'বিটিএস' থেকে স্কুইড গেম: বিশ্ব কাঁপানো দক্ষিণ কোরিয়ার গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে ব্যবসা-সফল ওয়েব সিরিজ 'স্কুইড গেম' কিংবা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস, অস্কারের মঞ্চে সবকিছু ছাপিয়ে বিজয়ী হওয়া 'প্যারাসাইট' কিংবা কে-পপ স্টার ব্ল্যাকপিঙ্ক- কোরিয়ান কন্টেন্টই যে এখন নেক্সট বিগ থিং অব দ্য কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, তারা যে শাসন করতেই এসেছে এখানে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকা উচিত না আর...
দেশ হিসেবে জাপান বরাবরই এক আশ্চর্যের নাম। একসময়ের হিংস্র এ জাতি কিভাবে সময়ের ফেরে এরকম ধীরস্থির, শান্ত, কর্মপটু জনশক্তিতে রূপান্তরিত হলো, তা নিয়ে যতই জানতে পারা যায়, চমৎকৃত হতে হয়। এই জাপানের বিস্ময়কর এ পরিবর্তনের পেছনে এক আশ্চর্য সুন্দর পলিসি আছে। সে পলিসি দিয়েই শুরু করা যাক। প্রথমেই একটি প্রশ্ন। আমাদের যখন কোনো একটি যন্ত্রের প্রয়োজন হয় এবং যেটা দেশে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন আমরা কী করি? নিশ্চয়ই সে যন্ত্রটি বিদেশ থেকে কিনে নিয়ে আসি। তাই তো? কিন্তু যদি জাপানের দিকে তাকাই, দেখবো বৈপরীত্য। জাপানের যখন এমন কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হয় যেটা তাদের নেই, তারা কখনো সে যন্ত্র কেনে না। বরং সে যন্ত্র বানানোর ইঞ্জিনিয়ারকে নিজেদের দেশে নিয়ে আসে। এরপর সেই ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে যন্ত্রটি বানানো শেখে। যদি বিষয়টিকে সরলীকরণ করি, তাহলে দাঁড়ায়- আমাদের যখন মাছ খেতে ইচ্ছে করে, বাজার থেকে তখন মাছ কিনে আমরা খাই। কিন্তু জাপান মাছ না কিনে বরং মাছ কিভাবে ধরতে হয়, সেটিই শিখে নেয়।
জাপানের স্বাবলম্বী হওয়ার পেছনে এই কারণ যে মূখ্য এক ভূমিকা পালন করে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। শুধু যে স্বাবলম্বী তা না, জাপান ঠিক এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটের জন্যে নানা পণ্য বানাচ্ছে। বিক্রি করছে। লাভ করছে। মজার বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি আরেকটি বিশেষ দেশও জাপানের এই মডেল বেশ ভালোভাবে অনুসরণ করেছে। দেশটির নাম- দক্ষিণ কোরিয়া। প্রযুক্তিতে তারা আগে থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের পণ্য- স্যামসাং, এলজি কিংবা হুন্দাই এর সাথে সারাবিশ্ব কম বেশি পরিচিত। সেই দক্ষিণ কোরিয়া এবার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক বাজারে ক্রমশ ঢুকে পড়েছে। আঞ্চলিক গণ্ডি অতিক্রম করে তাদের নির্মাণ এখন নিয়মিতই জায়গা করে নিচ্ছে বিশ্বমঞ্চে। জাপানের সেই মডেল অনুসরণ করেই তারা ক্রমশ করছে অসাধ্যসাধন!
নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ওয়েব সিরিজ 'স্কুইড গেম' কিংবা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএস,অস্কারের মঞ্চে সবকিছু ছাপিয়ে বিজয়ী হওয়া 'প্যারাসাইট' কিংবা কে-পপ স্টার ব্ল্যাকপিঙ্ক... দক্ষিণ কোরিয়ান কন্টেন্টই যে এখন নেক্সট বিগ থিং অব দ্য কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রি, তা নিয়ে দ্বিমত, ত্রিমত কোনো মত থাকারই সুযোগ নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, দক্ষিণ কোরিয়ান নির্মাণের রাতারাতি এরকম জনপ্রিয়তার পেছনে রহস্য কী? প্রথম কথা, তাদের জনপ্রিয়তাকে আপাতদৃষ্টিতে 'রাতারাতি সাফল্য' মনে হলেও, এর পেছনে নির্মাতাদের পরিশ্রম বহুদিনের। কে-ড্রামা এবং কে-পপ মিউজিকের জনপ্রিয়তা আগে থেকেই ছিলো এশিয়া মহাদেশে। এশিয়া মহাদেশ বিজয়ের পরে এই কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রির মানুষজন ভাবতে লাগলেন, কিভাবে অন্যান্য মহাদেশেও এই কন্টেন্টগুলোকে পৌঁছে দেয়া যায়। নির্মাতারা এক্ষেত্রে অনুসরণ করলেন জাপানি মডেলকে। দীর্ঘ সময় ধরে হলিউড সহ বিশ্বমানের যত ইন্ডাস্ট্রি আছে, তাদের 'কন্টেন্ট মডেল' স্টাডি করলেন তারা। বছরের পর বছর ধরে কন্টেন্ট নিয়ে অ্যানালাইসিস চললো। বিদেশি নির্মাতাদের থেকে কন্টেন্ট আইডিয়া নিয়ে কোরিয়ান মডেলে সেগুলোকে ব্লেন্ড করা হলো। পরবর্তীতে সেসব কন্টেন্ট যখন বাজারজাত করা হলো, দেখা গেলো- সারা বিশ্বের দর্শক সাদরে গ্রহণ করছে নির্মাণগুলোকে।

মহামারী এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উত্থানে সংস্কৃতির কাঁটাতার তো বহু আগেই উবে গিয়েছে। পৃথিবী ক্রমশ রূপান্তরিত হয়েছে মফস্বল এক শহরে। ঠিক এরকম এক সম্ভাবনাময় সময়েই দক্ষিণ কোরিয়ান কন্টেন্ট শুরু করে বাজিমাত। এমনভাবে তারা প্রভাব বিস্তার করে, ওটিটি জায়ান্ট 'নেটফ্লিক্স' মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় ৮০টিরও বেশি দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমা-সিরিজ নিজেদের অধীনে নিয়ে নিতে বাধ্য হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নেটফ্লিক্সের সাম্প্রতিক চার্টের 'টপ টেন টিভি সিরিজ' এর তিনটিই দক্ষিণ কোরিয়ান নির্মাণ। এই এক উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, কতটা দোর্দণ্ডপ্রতাপে এখন আছে তারা!
তবে প্রচুর কন্টেন্ট বানাতে গিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান নির্মাতারা যে মানের সাথে আপোষ করছে, তা মোটেও বলা যাবে না। গত কয়েক মাসে দক্ষিণ কোরিয়ান কয়েকটি ওয়েব সিরিজ দেখেছি। রিপ্লাই ১৯৯৮, হসপিটাল প্লেলিস্ট, স্কুইড গেম, ইয়োর নেম কিংবা মাই রুমমেট ইজ আ গুমিহো... প্রতিটি নির্মাণের গল্প, আবহ, ট্রিটমেন্ট ভিন্ন। স্বকীয়। এবং গুণগতমানেও দুর্দান্ত। নির্মাণের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও মানের সাথে তারা যে আপোষ মোটেও করেনি, তা নির্মাণগুলো থেকেই দ্রষ্টব্য। এবং আরেকটি বিষয় আলাদা করে বলতেই হয়, বিদেশি কন্টেন্ট এবং কন্টেন্ট মেকারদের নিয়ে নিরলস গবেষণা ও এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে যেভাব আজকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তারা এই জায়গায় এসেছে এবং নিয়মিত তুমুল প্রতিযোগিতা করছে, তা অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির জন্যেও তীব্র অনুপ্রেরণার এক বিষয়।

সাউথ কোরিয়ার কালচারাল সেক্টর খুব যে উন্নত, সেটা বলারও সুযোগ অতটা নেই। তবুও সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারই নিশ্চিত করেন তারা। এবং সীমিত রসদ নিয়েই তারা যেভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন, তার স্বপক্ষে কিছু উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারা যাবে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি এখন পর্যন্ত ২৬টির মতন কোরিয়ান ওয়ার্ড তাদের নথিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। শুধুমাত্র কোরিয়ান ভাষা শিখে কোরিয়ান কন্টেন্ট দেখার জন্যে ভারত সহ বহুদেশে 'কোরিয়ান ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র' গুলোতে বিস্তর চাপ আসছে নিয়মিত। 'কে-পপ' নিয়ে সারাবিশ্বের উন্মাদনা কিংবা 'বিটিএস আর্মি'র ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফ্যানাটিসিজম নিয়ে সবাই-ই সবকিছু জানেন। আলাদা করে নতুন কিছু বলার নেই মোটেও। এতটা ক্রেজ আর কোনো পপ বা ব্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আছে কী না, তা প্রচণ্ড গবেষণারও এক বিষয়!
সাই এর 'গ্যাংনাম স্টাইল' দিয়ে কে-পপ বৈশ্বিক এক সুনাম পেয়েছিলো। কিন্তু তা স্তিমিত হয়ে যায় কয়েক বছর পরেই। বিশ্বের নজর আবার দক্ষিন কোরিয়ার দিকে পড়ে, 'প্যারাসাইট' এর অস্কার বিজয়ের পরে। এরপরই শুরু হয় মহামারী। মানুষ গৃহবন্দী হয়। কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রির দিকে চোখ পড়ে মানুষের। নেটফ্লিক্স, ইউটিউব সহ অন্যান্য মাধ্যমের সুবাদে কোরিয়ান নির্মাতারাও তখন নিয়ে আসতে থাকেন একের পর এক নির্মাণ। আস্তে আস্তে দক্ষিন কোরিয়ার 'কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রি' 'ন্যাশনাল' থেকে পৌঁছে যায় 'ইন্টারন্যাশনাল' লেভেলে। যদিও সবকিছু স্বাভাবিক হলে কোরিয়ান কন্টেন্ট এর এই রমরমা অবস্থা বজায় থাকবে কী না, তা অনিশ্চিত বিষয়। কিন্তু যেভাবে 'কন্টেন্ট ইন্ডাস্ট্রি'কে ভালোভাবে স্টাডি করে আদাজল খেয়ে নেমেছে দক্ষিণ কোরিয়া, তারা যে খুব সহজেই মূলস্রোত থেকে বিচ্যুত হবে না, তাও এক প্রকার নিশ্চিত হিসেবেই ধরে নেয়া যায়।

ওটিটি'র এই মহাবিপ্লবের আগে থেকেই এশিয়া মহাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ান সিনেমা, সিরিজ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। অথচ সে সময়টাতে প্রশাসনের 'সেন্সরশিপ' নামে নজরদারি, বাজেটের অভাব, লোকাল মার্কেটের অদ্ভুতুড়ে সব পলিসি, বহু চলকের রাজনীতির মারপ্যাঁচে অনেক নির্মাতাই স্বাধীনভাবে গল্প বলতে পারতেন না। নির্মাণের অনেকক্ষেত্রেই নানাবিধ আপোষ করতে হতো। স্ট্রিমিং সাইটগুলোর বদৌলতে সে আক্ষেপ ফুরিয়েছে। এখন সেন্সরশিপের খুব একটা কড়াকড়ি নেই। বাজেট নিয়েও মাথাব্যথার কারণ নেই। মার্কেটিং এর জন্যে লোকাল মার্কেটের কাছে জবুথবু হয়ে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। অসীম বৈপরীত্যের মধ্যেও দুর্দান্ত সব নির্মাণ করে যাদের উত্থান, তারা এবার স্রোতের অনুকূলে যে আরো ক্ষুরধার হবে, তা প্রত্যাশা করাই যায়। সাফল্যের যে জয়রথ শুরু হয়েছে তাদের, সে রথ কতদূরে গিয়ে ইস্তফা দেয় বা আদৌ দেয় কী না, সেটাই এখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।