'লগান' এর বিশ বছর: যে সিনেমার স্ক্রিপ্ট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শাহরুখ-আমির!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

স্ক্রিপ্ট রিজেকশন, প্রোডিউসারের দ্বারে দ্বারে ঘোরা, শুটিং স্পট নিয়ে আশঙ্কা, অদম্য মনোবল- সব মিলিয়ে যে মিশ্রণ তৈরী হলো, তার নাম 'লগান'। দীর্ঘ বিশ বছর পরে এসেও যে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গেলে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হয়...
আশুতোষ গোয়াড়িকর একটা সিনেমা বানাবেন। প্রবল উৎসাহে স্ক্রিপ্ট নিয়ে একেকজন স্টারের কাছে যাচ্ছেন। আর সে স্টারেরা দ্বিগুণ বেগে সেই স্ক্রিপ্ট ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ শাহরুখ খান ফিরিয়েছেন। স্ক্রিপ্টের তিন মিনিট শুনে আমির খানও বাতিল করে দিয়েছেন। আশুতোষের মুখ মেঘে থমথম। তাহলে কি সিনেমাটা বানানো হবে না তাঁর? নাছোড়বান্দা হয়ে তিনি আবার গেলেন আমিরের বাড়িতে। জোর করে হলেও তিনি আমিরকে স্ক্রিপ্ট শোনাবেন... এমনটাই তাঁর ইচ্ছে৷ টানা তিনঘন্টা ধরে তিনি স্ক্রিপ্ট শোনালেন আমির খান কে। আমির খান চুপ হয়ে শুনলেন৷ স্ক্রিপ্ট শেষ করে থ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর একটাই কথা বললেন-
এই সিনেমায় আমি আছি।
আজ থেকে বিশ বছর আগে ১৫ই জুন, ২০০১ এ ভারতের সিনেমাহলগুলোতে মুক্তি পায় এই সিনেমা। এবং মুক্তির পরেই জোয়ারের মতন আসতে শুরু করে সাফল্য। ২০০২ সালে অস্কারে নমিনেশন পায় 'সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র' ক্যাটাগরিতে। আটটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও জেতে। 'ভারতের শ্রেষ্ঠ বিশ সিনেমা'র তালিকা করলে সেখানে প্রথম সারিতেই থাকবে এই সিনেমার নাম। হ্যাঁ, 'লগান' এর কথাই বলছি। যে সিনেমা পালটে দিয়েছিলো উপমহাদেশের সিনেমার সংস্কৃতিকে।

স্ক্রিপ্ট যে অসাধারণ ছিলো, তা আমরা সিনেমা দেখে বুঝেছি। কুশীলবেরা সিনেমা শুরুর আগে স্ক্রিপ্ট পড়ে বুঝেছিলেন। আমির খান তো তিনবার পড়েছিলেন স্ক্রিপ্ট। শুধু পড়েনইনি। ঘরের সবাইকে শুনিয়েছেনও পড়ে। এত ভালো স্ক্রিপ্ট হওয়ার পরেও বিস্তর শঙ্কা ছিলো। এরকম দুর্দান্ত স্ক্রিপ্টকে 'সিনেমা'র খোলসে পুরতে গেলে প্রচুর টাকাপয়সার দরকার। সে টাকা কে দেবে? প্রোডিউসারদের দ্বারেদ্বারে ঘোরা হলো বহুদিন৷ অবশেষে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা জোগাড় হলো। শুরু হলো অসাধ্যসাধন করার কাজ।
ভুজ, অর্থাৎ যে গ্রামে 'লগান' এর শুটিং হয়, সে গ্রামে এত বড় শুটিং ইউনিট থাকার জায়গা ছিলো না। পুরো গ্রামে ছিলো মাত্র তিনটি হোটেল। সে হোটেলগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। রুমও গুটিকয়েক। কী করা যাবে? প্রোডাকশনের কপালে তখন চিন্তার গাঢ় ভাঁজ৷ শেষমেশ বাধ্য হয়ে গ্রামের গোটা একটা বিল্ডিংকেই ভাড়া করে নিলেন পরিচালক। সেই বিল্ডিং এ প্রয়োজনমত জিনিসপত্র যুক্ত করে থাকা শুরু করলো সবাই।
টানটান বাজেট। সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে শুটিং৷ গোয়ারিকরের এক কথা, ভোর পাঁচটার মধ্যে শুটিং স্পটে আসতে হবে সবাইকে৷ কেউ এক সেকেন্ডও মিস করতে পারবে না। কিন্তু একদিন, শুধুমাত্র একদিন আমির খান এলেন সামান্য দেরি করে৷ টিমের সবাই যেভাবে কটাক্ষ করেছিলো আমির খান কে, এরপর থেকে আমির খান দূরের কথা, একটা কাকপক্ষীও দেরি করে সেটে আসার সাহস পায়নি৷ পুরো শুটিং এ 'শার্প ফাইভ এ এম' বহাল ছিলো শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত।

তবুও এরকম স্ট্রিক্ট শিডিউল মেন্টেন করেও সময়ের মধ্যে শুটিং শেষ করা গেলো না। নির্ধারিত সময়ের পরেও শুটিং চালাতে হচ্ছে। কিন্তু হুট করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন পরিচালক স্বয়ং। ব্যাকপেইনের ব্যথা বেড়েছে তাঁর৷ ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, কমপক্ষে এক মাস বেড রেস্টে থাকতে হবে। কিন্তু এক মাস বেড রেস্টে থাকতে গেলে সিনেমার ভবিষ্যৎ যে পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে যাবে, তা জানতেন গোয়ারিকর। তিনি শুয়ে শুয়ে ডিরেকশন দেয়া শুরু করলেন৷ শুটিং এর পুরো সময়ে তিনি শুয়ে থাকতেন আর চোখ রাখতেন মনিটরে। তাঁর এই ডেডিকেশনে পুরো টিমই যে কাজ করার দুর্দান্ত জ্বালানী পেয়েছিলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা মোটেও৷
দেখতে দেখতে শুটিং এর শেষ পর্যায় চলে এলো। ক্লাইম্যাক্সে সেই বিখ্যাত ক্রিকেট ম্যাচ। পরিচালক বললেন, এই ক্লাইম্যাক্স স্পেশাল হতে হবে। আশেপাশের গ্রাম থেকে দর্শক আনো। দর্শক আনা হলো। কতজন? দশ হাজারেরও বেশি দর্শক আনা হলো! এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দুই বেলা খাওয়ানো, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা...আরেক দক্ষযজ্ঞ শুরু হলো। তবে দক্ষযজ্ঞ দক্ষ হাতেই সামলালো গোটা টিম। ক্রিকেট ম্যাচের শেষপর্যন্ত রইলো দর্শকেরা। আমির খানের গাওয়া 'আতি কেয়া খান্ডালা' গানের সময়ে তাদের রিএ্যাকশন সরাসরি ক্যামেরাবন্দীও করলেন পরিচালক। যে সিন আনকাট হয়ে ঢুকে গেলো সিনেমাতেও৷
স্ক্রিপ্ট, রিজেকশন, প্রোডিউসার, শুটিং রেসিডেন্স, স্ট্রিক্ট ডেডিকেশন...সব মিলিয়ে যে মিশ্রণ তৈরী হলো, তার নাম লগান। দীর্ঘ বিশ বছর পরে এসেও যে সিনেমা নিয়ে কথা বলতে গেলে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হয়। 'বিগার দ্যান সিনেমা' বলতে একটা কথা আছে৷ সে কথাকেই যেন জীবন্ত করে দর্শকের রূপোর পাতে তরিবত করে তুলে দিয়েছিলো আশুতোষ গোয়ারিকর, আমির খান ও গোটা টিমের সবাই৷

শেষ করার আগে আরেকটা তথ্য জানাই। যে দিনে মুক্তি পেয়েছিলো 'লগান', ঠিক একই দিনে মুক্তি পেয়েছিলো আরেক সিনেমা। সানি দেওলের 'গাদার।' এ সিনেমার বাজেট ছিলো 'লগান' এর থেকেও তিন-চার গুণ বেশি৷ 'লগান' টিমের সবাই বেশ ভয়েই ছিলো এই সিনেমা নিয়ে। কারণ, বিগ বাজেট, স্টারকাস্ট সব মিলিয়ে 'গাদার' পর্বতসম আতঙ্ক হওয়ার মতনই এক বিষয় ছিলো। তবে এই আতঙ্কে আখেরে 'লগান' এর লাভই হয়েছিলো। ভয় থেকেই তারা 'বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচ্যগ্র মেদিনী' মনোভাবে দীক্ষিত হতে পেরেছিলো। যদিও একই দিনে মুক্তির পরে 'গাদার' বক্স-অফিস তছনছ করে দিয়েছিলো। 'লগান' এর চেয়ে ঢের বেশি আয়ও করেছিলো এই সিনেমা।
তবে শেষপর্যন্ত বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থেকে কে গড়লো ইতিহাস, তা সবারই জানা৷ সে নিয়ে চর্বিতচর্বণ না করি আর বরং।