যদি বলা হয় বাংলা গানের সর্বকালের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন এবং তারুণ্য ধরে রাখা সফল সংগীতশিল্পী কে? সকলেই এদিক সেদিক না ভেবে বলে দেয় তাঁর নাম- কুমার বিশ্বজিৎ।

আমাদের খুব করে মনে থাকে ছেলেবেলা, মনে থাকে সামান্য বড়বেলা, তারপর আমাদের আর কিছু মনে থাকে না। আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাই শিশুতোষ মার্বেলের মতো। যেসমস্ত দিন রঙিন হয়ে আমাদের সম্মুখে দোল খায় ডিঙ্গি নৌকোর মতো, আমরা সেইসব দিন বুকে আগলে রাখি। মনে পড়ে আগলে রাখা সেই দিনগুলোর অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল জ্বলজ্বলে কিছু গান। সেই গানগুলো আমরা হাত দিয়ে ধরে প্রেমিকার দেয়া প্রথম গোলাপের মতো একদম বুক পকেটে গুঁজে নিয়েছিলাম।

গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বুঝি ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’। সাদাকালো টেলিভিশনে সেই আশির দশকের শেষের দিকে আমাদের সামনে পেয়েছিলাম বিটিভিতে। গানটা হয়তো আরও আগের। কিন্তু আমরা সুযোগ পেলেই সেই যে চারকোণা বাক্সের সামনে বসতাম, উঠতেই চাইতাম না। তখন ঘুরেফিরে অনেক ফিলার গান চলতো। কুমার বিশ্বজিতের ওই গানটা হৃদয়ে নিয়েছিলাম সেই সময়েই। তাঁকে আরও বেশি আমাদের কাছাকাছি এনে দেন হানিফ সংকেত। নব্বই দশকের যারা দর্শক, তারা সকলেই জানে ইত্যাদি মানেই মাঝেমাঝে কুমার বিশ্বজিৎ। দলবল নিয়ে একটা বিস্তীর্ণ নদীর চরে কিংবা লাল মাটির পথে তিনি ডুগডুগি বাজিয়ে গান গাইছেন। তার পাশে পার্কেশনে আছেন আরেক বাবরি দোলানো বাদক। অভিনব সব উপস্থাপন সেই সময়েই। আধুনিকতার সর্বোচ্চ ব্যাপার গানের ক্ষেত্রে আমাদের পরিচয় করালেন তিনিই।

মনে পড়ে ছিয়ানব্বই কিংবা সাতানব্বই সালের দিকে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাচ্ছি। আঞ্চলিক কনসার্ট। স্থানীয় শিল্পীদের অনেকেই স্টেজে উঠে গান ধরতেন ‘একতারা বাজাইও না’। সেই গানে আমরা উন্মাতাল দর্শক। উল্লাসে ফেটে পড়তাম। একজন শিল্পীর একটা দুইটা গান থাকে মঞ্চ মাতানোর। কিন্তু কুমার বিশ্বজিতের গানের তালিকা দীর্ঘ। বিশেষ করে আমাদের ক্যাম্পাস লাইফে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটা আমাদের প্রাত্যহিক বেদনা ভুলবার অন্যতম গান হয়ে কাছে আসে। এই গান দাদার কণ্ঠে সরাসরি শুনবার সৌভাগ্য হয় ঢাকার এক অনুষ্ঠানে। জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে। সামনে বসে দাদার গান উপভোগ করাটা স্বপ্নের মতোই ছিল।

কুমার বিশ্বজিৎ- বাংলাদেশের গর্ব

ব্যক্তিগতভাবে গানের ক্যারিয়ার সাজাবার শুরুর দিকে আমার সাক্ষাৎ মেলে প্রয়াত সুরকার আলী আকবর রূপু ভাইর সাথে। তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। একদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন এই মহারথীর সঙ্গে। সাথে আরেকজন ছিলেন, প্রিয় গীতিকবি আসিফ ইকবাল। তাঁরা দুজন মিলে আমার গান শুনে আমাকে দেখা করতে বললেন। আমার চোখ ঝলমল করে উঠলো। এত বড় শিল্পী আমাকে বলছেন গান নিয়ে সরাসরি অফিসে যেতে। আমার রাজসিক আগমন ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের জন্যই। অবসকিউর ব্যান্ডের টিপু ভাই আমাকে ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে এসেছিলেন। পথ দেখিয়েছিলেন সামিনা চৌধুরী। তবে তার ডালপালা ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ দা। নিজ দায়িত্বে তিনি আমার অনেকগুলো গান প্রকাশে বিরাট ভূমিকা রাখলেন।

