কুরুপ: জমজমাট গল্পের বানিজ্যিক রূপান্তর!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

দেড় বছর পরে আড়মোড়া ভাঙ্গা প্রেক্ষাগৃহকে চাঙ্গা রাখার জন্যে যেরকম 'মশলামুড়ি' সিনেমার দরকার ছিলো, কুরুপ সেরকমই। এবং সে কারণেই মুক্তির পরে দারুণ ব্যবসাও করেছে সিনেমাটি। বানিজ্যিক ব্যবসাপাতির হিসেবে এ সিনেমা ভালোই উতরে যাবে। কিন্তু যদি আদি ও অকৃত্রিম মালায়ালাম সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনা করি, 'কুরুপ' সেখানে মনে রাখার মত সংযোজন না!
ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ধরে পলাতক আসামী তিনি। ১৯৮৪ সাল থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ক্রমাগত হন্যে হয়ে খুঁজে যার টিকিটিও ধরতে পারেনি এখনো। এমনও পুলিশ অফিসার আছেন, যাদের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে এই আসামীর কেস দিয়ে, সমাপ্তিও হয়েছে একই কেস দিয়ে। মাঝখানে পেরিয়েছে বহু বসন্ত। শুধু পাখিই আর ফেরেনি খাঁচায়। কিংবা, মাছ ধরা দেয়নি জালে। এই যে আসামী, যিনি এত বছর ধরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লাপাত্তা হয়ে আছেন, খুন-দুর্নীতি-জোচ্চুরিসহ অজস্র মামলা যার বিরুদ্ধে, যিনি ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের একজন সদস্যও, সেই তুখোড় অপরাধীর নাম গোপিকৃষ্ণ। কিংবা সুকুমার কুরুপ। কিংবা আলেকজান্ডার। অজস্র নাম। যদিও তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় 'কুরুপ' নামেই।
কুরুপের জীবনগল্পও বৈচিত্র্যের এক বিশুদ্ধ আড়ত। নিরপরাধ মানুষকে খুন করে নিজের লাশ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্য হয়ে যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র লোপাট করেছেন, বিদেশে গিয়ে কালোবাজারি-দুর্নীতি করেছেন, অজস্রবার পুলিশকে ঘোরতর নাস্তানাবুদ করে পালিয়েছেন। বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করেছেন জীবনভর। এরকম এক রঙিন অপরাধীর জীবনকে উপজীব্য করে যখন শ্রীনাথ রাজেন্দ্র 'কুরুপ' নির্মাণের ঘোষনা দিলেন এবং সেখানে নামভূমিকায় রইলেন দুলকার সালমান, তখন একটু নড়েচড়ে বসতেই হলো। মহামারীর এই সময়ে দুলকার সালমানের সমসাময়িক অভিনেতা- ফাহাদ ফাসিল, পৃথ্বীরাজ সুকুমার, নিভিন পৌলি... সবারই এক বা একাধিক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে একাধিক স্ট্রিমিং সাইটে। অথচ মহামারীর এই দেড় বছরে পুরোপুরি নিশ্চুপই ছিলেন দুলকার সালমান। মহামারীর প্রকোপ খানিকটা কমেছে, সীমিত আকারে প্রেক্ষাগৃহগুলোও খুলেছে, দুলকার সালমানও ফিরেছেন তার সিনেমা নিয়ে। যাপিত পরিস্থিতির বিবেচনায় একটু নড়েচড়ে বসা বোধহয় প্রাসঙ্গিকও ছিলো।

ফিরি সিনেমায়। নির্মাতা শ্রীনাথ রাজেন্দ্র, 'কুরুপ' এর ন্যারেশন স্টাইল একটু ভিন্ন আবহে এগিয়ে নিতে যেতে চেয়েছিলেন। সাধারণত যেভাবে সিনেমার গল্প এগোয়, সেখান থেকে খানিকটা স্বকীয় উপস্থাপনায় তাই এগিয়েছে গল্প। এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে, 'কুরুপ' নিয়ে মোটামুটি সবাই-ই সবকিছু জানে। তাই, লিনিয়ার ন্যারেশনে সিনেমা এগোলে চমকের থাকবে না কিছুই। তাই, নির্মাতা নন-লিনিয়ার ন্যারেশন স্টাইলে এগোনোকেই যৌক্তিক মনে করেছেন। কিন্তু এই স্টাইলে গল্প-বয়ানের প্রধানতম সমস্য, দর্শককে বরাবরই তটস্থ থাকতে হয়, সতর্ক থাকতে হয়। একটু অসাবধান হলেই গল্পের মূলস্রোত থেকে ছিটকে যেতে হয়৷ যেটা হয়েছে এ সিনেমার ক্ষেত্রেও। খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছিলো দৃশ্যপট। ঘটনাপরম্পরা। ক্রমশই রঙ পাল্টাচ্ছিলো স্থান-কাল-পাত্র। সাধারণ দর্শকের জন্যে যা খানিকটা বিব্রতকর, কিঞ্চিৎ সমস্যারও।
