যে দুই সিনেমা পালটে দিয়েছিলো বলিউডি সিনেমা-সংস্কৃতিকে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

'লগান' যদি মেইনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমার টিপিক্যাল এলিমেন্টস ব্যবহার করে দুর্দান্ত আর্ট বানানোর প্রধানতম উদাহরণ হয়, তাহলে, 'দিল চাহতা হ্যায়' হবে টিপিক্যাল বলিউডি ঘরানাকে পালটে দেয়া আর্টের প্রধানতম উদাহরণ। এ দুই সিনেমা একত্র হয়ে যেভাবে ভেঙ্গেছে টিপিক্যাল সব ন্যারেটিভ, তাও কেউ দেখেনি আগে...
নব্বইয়ের দশক শেষ করে ক্যালেন্ডার যখন নতুন দশকে ঢুকছে, ঠিক এ সময়টায় পৃথিবী ভারসাম্য হারিয়ে খানিকটা টালমাটাল। রাতারাতি প্রযুক্তি পাল্টাচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির মানচিত্র পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে সংস্কৃতির আঁকিবুকি দেয়ালও। এবং পাল্টাচ্ছে সিনেমা। বিশেষ করে- উপমহাদেশের সিনেমা। আমরা যারা নাইন্টিজের কিড তাদের কাছে শুক্রবার মানেই বেলা ৩টা, সিনেমা, গ্যাট হয়ে বিটিভি'র সামনে বসা। আর অন্য বারগুলোতে নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ডিশলাইন। বলিউড। সে সময়ের সিনেমাগুলোও ছিলো বেশ সাদাসিধে। ভিলেন-নায়ক-সামাজিক গল্পের খুব চেনাপরিচিত এক মিশেলে নির্মিত সিনেমাগুলোতে প্রবল আবেগের আধিপত্য। গুচ্ছের নীতিবাক্য। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। এর বাইরে আর কিছু? অতটা না।
সেরকমই এক সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ২০০১ সালে বলিউডে মুক্তি পায় দুটি সিনেমা। যে সিনেমা দুটি বলিউডের, কিংবা বলা ভালো, উপমহাদেশেরই সিনেমা-নদীর গতিপথকে পাল্টে দেয় পুরোপুরি। আমরা জানতাম, নদীতে চর পড়লে কিংবা নদী ভেঙ্গে গেলে নদীর গতিপথ পালটায়। এখানেও ঠিক সেরকমটাই হয়। দুটি সিনেমা পালটে দেয় চেনা-পরিচিত ফর্মুলা সিনেমার গণ্ডি, আবহ, অবয়ব। প্রথাভাঙ্গা সে সিনেমা দুটির নাম- 'লগান' ও 'দিল চাহতা হ্যায়।' ২০০১ সালে মুক্তি পাওয়া এ দুটি সিনেমার নিজেদের মধ্যে সাদৃশ্য খুব কম। কিন্তু আলাদা দ্যোতনায় স্বকীয় থেকেই এ দুটি সিনেমা ভাংচুর করে মেইনস্ট্রিম বলিউডের প্রস্তরখন্ডকে। এই দুই সিনেমার পরবর্তীকালের অজস্র নির্মাণে ফিরে ফিরে আসে তারা। শুধু সিনেমা না, অজস্র নির্মাতার চিন্তাখোলসেও চলচ্চিত্রদুটি আনে আমূল পরিবর্তন৷
প্রথমত, 'লগান' দিয়ে শুরু করা যাক৷ প্রশ্ন উঠতে পারে, আশুতোষ গোয়ারিকরের এ সিনেমাও তো মোটাদাগে ভালো বনাম মন্দের দ্বৈরথ নিয়ে কথা বলে। শেষে এসে ভালোর জয় নিয়ে কথা বলে। তাহলে এ সিনেমা বলিউডের আর গড়পড়তা পাঁচ সিনেমার থেকে পৃথক হয় কিভাবে? ২০০১ সালের আগের বলিউডের অধিকাংশ সিনেমার কনসেপ্টই তো এরকম ছিলো৷ এই চেনাপরিচিত ফর্মুলার চর্বিতচর্বন তো বহুবারই হয়েছে। তাহলে নতুনত্ব কোথায়? প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। এবং এ প্রশ্নের উত্তর, এই কমন ফর্মূলাকে ব্যবহার করার মধ্যেই নিহিত 'লগান' এর চমৎকারিত্ব। প্রথার মধ্যে থেকেই এই নির্মাণ যেভাবে প্রথাকে ভেঙ্গেছে, তা হয়নি কখনো আগে।
প্রথমত, 'লগান' গৎবাঁধা ফর্মূলার 'গুড ভার্সাস ব্যাড' এর মধ্যে আনে ন্যাশনালিজম'কে। স্বদেশপ্রেমকে। আবার সেখানেই ক্রমশ আনা হয় ক্রিকেটকে। যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ২০০১ সাল, তখন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে ক্রিকেট। ৮৩ তে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। হকির পাশাপাশি ক্রিকেট আলাদা এক স্বত্বা হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে ভারতবর্ষে। ক্রিকেট নিয়ে তখন উত্তুঙ্গ আবেগ। খেলার আবেগ এবং দেশপ্রেমের আবেগকে একত্রিত করে গোয়ারিকর যখন অহিংস মানসিকতার প্রতিবাদের এক ভিন্ন গল্প শোনান, তা যেন সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমকে শায়েস্তা করার এক গল্প হয়ে যায়! স্রোতের মধ্যে থেকেও ভিন্নস্রোতের অভিনব চমৎকারিত্ব সাধিত হয় ঠিক এভাবেই।
এবং শুধু এখানেই শেষ না৷ বলিউডি সিনেমা মানেই যেখানে অবাস্তব বিষয়ের ছড়াছড়ি (দুই খানের সিনেমা যার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ), সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে 'লগান' এ আমরা দেখি স্বাভাবিক কিছু মানুষের আখ্যান৷ বঞ্চনা যাদের একাট্টা করেছে, প্রতিবাদী করেছে। কোথাও গিয়ে যেন ভুবন, ইসমাইল, কাচরা হয়ে যায় আমাদের অস্তিত্বের প্রতিনিধি। ভুবন বাউন্ডারি মেরে ব্যাটিং শুরু করলে আমরা হাততালি দিই, এর পরের বলেই ভুবনের আউট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হলে আমরা শিউরে উঠি। হেগেলের 'থিওরি অফ কনফ্লিক্ট' মেনে আমরা হয়ে যাই ঐ নির্যাতিত মানুষদের সমর্থক। সিনেমার ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড ভেদে আমাদের অনুভূতি পালটায়। পারদের ওঠানামা বাড়ে।