আমি ভেবেছিলাম, অনেকদিন দেখা নেই, জীবন যাপনের ব্যস্ততায় সকলেই নানান দিকে, দাদা বুঝি ভুলে গেছেন আমাকে। কী অদ্ভুত অবিশ্বাস্যভাবে তিনি মাঝেমাঝে ফোন করতেন। খোঁজ নিতেন কেমন আছি। দেখা হলেই নাম ধরে ডাকতেন। প্রশংসা করতেন আমার লেখালেখির। কিছুদিন আগে আমি আমার উপন্যাস উৎসর্গ করি দাদাকে না জানিয়ে। ভেবেছিলাম, বড়ো মানুষ, এসব ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত। তাঁকে চমকে দেবার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু দাদা ভীষণ আবেগী হয়ে গেলেন। এই ভালোবাসাকে তিনি মূল্যায়ন করলেন সেভাবে, যেভাবে সত্যিকারের ভালোবাসার মূল্য দেয় মানুষ।

কুমার বিশ্বজিৎ এর সাথে লেখক, সঙ্গীতশিল্পী লুৎফর হাসান

বেঁচে থাকতেই একজন শিল্পী মানুষের ভালোবাসা পেয়ে থাকেন তার দুই চারটা গানের জন্য, কিন্তু দুই একজন এমন থাকেন, যাদের প্রায় সব গানই শ্রোতারা মনে রাখে সমান ভালোবাসায়। ‘গতকাল ছিল তোমার জন্মদিন’, ‘তুমি ভুল করে এসেছিলে কি না জানি না’, ‘তুমি আনন্দ আশ্রম আমার মনে’, ‘দস্যু যেমন মুখোশ পরে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘ও ডাক্তার’, ‘তুমি যদি বলো পদ্মা মেঘনা’, ‘পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘তুমি রোজ বিকেলে’, ‘চতুর দোলাতে চড়ে ওই বধূ যায়’, ‘নির্বাসনে যাব না’, ‘চন্দনা গো’ ‘একটা চাঁদ ছাড়া রাত’ কত গানের তালিকা করা যায়? গানের সমুদ্র তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, তিনি এখনও গাইছেন সমান তালে। গাইছেন তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে।

যদি বলা হয় বাংলা গানের সর্বকালের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন এবং তারুণ্য ধরে রাখা সফল সংগীতশিল্পী কে? সকলেই এদিক সেদিক না ভেবে বলে দেয় তাঁর নাম। তাঁর চোখের সামনে দিয়ে অনেকে এসে বুড়ো হয়ে অবসরে চলে গেছেন, কিন্তু তিনি এখনও সমানতালে গাইছেন নিত্য নতুন গান। সবুজ রেখেছেন নিজের রুচি ও ফ্যাশন। একাধারে তিনি শিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক এবং সফল সংগঠক। বাংলা গানের সত্যিকারের বাঁক বদল ও অডিও ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি একজন সফল কারিগরও বটে। তাঁর হাত দিয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেক গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও মিউজিশিয়ান।

১৯৬৩ সালের আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। তার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম জেলায়। বাংলা আধুনিক কিংবা চলচ্চিত্রের গানে দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কণ্ঠ দিচ্ছেন কুমার বিশ্বজিৎ। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেছেন। কিংবদন্তি এই কণ্ঠশিল্পী আমাদের সবার হৃদয়ে আছেন অনেক উঁচু জায়গায়। চিরকাল তাঁকে আমরা সেখানেই রাখব, একথা কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না, বেঁচে থাকায় আমাদের আনন্দ এখানেই।

লুৎফর হাসান
সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও লেখক


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা