাওয়া 'আরআরআর' এর ট্রেলার এবং ক'দিন আগে মুক্তি পাওয়া 'কেজিএফ-টু' এর ট্রেলার দুটি যদি দেখি, তাহলেই খানিকটা বুঝতে পারা যাবে, 'কমপ্যাক্ট ট্রেলার' বলতে আসলে কী বোঝায়! 'আরআরআর' দিয়েই শুরু করি- কোমারাম ভীম এবং সীতারাম রাজু- এই দুই চরিত্র, তাদের রসায়ন কিংবা তাদের সংগ্রাম; ট্রেলারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে যেভাবে প্রকাশিত হলো, তা যারপরনাই তৃপ্তিই দিলো। অথচ বিস্ময় এটাই, অনেক কিছু বলার পরেও ট্রেলারে বলা হলোনা কিছুই। যে থমথমে আবহে এই দুই চরিত্র ক্রমশ এগোলো, ট্রেলারের বরাতে সেটা আরেকটু জমাটি পরিণতিরই ইঙ্গিত দিলো। এবং সিনেমাহলে এই ট্রেলার মুক্তির পরে এতটাই মন কাড়লো দর্শকের, মুহুর্তেই ভাইরাল হয়ে গেলো ট্রেলার! পরবর্তীতে জানা গেলো, রাজামৌলির টিম শুধুমাত্র 'ট্রেলার' নিয়েই কাজ করেছিলেন কয়েক মাস ধরে। এবং সেই শ্রম যে পণ্ড হয়নি মোটেও, তা বোঝা গিয়েছিলো ট্রেলার মুক্তির পরপরই।
এরপর এলো 'কেজিএফ টু' এর ট্রেলার। 'ট্রেলার' এর একেবারে শুরু থেকেই যে ভ্যাপসা অস্বস্তি, তা শেষমুহুর্ত পর্যন্ত বজায় রেখে যেভাবে এগোলো গল্প, প্রতিটি চরিত্র, তাদের ডায়লগ, তাদের অরা যেভাবে টুকরো টুকরো গ্লিম্পসে দেখানো হলো, মূল গল্প যে এলাকাকে ঘিরে সে এলাকাকে যেভাবে চাপা আতঙ্কের বাতাসে দেখানো হলো, ইয়াশের এন্ট্রি যেভাবে হলো, সঞ্জয় দত্তের লুক যেভাবে রিভিল করা হলো, তাদের দ্বৈরথ না দেখিয়েও যেভাবে তাদের শৌর্যবীর্যের অশুভ পরিণতি দেখানো হলো- প্রতিটিই যেন মেপে মেপে নেয়া 'কাভার ড্রাইভ' শট। একচুল বিচ্যুতি নেই। পুরোটাই ব্রিলিয়ান্ট।
'কেজিএফ' কিংবা 'আরআরআর' এই দুই সিনেমার পেছনে আছে বিশাল বড় এক টিম, তারা ট্রেলার দিয়ে চমকে দেবে, এটা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিলো। কিন্তু যদি সাউথের খুব গড়পড়তা সিনেমার কথাও বলা হয়, সেখানেও তারা খামতি রাখেনা ট্রেলারে। এতটাই পেশাদার তারা! 'ট্রেলার মেকিং টিম' ও 'ট্রেলার মার্কেটিং এজেন্সি' নামে আলাদা টিমই থাকে প্রত্যেক সিনেমার। তারা ট্রেলার বানিয়ে সেই ট্রেলার ইন্টারনালি সবাইকে দেখায়। সবার ফিডব্যাক নেয়। এরপর সেই ট্রেলারের উপর আবার কাজ করে। এভাবে করতে করতেই একসময়ে যে 'ফাইনাল কাট' আসে, সেটিই মূলত উন্মুক্ত করা হয় জনসাধারণের জন্যে।
এবার একটা দুঃসাহসের কাজ করি। সাউথ ইন্ডিয়া তাদের জায়গাতে থাকুক। চোখ রাখি বাংলাদেশে৷ আমাদের দেশের নির্মাণগুলোর ট্রেলার দেখলে একটা কথাই মনে হয় বারবার, ট্রেলার বানানোও যে একটা আর্ট, এই বিষয়টিই যেন আমাদের নিরেট খুলিতে প্রবেশ করেনি এখনও। বেশিরভাগ সিনেমার ট্রেলারেই পারলে সবটুকু গল্প বলে দেয়া, সব কৌতূহলে জল ঢেলে দেয়া, অহেতুক গান-নাচ-সংলাপ ঢোকানো- দেশীয় ট্রেলারে এসবই হয়ে এসেছে সবসময়। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা যে ভালো ট্রেলার আসে না, বিষয়টা এমন না। আসে। কিন্তু বাদবাকি ট্রেলারের দূর্বলতার তুলনায় তা এতটাই নগণ্য, সেসব ধর্তব্যে আনলেও লাভ হয়না খুব একটা। সিনেমার প্রচার ও প্রসারের জন্যে যে ট্রেলারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি, সেটাই কেন যেন এখনো ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননি এদেশের শিল্প-সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। এবং সেটাই আক্ষেপের কারণ।
নিজের দেশের ভালো কাজ নিয়ে বলার ইচ্ছে বরাবরই থাকে। কিন্তু, সুযোগটাই হয় না। সেদিন যেমন সিনেমাহলে যাওয়া হলো বাংলা সিনেমা দেখতে, গিয়ে দেখলাম, হলে সর্বসাকুল্যে দর্শক চার জন! অথচ, 'স্পাইডারম্যান: নো ওয়ে হোম' এর দিনে তিলমাত্র জায়গাও খালি রইলো না। শোনা যাচ্ছে, 'আরআরআর'ও মুক্তি পাবে বাংলাদেশে। তখনও নিশ্চিতভাবেই প্রচুর দর্শক আসবেন হলে। এবার, এই দর্শকদেরও দোষ দেয়া যাবেনা মোটেও। বহু কষ্টে অর্জিত টাকা তারা সেখানেই ব্যয় করবেন, যেখানে তার টাকা উসুল হয়ে আসবে। যেটা বাংলা সিনেমায় পাওয়া গেলে সেখানে তারা যাবেন, না পাওয়া গেলে যাবেন না। এই তো! তবে প্রশ্ন থাকেই, দর্শকদের যে অসন্তোষ, সেটা নিয়ে শিল্প-সংশ্লিষ্টরা কতটুকু ভাবেন? আদৌ কি ভাবেন? যদি ভাবেন, তাহলে কাজে তার ফলাফল কোথায়? আর না যদি না ভাবেন, তাহলে ভাবা উচিত এবার। নির্মাণে কিংবা ট্রেলারে চমৎকারিত্ব আনতে বাজেট যে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, দরকার মেধা, যত্ন ও পরিশ্রমের মেলবন্ধন; নির্মাতারা ও কলাকুশলীরা সেটা যত শীঘ্র বুঝবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন, ততই ভালো। আখেরে তাতে তাদেরই মঙ্গল। মঙ্গল আমাদেরও। প্রত্যাশাও মূলত এটাই।