বলিউডের ব্যস্ততম শিশুশিল্পী বলা হতো তাকে। সেখান থেকে হয়ে গেলেন একগাদা ফ্লপ সিনেমার নায়ক। স্ক্রিপ্ট যা পেতেন, সেখানেও রোল শুধু কমেডিয়ানের। অথচ প্রতিভা কোনোদিনও কারো থেকে কম ছিলোনা তার...

গত বছরের বলিউড হিটগুলোর মধ্যে 'লুটকেস' সিনেমা ছিলো অন্যরকম। সারকাজম আর মেটাফোরের মিশেলে গোছানো, ছিমছাম এক কাজ। আর কাস্টিং লিস্টেও ছিলো সব ভালো ভালো নাম। অভিনয়ও হয়েছে বেশ খোলতাই। তবে লিড এ্যাক্টর হিসেবে কুনাল খেমুকে দেখে একটুখানি হতাশা চলে এসেছিলো ভেতর থেকে। হতাশা কেন, সেটা বলছি একটু পরেই। সিনেমাজুড়ে তার অভিনয় যখন দেখলাম, তখন আরেকটু হতাশ হয়ে গেলাম। কেন? সেটাও বলবো। গল্পটাতো সেখানেই।

যারা 'লুটকেস' দেখেননি, তারা হয়তো ভাবছেন- খুব বাজে অভিনয় করেছে মনেহয় লোকটা। এমনিতেও তো ফ্লপ হিরো! বাজে অভিনয় করবে, এটাই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু না। এই লোক খুবই অসাধারণ অভিনয় করেছেন। আক্ষেপটা সেই কারণেই। এত ভালো অভিনয়ের পরেও লোকটা সারাজীবন ভাঁড়ামোর রোলই পেয়ে গেলেন! নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলেন না কোনোদিনও। পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে বলিউডে, অথচ আলাদা করে নাম হলোনা আজও! আক্ষেপ হবেনা কেন বলুন?

লুটকেসে অসাধারণ অভিনয়ই করেছেন কুনাল খেমু!  

কাশ্মীরের পন্ডিত পরিবারে জন্ম নেয়া বলিউডের এই স্বঘোষিত 'আন্ডার-ইউটিলাইজড' এ্যাক্টরের বাবা-মা দুইজনেই অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এরচেয়েও বড় তথ্য হলো, কুনালের দাদামশাই নিজেও কাশ্মীরের নাট্যসংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত ছিলেন। জম্মু কাশ্মীর থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন দাদামশাই মতিলাল খেমু। পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমী এ্যাওয়ার্ডও। এরকম শিল্পমনস্ক পরিবারের সন্তান অভিনয়ে এলে সেটা নিয়ে খুব বেশি বলারও থাকেনা৷ কুনাল অভিনয় শুরু করলেন দারুণ দারুণ সব সিনেমায়। রাজা হিন্দুস্তানি, জখম, হাম হ্যায় রাহি পেয়ার কে, নারাজ, তামান্না সহ অনেক সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় শুরু করলেন কুনাল। তাকে বলা হতো সময়ের সবচেয়ে ব্যস্ততম শিশুশিল্পী। সবাই ধারণা করেছিলো- এ ছেলে বড় হয়ে ফাটিয়ে দেবে।

২০০৫ সালে লিড আর্টিস্ট হিসেবে মোহিত সুরির 'কলিযুগ' সিনেমাতে বেশ ভালো কাজ করলেন কুনাল। সবাই বেশ পছন্দও করলো তার অভিনয়। এরপর অভিনয় করলেন মধুর ভান্ডারকরের 'ট্রাফিক সিগন্যাল' এ। সেটাকেও সবাই ভালো বললো। কিন্তু এরপরেই ট্রাক থেকে বিচ্যুতি। ঢোল, ঢুন্ধতে রেহ জায়োগে, ভিরু, গোলমাল... কোনোটাতে সোলো হিরো হওয়া হয়নি। এবং অভিনয়ও হয়ে গেলো গৎবাঁধা। গো গোয়া গন, গুড্ডু কি গান, ভাগ জনি সিনেমাগুলোও মুখ থুবড়ে পড়লো বক্স অফিসে। অজস্র ঝকঝকে তারকার ভীড়ে একরকম হারিয়েই গেলেন কুনাল খেমু। হয়ে গেলেন ট্রাজিক হিরো। মাঝেমধ্যে ধুপধাপ জ্বলে ওঠেন, পরক্ষণেই ফুশ! বলিউডে ববি দেওলকে নিয়ে একটা জোক প্রচলিত আছে, ববির কাছ থেকে ভালো স্ক্রিপ্ট নাকি পালিয়ে বেড়ায়! কুনালের ক্ষেত্রেও কথাখানি অনেকটুকু সত্যি বলে ধরে নেয়া যায়। পরিস্থিতি সেটাই বলে।

অথচ অভিনয় কিন্তু মোটেও খারাপ না তার। বরং বেশ ভালোই অভিনয়। যেটাই করেন না কেন, সেটা বেশ গুছিয়েও করেন তিনি। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া মুহিত সুরির 'মালাং'  সিনেমাতে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে কী অভিনয়টাই না করলেন! 'কলঙ্ক' সিনেমার 'আবদুল' রোলটার কথাও তো বলা যায়। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই তার সলো সিনেমা না। তাছাড়া ক্যারিয়ারের মাঝখানে সোহা আলী খানের সাথে প্রেম, ভালোবাসা, লিভ টুগেদার, বিয়ে। হয়তো অভিনয় থেকে ফোকাসটা নড়েই গেলো খানিকটা। পতৌদী পরিবারের জামাই তিনি, সেই পরিবারের সবাই-ই সুপারস্টার: সোহা, সাইফ, কারিনা, শর্মিলা... তাদের ভীড়ে কুনালের কী একটু সাফোকেটিংও লাগতো? ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স কী কাজ করতো ভেতরে? জানা নেই কারো। তবে ক্যারিয়ারের দৈন্যদশা সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়৷

নিজেই আক্ষেপ করে বলেন-

আমি তো অভিনয় করতে চাই। অভিনয় আমি পারিও। কিন্তু আমাকে যে স্ক্রিপ্ট দেয়া হয়, তার সবগুলোতেই আমার রোল কমেডিয়ানের। গোলমালের পর থেকেই এই উপদ্রব। আমি কীভাবে ভালো অভিনয় করবো? আমার কাছ থেকে ভালো অভিনয় তো কেউ চাইছেই না। চাইছে সবাই কমেডি!'

একজন অভিনেতার এই আক্ষেপ আমরা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারি। বাংলাদেশেও তো দেখেছি- হুমায়ুন ফরিদী, ফজলুর রহমান বাবু, মোশাররফ করিম প্রমুখেরা ভালো স্ক্রিপ্টের জন্যে হাপিত্যেশ করেছে নিয়মিত। কিন্তু একই গৎবাঁধা চরিত্র দিয়ে শেষ করে ফেলা হয়েছে তাদের। বছরের পর বছর ধরে সেই একই সাজসজ্জা, কথাবার্তা। এই আক্ষেপের সুর তাই আমাদের কাছে খুবই চেনা৷ খুবই পরিচিত।

'লুটকেস' দেখে তাই এ কারণেই আক্ষেপ হয়েছিলো। কুনাল খেমু স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কী অসাধারণ অভিনয়ই না করলেন! অথচ লোকটি ভালো স্ক্রিপ্টই পেলেন না কোনোদিন। এখন দোষ আসলে কাকে দেয়া যায়? দর্শককে? পরিচালক সম্প্রদায়কে?  কুনালকে? নাকি কুনালের ভাগ্যকে?

জানিনা সঠিক। তবে এটুকুই বলার, ভালো স্কিপ্ট পেলে এখনো অনায়াসে ছক্কা হাঁকাতে পারবে এই লোক। সে সামর্থ্য তার আছে। হয়তো ভালো স্ক্রিপ্ট আসলেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে তার থেকে!

কুনাল খেমুর জন্মদিনে তার প্রতি তাই একটাই প্রত্যাশা, স্ক্রিপ্ট বাছাইয়ে আরেকটু মনোযোগী এবং খুঁতখুঁতে হবেন তিনি। দারুণ গল্প এবং দুর্দান্ত অভিনয়ের এক কম্বোপ্যাক দিলেই তিনি আবার হয়তো চলে আসবেন পাদপ্রদীপের তলে। সমাদৃত হবেন দর্শকমহলে। অভিনয় তো তার আছেই, এখন ভালো গল্প পাওয়ার পালা। শুভকামনা রইলো। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা