কেমন আছেন 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের তারকারা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বাকের ভাইয়ের বয়স হয়ে গেছে, চুলে পাক ধরেছে মুনারও। বদি চলে গেছেন না ফেরার দেশে, অভিনয়ে ব্যস্ত মজনু। বাস্তব জীবনে এখন কেমন আছেন কুত্তাওয়ালী? মামুন, বকুল, ডাক্তার সাহেব, মতি- ওরাই বা নিজ নিজ জীবনে কী করছে এখন?
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক নিঃসন্দেহে 'কোথাও কেউ নেই'। ১৯৯৩ সালে বিটিভিতে সম্প্রচারের সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের রচিত এবং বরকতউল্লাহ খানের পরিচালিত এই নাটক। কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাজপথে মিছিল হবার সেই ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো তো এখনও লোকের মুখে ঘুরে ফেরে। নাটকটি সম্প্রচারের ২৮ বছর পূর্ণ হয়েছে এবছর। তুমুল জনপ্রিয় সেই নাটকের কুশীলবেরা এখন কে কোথায় কেমন আছেন, চলুন জেনে নেয়া যাক!
আবুল খায়ের: কিংবদন্তি এই অভিনেতার মহাপ্রয়াণ ঘটে সবার আগে। বৈচিত্র্যময় সব চরিত্রে অভিনয় করা এই মানুষটি বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো উকিলের চরিত্রে অভিনয় করে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শেষের দিকে তিনি হয়ে উঠেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।
হুমায়ূন ফরিদী: ২০১২ সালে পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। যার অভিনয় দক্ষতা যুগ যুগ ধরে দর্শকদের কাছে এক বিস্ময়ের নাম। অকালে চলে যাওয়ায় আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলেছে সবাই। নাটকে যিনি উকিল হয়ে প্রানপন চেষ্টা করেছিলেন বাকের ভাইকে বাঁচানোর জন্য।
মোজাম্মেল হোসেন: তিনিও অকালে চলে গিয়েছিলেন। ২০০২ সালে মারা যান এই প্রতিভাবান অভিনেতা। যিনি আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন এই অভিনয় ভুবনকে। মুনার মামা শওকত সাহেবের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন।
সালেহ আহমেদ: চাঁনমিয়া দারোয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যাকে খুন করার মিথ্যা মামলায় বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হয়। স্বনামধন্য এই অভিনেতা অভিনয়ে নিজের আলাদা একটা স্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলেছিলেন। বেশ কয়েক বছর আড়ালে ছিলেন, পরে জানা যায় ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। নিয়তির খেলায় তিনিও মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন।
আব্দুল কাদের: বদি চরিত্রে অভিনয় করা সবার প্রিয় অভিনেতা, নাটকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে যিনি বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন। মোটামুটি অনেকদিন তিনি অভিনয় জগতে কৌতুক চরিত্রে নিয়মিত ছিলেন। সব সময় হাসিখুশি থাকা এই মানুষটিও গত বছর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
নাজমুল হুদা বাচ্চু: হুমায়ূন আহমেদের নাটক, হানিফ সংকেতের ইত্যাদির নাট্যাংশে থাকতেন। বার্ধক্যজনিত কারনে পৃথিবীকে বিদায় দিয়েছেন তিনি। নাটকে তিনি ছিলেন মুনার সহকর্মী।
শামসুজ্জামান খান বেনু: টিভি নাটকে পরিচিত অভিনেতা, নাটকে বাকের ভাইয়ের বড় ভাই। ২০০৬ সালে মারা যান।
নাজমা আনোয়ার: স্বনামধন্যা অভিনেত্রী, এক নামে সবাই চেনে। যদিও নাটকে তার চরিত্রের উপস্থিতি ছিল কম, এর মাঝেও বাহবা পেয়েছিলেন। বকুলের শ্বাশুড়ির চরিত্রে ছিলেন। ২০০৪ সালে উনি অকাল প্রয়াত হন।
মাসুদা শরিফুদ্দিন: এই নাটকের সবচেয়ে ঘৃনিত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। রেবেকা চরিত্রে অভিনয় করলেও কুত্তাওয়ালী নামে যার পরিচিতি ছিল। এই গুণী অভিনেত্রীকে পরবর্তীতে তেমন দেখা যায়নি।
মাসুদ আলী খান: টিভি নাটকের বর্ষীয়ান অভিনেতা। সম্ভবত আবুল খায়েরের পর বয়সের দিক থেকে সবার চেয়ে বড়। এখনও পৃথিবীর আলোতে আছেন, তবে বার্ধক্যজনিত কারনে বেশ অসুস্থ। নাটকে তিনি ছিলেন সবার প্রিয় দাদাজান।
খায়রুল আলম সবুজ: মামুন সাহেব, মুনার প্রেমিক। এখন বয়সের ভারে চেহারায় বার্ধক্য এসেছে, তবে অভিনয়ে এখনও নিয়মিত এই স্বনামধন্য অভিনেতা।
লাকী ইনাম: মঞ্চ, টিভি নাটকের প্রথিতযশা অভিনেত্রী। কোথাও কেউ নেই নাটকে তিনি ছিলেন মুনার মামী লতিফার চরিত্রে, যার অসুস্থতা জনিত কারনে অকাল মৃত্যু ঘটে। বাস্তব জীবনে এখন তিনি অভিনয় থেকে বেশ দূরে, তবে মিডিয়াঙ্গনে সরব।
রোকেয়া রফিক বেবী: মঞ্চকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন, টিভি নাটক করতেন কম। ইরার মায়ের চরিত্রে ধন্যাঢ্য মহিলা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। এখনো মঞ্চেই বেশি সক্রিয়।
শহীদুজ্জামান সেলিম: ডাক্তার সাহেব, বকুলের সাথে যার বিয়ে হয়। তখন বেশ পরিচিত মুখ হলেও গল্পে গুরুত্ব কম ছিল। অভিনয় জগতে বেশ আলোচিত এক অভিনেতা। সময় যত গড়িয়েছে, অভিনয়ের ব্যস্ততা তত বেড়েছে। এই মুহুর্তে একজন আস্থাভাজন অভিনেতা তিনি।
দিবা নার্গিস: প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুনের মেয়ে। এই নাটকে তিনি বদির স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন, গল্পের মোড় ঘুরাতে তার উপস্থিতি বেশ গুরুত্ব পেয়েছেন। তবে অভিনয়ে তাকে কখনোই সেভাবে পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে বিটিভির নাটকে দেখা যেত আগে, এখন একেবারেই আড়ালে চলে গেছেন।
বিজরী বরকতউল্লাহ: ধনী পরিবারের আদুরে কন্যা ইরার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। গৃ্হশিক্ষক মামুনের প্রেমে পড়েছিলেন, যার কারনে এক সময় বাধ্য হয়েই মামুন ইরাকে বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে অভিনেত্রী হিসেবে তিনি আরো নিজেকে সমাদৃত করেছিলেন। এখন অভিনয়ের ব্যস্ততা না থাকলেও বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যায়।
শীলা আহমেদ: হুমায়ূন আহমেদের কন্যা শীলা আহমেদ, নাটকে তিনি শিশুশিল্পী লীনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। খুব সুন্দর চরিত্র ছিল এটি। খুব আশা জাগানিয়া অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু অভিমানে যে অভিনয় ছেড়েছিলেন, আর এইমুখো হন নি।
টিটু: মুনাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য। তার বর্তমান অবস্থা জানা যায়নি।
তমালিকা কর্মকার: শান্তি কটেজের তিন কন্যার একজন সুমা, যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। শেষ পর্বে এসে সে হয়ে ওঠে অনন্য। তমালিকা এদেশের একজন দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে প্রমাণিত, তবে এখন প্রবাস জীবন করছেন।
তৃষ্ণা মাহমুদ: তিন কন্যার দ্বিতীয় জন হিসেবে অভিনয় করেছিলেন রুমা, ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ডাক্তার। এই নাটকের শেষ হবার কিছুদিন পড়েই পাড়ি দেন প্রবাসে। এখনো সেখানেই আছেন, অভিনয় আর করেননি।
