লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন রিভিউ: ফারুকী সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রকে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটা মেয়ে ধূমপান করলে সে খারাপ, স্লিভলেস ব্লাউজ পরলে সে চরিত্রহীনা, অফিস আওয়ারের পর বসের রুমে গেলে তার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায়- পেট্রিয়ার্কিতে বিরাজমান এসব ফিক্সড প্যাটার্নের মেন্টালিটিকে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি দিয়েছেন ফারুকী, রিখটার স্কেলে যার মাত্রাটা মাপা সম্ভব নয়...
কথাটা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনেক আগে বলেছিলেন। বাংলাদেশী সিনেমার নির্দিষ্ট কোনো ভাষা নেই। বলিউডের একটা সিনেমা দেখলে বোঝা যায়, এটার জন্ম মুম্বাইতে। ইরানী, কোরিয়ান, দক্ষিণ ভারতীয় কিংবা আমাদের পাশের কলকাতার সিনেমা দেখতে বসলেও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাদের সিগনেচারটা ধরে ফেলতে পারবেন দর্শক, বুঝতে পারবেন, এটা কোন ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা। কিন্তু ঢাকাই সিনেমা নিজের সেই ব্র্যান্ডিং, সেই ল্যাঙ্গুয়েজটা তৈরি করতে পারেনি আজও। ফারুকী একরকম আক্ষেপই করেছিলেন ব্যাপারটা নিয়ে।
বাংলাদেশী কন্টেন্ট ঠিকঠাকভাবে ভাষা খুঁজে না পেলেও, ফারুকী নিজস্ব একটা সিগনেচার তৈরি করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। নাটক হোক, সিনেমা হোক, কিংবা হোক ওয়েব সিরিজ, তার নির্মিত কাজটা দেখলেই বোঝা যায়, এটা ফারুকী বানিয়েছেন। গল্পের বিষয়বস্তুতে, স্টোরি টেলিংয়ে, ডায়লগে, ক্যামেরার কাজে, কিংবা কালারে নিজের একটা পরিস্কার ছাপ তৈরি করে ফেলেছেন ফারুকী। তার কন্টেন্টগুলো নির্দিষ্ট সুরে ছন্দোবদ্ধ গতিতে এগোয়। সেই সুরে মোৎজার্টের মোহাবিষ্ট আবেশ আছে, এমন দাবী করব না। কিন্তু দর্শক হিসেবে পরিণত মনস্ক হলে ফারুকীর সেই সুরটা যে কারো মাথায় আঘাত করবে, ভাবতে বাধ্য করবে।
'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান', মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ওয়েব সিরিজ, সেটির পরতে পরতেও। ছড়িয়ে আছে ফারুকীর সেই নিজস্ব ব্র্যান্ডিং। বরাবর তিনি যেটা করেন, সেই সামাজিক বাস্তবতার গল্পই বললেন, আগের যে কোন সময়ের চেয়ে সাহসী ভঙ্গিমায়। অজস্র এলিমেন্টকে একটা জায়গায় নিয়ে এলেন, গল্পের ফোকাসটাকে একটুও নড়তে না দিয়ে স্পর্শ করলেন অনেকগুলো ইস্যু। তাতে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হবার একটা আশংকা ছিল, কিন্তু ফারুকীর নিপুণ নির্মাণে তেমন কিছুই ঘটেনি।
'লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন' মূলত একটা সংকটের গল্প বলেছে। মিসোজিনিস্ট (নারীবিদ্বেষী) সমাজের বুকে একজন নারীর একক সংগ্রামের গল্প। সেই সংগ্রাম কখনও অর্থনৈতিক, কখনও মানসিক, কখনও আবার আত্মমর্যাদা রক্ষার। গল্পটা বলতে গিয়ে ফারুকী কোথাও আগাপাশতলা ভাবেননি, কোন সম্প্রদায় কি রিয়্যাক্ট করবে সেটাও মাথায় আনেননি। আর তাই লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন একটা চপেটাঘাত হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে এই সময়ের সামাজিক বাস্তবতায়।
লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেনের গল্পটা বাবার অসুস্থতা আর চাকরি পার্মানেন্ট না হওয়া নিয়ে নানামুখী টানাপোড়েনের মধ্যে থাকা সাবিলার। স্বল্প বেতনের চাকরির পাশাপাশি যে মেয়েটা সংসার চালানোর জন্য কাপড়ের ব্যবসা করে, তার প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে একাত্ম হয়ে যায় আজ থেকে শত বছর আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার লেখা 'সুলতানার স্বপ্ন' উপন্যাসটা। নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার আদায়ে সে মরিয়া। শেকল ভাঙা, পাখির মতো উড়তে চাওয়া সাবিলাকে প্রতি পদে পদে দমিয়ে রাখতে চায় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তার স্বাধীন পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাকে দমিয়ে রাখাটাই সবার উদ্দেশ্য।
পাশাপাশি এই গল্পটা কবি খায়রুল আলমের, সুযোগের অভাবে যিনি ভালোমানুষের মুখোশ পরে থাকেন। গল্পটা লরার। একজন ইন্ডিপেনডেন্ট ওয়ার্কোহলিক ওম্যান, অপ্রত্যাশিতভাবে যাকে বাবার কৃতকর্মের মানসিক ধাক্কাটা পোহাতে হয়। গল্পটা আরিফেরও। স্ত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা যার জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়। সেই গল্প বলতে গিয়ে ফারুকী একেকটা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপরাজনীতি আর দুর্নীতির মুখোশটাকে খুলেছেন, ধর্মান্ধতার গায়েও দিয়েছেন জোর ধাক্কা।
তবে লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দিয়েছে পুরুষতন্ত্রকে। একটা মেয়ে ধূমপান করলে সে খারাপ, স্লিভলেস ব্লাউজ পরলে সে চরিত্রহীনা, অফিস আওয়ারের পর বসের রুমে গেলে তার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যায়- এসব ফিক্সড প্যাটার্নের মেন্টালিটিকে বড়সড় একটা ঝাঁকুনি দিয়েছেন ফারুকী, রিখটার স্কেলে যার মাত্রাটা মাপা সম্ভব নয়। একেকটা ঘটনার পর নারীটিকে 'কোশ্চেনেবল ক্যারেক্টার' হিসেবে জনসম্মুখে প্রদর্শনের যে গোপন আঁতাত পুরুষতন্ত্র রচনা করে, তার মুখোশটা খুলে দিয়েছে লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন।
ফারুকীর নির্মাণ বরাবরই সংলাপের জায়গাটায় বৈচিত্র্যময়। লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেনও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা জায়গায় অপরাধীর উকিল বলছেন, "আপনার উচিত স্যার প্রথমেই মেয়েটার ক্রেডিবিলিটিটা ধ্বংস করে দেয়া। ক্রেডিবিলিটি ধ্বংসের উপায় কি জানেন স্যার? ধইরা তারে নাস্তিক বানায়ে দেয়া। স্যার, এই দুনিয়ায় নাস্তিক মাইরা ফালাইলে কেউ কোনোদিন জিগায়? কেউ জিজ্ঞেস করে স্যার? আর সে যদি স্যার মেয়ে হয়, আর তাকে যদি আপনি দুশ্চরিত্রা বানাইতে পারেন, তাহলে তো স্যার কেল্লাফতে!" বাংলা কন্টেন্টে এমন সংলাপ দেখাটা ২০২১ সালের প্রতিক্রিয়াশীল বাস্তবতায় আপাত অসম্ভবই। হাস্যরসের ছলে অভিনেতাদের দিয়ে সেই দুঃসাহসকে ছোঁয়া এই মুহূর্তে ফারুকীর পক্ষেই সম্ভব, আর সেই কাজে তিনি দারুণ পটুত্ব দেখিয়েছেন লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন- এ।
এই ওয়েব সিরিজের আরেক সম্পদ দারুণ অভিনয়। সাবিলার চরিত্রে দুয়েকটা সিকোয়েন্স বাদ দিলে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিণ। রাগ, জেদ, আত্মবিশ্বাস, ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূড় হওয়া কিংবা হতাশায় মুষড়ে পড়া- সবগুলো ভার্সনেই তিনি ছিলেন দারুণ সপ্রভিত। সারপ্রাইজিং পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন মারিয়া নূরও। আফজাল হোসেন যেন ওল্ড ওয়াইন ইন অ্যা নিউ বোটল! মোস্তফা মনোয়ার, পার্থ বড়ুয়া কিংবা ইরেশ জাকেররাও দারুণ। মামুনুর রশীদ যে কয় মিনিটের জন্যেই স্ক্রিনে এসেছেন, ততবারই তার পাঁচ দশকের মঞ্চের অভিজ্ঞতা যেন ঝরে পড়েছে পর্দায়। আর হাসান মাসুদ! অভিনয়ের রঙে প্রত্যাবর্তনটা রাঙিয়ে দিলেন একদম!
তবু দিনশেষে লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন এর মূল নায়কের নাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। 'ডুব' এবং 'আয়েশা'র পর চার বছরের বিরতি দিয়ে দর্শকের সামনে নিজের কোন ফিকশন নিয়ে এলেন তিনি। ফারুকী কেন ওটিটিতে আসছেন না, দর্শকের আক্ষেপটা ঘুচিয়ে দিলেন এই উইকেটে খেলতে নেমে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে। 'ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে' কথাটার সার্থকতা ফারুকী প্রমাণ করলেন এযাবতকালের অন্যতম সেরা বাংলাদেশী ওটিটি কন্টেন্টটি নির্মাণ করে, তাও আবার সাহসী ভঙ্গিমায়, একেবারেই নিজস্ব ঢংয়ে। ভবিষ্যতের জন্য প্রত্যাশার পারদটা তাই আরেকটু বাড়লো তার প্রতি।