পাকিস্তানের সিনেমায় একাত্তর: নিজেদের বর্বরতা কতটুকু স্বীকার করবে তারা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

পাকিস্তানের এক কমার্শিয়াল সিনেমা কি নিরপেক্ষ সত্যিটাকে স্বীকার করবে? নিজ দেশের ন্যাক্কারজনক আচরণ নিয়ে কথা বলবে? কোনো পক্ষের অন্ধ অনুসারী না হয়ে বলে যাবে ইতিহাস? এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর যদি 'না' হয়, তাহলে এই সিনেমার এসব গালগল্প 'বিজনেস স্ট্রাটেজি' বা আলোচনার মূলস্রোতে আসার গিমিক ছাড়া অন্যকিছু না মোটেও...
ইধার সো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার
বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের অন্যতম, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবরের সামনে এ লাইনগুলি লিখে রেখেছিলো পাকিস্তানিরা। তাঁর মৃতদেহের অংশাবশেষ করাচি থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর তাঁর কবরের সামনে লেখা ছিলো প্রচণ্ড অপমানজনক এ লাইনগুলো। এখানেই শেষ না। পাকিস্তানের পাঠ্যবইগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর মিথ্যাচার করা হয় আজও। ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব চলে বইগুলোতে। এখনও পাকিস্তানে কোনো শিশুর জন্মের পরে কানের কাছে আযান দেয়ার পাশাপাশি বলা হয় আরো দুটি শব্দ- বাঙ্গালিরা বিশ্বাসঘাতক। যুদ্ধের এত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও এই বিশেষ জাতি তাদের পাশব আচরণের অতীত ইতিহাসকে স্বীকার করে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হয়নি কোনোদিন। অপরাধ স্বীকার করার ন্যূনতম ভদ্রতাটুকুও দেখায় নি কখনো। বিশ্বমঞ্চের যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধকালীন ইতিহাস নিয়ে জলঘোলা করেছে। বিতর্ক বাড়িয়েছে৷
পাকিস্তানি ছেলেমেয়েরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বেড়ে উঠছে ভুল ইতিহাস ও ভুল আদর্শের পথিক হয়ে। তারা জানছে- বাঙালিরা বিশ্বাসঘাতক। তারা বিশ্বাস করছে- একাত্তরে ভারতের উসকানিতে সামান্য একটু গণ্ডগোল ছাড়া আর কিছুই হয়নি। সময় গড়িয়েছে বহুদূর। কিন্তু বরাবরই অক্ষয় থেকেছে পাকিস্তান। পাল্টায়নি তাদের বর্বর মানসিকতা ও ইতিহাস বিকৃতির আখ্যান। এ কারণেই জাতি হিসেবে পাকিস্তানকে ঠিক ভরসা করা যায় না। আস্থা রাখা সম্ভব হয় না। যে কারনে হুমায়ুন আজাদও বলেন-
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও।
সেই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক এক সংবাদে নড়েচড়ে বসলাম। সংবাদটিও চাঞ্চল্যকর- পাকিস্তানে এক কমার্শিয়াল সিনেমা নির্মিত হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধের ইতিহাস কে কেন্দ্র করে। 'খেল খেল মে' নামের এ সিনেমা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সত্যঘটনা উদঘাটনে পাকিস্তানি গনমাধ্যমের সততা-স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি একাত্তরের প্রকৃত সত্য কী, তা জানার ব্যাপারেও দেখিয়েছে আগ্রহ। এটাই বিস্ময়কর, একাত্তর নিয়ে এরকম প্রশ্ন ও আগ্রহ এর আগে আর কোনো পাকিস্তানের নির্মাণ দেখায়নি। সিনেমার ট্যাগলাইনে আরো বলা হয়েছে- সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় পঞ্চাশ বছর ধরে লুকিয়ে রাখা অবিশ্বাস, স্মৃতি ও গুজব নিয়ে কথা বলা হবে।
পাকিস্তানের দুই প্রজন্ম দেখানো হবে সিনেমায়। এক প্রজন্ম তারা, যারা নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করেছে। দ্বিতীয় প্রজন্ম তারা, যাদের কাছ থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের এ পাপের ইতিহাস সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। যারা ইতিহাসের প্রকৃত সড়ক সম্পর্কে জানে না। সিনেমার গল্প এরপর আবর্তিত হবে এক অনুসন্ধানী তরুণীকে ঘিরে, যে ইতিহাসের আসল সত্যিটা জানতে চায়। যে কারণে সে আসে ঢাকায়। সত্য উদঘাটনের জন্যে। ইতিহাসের অজানা এক অধ্যায় খুঁজে পাওয়ার জন্যে।

সিনেমা সম্পর্কে এটুকু জেনে খুব যে স্বস্তি পেলাম এমনটা বলতে পারবো না। একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস কী, তা সবাই জানে। খোদ পাকিস্তান আরো ভালোভাবে জানে। তাছাড়া নথিপত্র, ইতিহাসেও পড়ে আছে তা। একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যায় অজস্র তথ্য। তাই এখানে 'সত্য উদঘাটন' মূখ্য না। আসল ব্যাপার এটাই, নির্জলা সত্যিকে স্বীকার করে নেয়া। প্রশ্নটাও সেখানেই। পাকিস্তানের এক কমার্শিয়াল সিনেমা কি সেই সত্য স্বীকার করবে? নিজ দেশের ন্যাক্কারজনক আচরণ নিয়ে কথা বলবে? নির্মোহ, নিরপেক্ষ থেকে বলে যাবে ইতিহাস? এই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর যদি 'না' হয়, তাহলে এ সিনেমার এসব গালগল্প 'বিজনেস স্ট্রাটেজি' বা আলোচনার মূলস্রোতে আসার গিমিক ছাড়া অন্যকিছু নয় মোটেও।
'খেল খেল মে'র মুক্তির ঘোষণা আসার পরমুহুর্ত থেকেই পাকিস্তান-বাংলাদেশ সবখানেই শুরু হয়েছিলো আলোচনা-সমালোচনা। স্বাভাবিক। বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করলে সবাই একটু নড়েচড়ে বসবেই। নির্মাতা নবি কুরেশির এই সিনেমার টিজার যেন সে উত্তেজনা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখলাম টিজার। প্রায় দেড় মিনিটের এ টিজারে মাথায় বাংলাদেশের পতাকার ফেট্টি বাঁধা মুক্তিযোদ্ধা যেমন আছে, তেমনি ঢাকার কিছু টুকরো টুকরো দৃশ্যও আছে। 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর অডিটোরিয়াম' নামে এক মঞ্চ দেখানো হলো। পাকিস্তানি হানাদারের গুলিতে নিহত মানুষজনও দেখানো হলো। শেষ করা হলো কিছু প্রশ্ন দিয়ে। যেখানে বলা হচ্ছে-
কেন আমরা মিথ্যে এক অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি?কেন আমরা প্রশ্ন করছি না- আসলে কী হয়েছিলো তখন? নাকি আমরাও সে বিতর্কের গুটি হচ্ছি, যে বিতর্ক শত্রুরা তৈরী করেছে?

সত্যি কথা বলতে, এ সিনেমা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই৷ সত্যভাষণ উপস্থাপিত হলে এ সিনেমা যে 'সেন্সর' এর চৌকাঠ পার হতে পারতো না, তা তো অপাপবিদ্ধ সত্য। তাই এটুকু একপ্রকার নিশ্চিত, এ সিনেমাতেও বিস্তর ইতিহাস বিকৃতি হবে। যদিও বলিউডের অগুনতি সিনেমার সুবাদে 'ইতিহাস বিকৃতি'র এই বিষয়ের সাথে আমরা খুব ভালোভাবেই অভ্যস্ত। তবুও পাকিস্তান কিভাবে সে বিকৃতিতে সামিল হয়, সেটাই দেখার বিষয়। কতটুকু অপরাধ স্বীকার করে আর কতটুকু অপরাধ চাপিয়ে দেয়, ঘোলা জল কতটুকু পরিষ্কার করে আর টলটলে জলকে কতটুকু করে ঘোলা... সেদিকেই এখন দৃষ্টি।
সিনেমা বার্তাপ্রবাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম, তা সর্বজনবিদিত। ঠিক সে হিসেবেই 'ইতিহাস-বিকৃতি'র হতাশার পাশাপাশি খানিকটা আশাবাদীও হচ্ছি এই ভেবে, যদি সিনেমাতে ইতিহাস বিকৃতি দেখানো হয়ও, তবুও দুই একজন অনুসন্ধানী পাকিস্তানি কী থাকবে না, যারা এ সিনেমা দেখার পরপরই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্যে আগ্রহী হবে? যদি এরকম হয়, যদি এ সিনেমা কিছু মানুষকে সত্য অনুসন্ধানে আগ্রহী করে তোলে, যদি সত্যটা জানার পরে কেউ কেউ নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে খানিকটা হলেও অনুতপ্ত হন, তাহলেও সেটা কম প্রাপ্তি নয় মোটেও। আপাতত সেটুকু পেলেই বর্তে যাবো সবাই...