হোসনে আরা পুতুল: ঝুমা, তিন কন্যার শেষজন। হুমায়ূন আহমেদের নাটকে বেশি দেখা যেত। অনেক বছর ধরেই অভিনয়ে ব্যস্ত ছিল, তবে এখন আর সেভাবে দেখা যায় না।
আফসানা মিমি: সবার প্রিয় বকুল চরিত্রে করা অভিনেত্রী। বেশ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল, যদিও শেষেরদিকে দেখা যায়নি গল্পের কারনেই। এই নাটকের পর থেকেই অভিনয়ে ব্যস্ততা বাড়ে, টিভি নাটকের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেত্রী একজন হয়েছেন,। পরবর্তীতে নির্মানেও এসেছিলেন, নির্মাতা হিসেবেও হয়েছেন প্রশংসিত। অনেক বছর ধরেই অভিনয়ে অনিয়মিত, তবে সুখকর সংবাদ হলো এখন আবার অভিনয়ে নিয়মিত হচ্ছেন।
মাহফুজ আহমেদ: বখাটে মতির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তখন সবেমাত্র অভিনয় শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে টিভি নাটকে একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন, সিনেমাতেও হয়েছেন প্রশংসিত। নির্মানেও সমাদৃত। বেশ কয়েক বছর ধরেই অভিনয়ে অনিয়মিত। আগে দু'একটিতে অভিনয় করলেও এখন একেবারেই দেখা যায় না।
লুৎফর রহমান জর্জ: মজনু চরিত্রে অভিনয় করে যিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে অভিনয় থেকে অনেক বছর বিরতি নিয়েছিলেন, ফিরে আসার পর দারুন আলোচিত একজন হয়ে উঠে ছিলেন। এই মুহুর্তে যাদের অভিনয় নিয়ে ভরসা রাখা যায়, তিনি তাদের একজন।
আসাদুজ্জামান নূর: নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র বাকের ভাইয়ের ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়। নাটকে যার ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিল সাধারণ দর্শকেরা। প্রায় পাঁচ দশক ধরে অভিনয় করা কিংবদন্তি এই অভিনেতা আমাদের দেশের রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বর্তমানে সাংসদ, সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী। অভিনয়ে তেমন দেখা যায় না অনেক বছর ধরেই। তবে সম্প্রতি ঊনলৌকিক অ্যান্থোলজি সিরিজের শর্টফিল্ম 'ডোন্ট রাইট মি'তে তাকে পাওয়া গেছে।
সুবর্ণা মুস্তাফা: এই ধারাবাহিক নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বর্নাঢ্য অভিনয় ক্যারিয়ারে মুনা তার সেরা প্রাপ্তি বললেও ভুল হবে না, এত দারুণ অভিনয় করেছিলেন। মুনা চরিত্র করার আগেই তিনি টিভি নাটকের সেরা জনপ্রিয়তম ছিলেন, মুনা চরিত্রে অভিনয় করে আরো মহিমান্বিত হয়েছেন। এই অভিনেত্রীকে বেশ কয়েক বছর আগে মোটামুটি অভিনয়ে দেখা যেত। তবে উনি এখন সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ, মিডিয়াঙ্গনে সরব থাকলেও সেভাবে আর অভিনয়ে দেখা যায় না।
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৯৩ সালে নির্মিত হয় এই ধারাবাহিক নাটকটি, যার চিত্রনাট্য তিনি নিজেই লিখেছিলেন। বাকের ভাইয়ের যাতে ফাঁসি না হয়,সেইজন্য চাপ এলেও অনড় ছিলেন তিনি। এই নাটকের প্রযোজক ছিলেন বরকতউল্লাহ। দুজনের কেউই আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই, রয়ে গেছে তাদের অমর সৃষ্টি। আরেকজনের কথা বলতেই হয়, তিনি মকসুদ জামিল মিন্টু। যিনি এই নাটকের এত সুন্দর আবহ সংগীত করেছিলেন, যার জন্য নাটকটি দর্শকের হৃদয়কে আরও বেশি স্পর্শ করে। বর্তমানে তিনি অনেকটাই আড়ালে আছেন, তেমন সরব নন।