কুরুপের যেসব কেলেঙ্কারি সম্পর্কে মানুষজন ওয়াকিবহাল, অর্থাৎ অন্যের লাশ নিজের বলে চালানো, বিমানবাহিনীর জিনিসপত্র পাচার করা, বিদেশে গিয়ে দুর্নীতি করা...তার সবই এসেছে এই নির্মাণে৷ কিন্তু এই সিনেমায় যেটা প্রধানতম সমস্যা, সেটা গল্পের পূর্ণতার অভাব। যেকোনো মালায়ালাম সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক অবশ্যই গল্প বয়ান। মালায়ালাম সিনেমায় গল্পকে যেভাবে বলা হয়, গল্পকে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়, গল্পকে যেভাবে তিলে তিলে পরিণতির দিকে নিয়ে আসা হয়, সেটা অনেকটাই উহ্য ছিলো এই নির্মাণে। কুরুপ কেন কুরুপ হয়ে উঠলো, কুরুপের এরকম দুঃসাহসী হয়ে ওঠার কারণ কী, এরকম দক্ষও সে কিভাবে হয়ে উঠলো, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নির্মাতা খোঁজেননি কিংবা খোঁজার চেষ্টাও করেননি। অথচ, বায়োপিকে এই প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সিনেমার একটা বড় অংশ জুড়েই কুরুপ ও পুলিশের 'চোর-পুলিশ' খেলা। 'ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান'এ সওয়ার হয়ে কুরুপ দৌড়াচ্ছেন, পেছনে পেছনে পুলিশও পড়িমরি করে ধাওয়া দিচ্ছে... এভাবেই চলেছে বহুক্ষণ। কিন্তু এখানেও সেই সমস্যা আবার, গল্প-বয়ান। কিভাবে পুলিশ জানতে পারছে কুরুপের সুলুকসন্ধান, কুরুপও বা কিভাবে নস্যাৎ করছে পুলিশের পরিকল্পনা...এসবের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর সিনেমার পর্দায় পাইনি। খানিকটা ভাসা ভাসা, জল ঘোলা না করে জলপান এর মত হয়েছে বিষয়টা৷ এবং সিনেমা দেখে বারবারই মনে হয়েছে, কুরুপের যে বিচিত্র জীবন, সেটিকে আড়াই ঘন্টার এক মলাটে না আঁটিয়ে বেশ বড়সড় এক ওয়েব সিরিজ করলে জম্পেশ হতো। সেক্ষেত্রে খুব দারুণভাবেই গল্পের গভীরে যাওয়া যেতো, 'থোড়বড়িখাড়া' ন্যারেশন স্টাইলে গল্পের দফারফাও করতে হতো না।
তবে গল্পের বয়ান ও বিন্যাসে বিস্তর খামতি থাকলেও সিনেমার অন্যান্য মালমশলাতে নতুনত্বের উপস্থিতি ছিলো বেশ। বলিউডি কমার্শিয়াল সিনেমার কিছু উপকরণও এসেছে এ সিনেমায়। শ্রুতিমধুর গান, বিজিএম, সিনেম্যাটোগ্রাফী, কালার স্কিম... সবই দুর্দান্ত। অনেকদিন পরে পর্দায় দুলকার সালমানকে দেখেও ভালো লাগলো। অভিনয়ও ভালো। কিন্তু 'আহামরি ভালো' বলার মত পরিস্থিতি স্ক্রিপ্টে ছিলো না। হয়ওনি। বলিউডি সিনেমার মতই এখানেও নায়িকার উপস্থিতি ক্ষনস্থায়ী। মনে রাখার মতন কোনো নিদর্শনও তাই ছিলো না। তবে 'ডিওয়াইএসপি কৃষ্ণদাস' চরিত্রে ইন্দ্রজিৎ সুকুমার এবং 'পিল্লা' চরিত্রে শিনে টম চ্যাকো অনবদ্য অভিনয় করেছেন। বাকিরাও ঠিকঠাক।
দেড় বছর পরে আড়মোড়া ভাঙ্গা প্রেক্ষাগৃহকে চাঙ্গা রাখার জন্যে যেরকম 'মশলামুড়ি' সিনেমার দরকার ছিলো, কুরুপ সেরকমই। এবং সে কারণেই মুক্তির পরে দারুণ ব্যবসাও করেছে সিনেমাটি। বানিজ্যিক ব্যবসাপাতির হিসেবে এ সিনেমা ভালোই উতরে যাবে। কিন্তু যদি আদি ও অকৃত্রিম মালায়ালাম সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনা করি, 'কুরুপ' সেখানে মনে রাখার মত সংযোজন না। এ সিনেমা নিয়ে কিছুদিন কথা হবে। শোরগোল ফুরিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে সিনেমাও। প্রেক্ষাগৃহের প্রয়োজনে হয়তো এরকম নির্মাণ দুই-একটা আসতে পারে। কিন্তু আশা থাকবে, গল্পনির্ভর মালায়ালাম সিনেমার যে মান, সেটাই ধরে রাখবেন তারা। মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি ঠিক যে কারণে আমাদের প্রিয়, আশা থাকবে- বানিজ্যের ক্রমাগত আগ্রাসনের ভীড়ে প্রিয় সেই উপাদানগুলো কখনোই বিস্মৃত হবে না।