হিউম্যান ইমোশনস, কর্মাশিয়াল এলিমেন্টস সহ যাপিত নানা অনুষঙ্গ নিয়ে এই সিনেমা এমন ব্রিলিয়ান্ট কাজ করেছে, সময়ে সময়ে অনেকেই এই সিনেমাকে 'দ্য পারফেক্ট স্ক্রিনপ্লে' বলতেও বাধ্য হয়েছেন। এখনও বলিউডের অজস্র নির্মাতা এই সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যের প্রসঙ্গ টেনে এনে সিনেমার কোর্স করান নবীন ফিল্মমেকারদের। সিনেমা যদি 'শিল্প' হয়, তবে সে শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে ঠিক এভাবেই থেকে যায় আশুতোষ গোয়ারিকরের এ নির্মাণ!

২০০১ সালের দ্বিতীয় মহীরূহ 'দিল চাহতা হ্যায়।' পরিচালক ফারহান আখতার এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান 'এক্সেল এন্টারটেইনমেন্ট' এর ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমাই যে এরকম দুর্দান্ত ক্ষত তৈরী করবে বলিউড-প্রাসাদের মার্বেল মেঝেতে, তা কেই বা আন্দাজ করেছিলো? ২০০১ সালের আগে আমরা এটাই বারবার দেখেছি, সিনেমাতে সবকিছু অত্যন্ত স্থুল হয়। ভিলেনের হাসিতে দুলে উঠবে চারপাশ, মারপিটের শব্দে কানে তালা লাগবে, স্বাভাবিক কথাও দশগুন জোরে গলার রগ ফুলিয়ে বলতে হবে...সিনেমা মানেই এই অস্বাভাবিক বিষয়গুলোর স্বাভাবিক আধিপত্য। এবং এই অস্বাভাবিকত্ব মেনেও নিয়েছিলাম আমরা।
সিনেমার কুশীলবদের এই স্থুল-আচরণের পেছনে অনেকে হয়তো সিনেমার আগের পর্যায় অর্থাৎ যাত্রাপালা এবং থিয়েটারকেই দোষারোপ করবেন। সে দোষারোপ খুব একটা অপ্রাসঙ্গিকও না। কারণ, সেসব মাধ্যমে যেহেতু মঞ্চ থেকে সরাসরি দর্শকসারির শেষ বেঞ্চি পর্যন্ত অভিনয়কে পৌঁছানোর তাগিদ ছিলো, তাই সবকিছুই একটু চড়া স্কেলে করা হতো। পরবর্তীতে সিনেমার গোড়ার দিকের পর্যায়ও যে সে পুরোনো অভ্যাস থেকে বের হতে পারেনি, তার স্বপক্ষে পুরোনো সিনেমাগুলো সাক্ষ্য দেবে বারবার।
কথা হচ্ছে, 'দিল চাহতা হ্যায়' সিনেমা নিয়ে কথা বলতে এসে কেন সিনেমার আদ্যিকালের ঠিকুজিকোষ্ঠী নিয়ে পড়লাম? উত্তর দিচ্ছি। সিনেমা-ইতিহাসের হলদেটে অতীতের প্রসঙ্গ টেনেছিলাম, কারণ, দিল চাহতা হ্যায়' সিনেমা যখন আমরা দেখি, প্রথমেই যে বিষয়ে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হয়ে যায়, এ সিনেমা গতানুগতিক হিন্দি সিনেমার স্থুলতার ধারকাছ দিয়েও ঘেঁষছে না। এখানে প্রচণ্ড চড়া স্বরের কথাবার্তা নেই। স্ক্রিপ্টের অতিমানবীয় সংযোজন-বিয়োজন নেই। এখানে যা আছে, ছিমছাম এক গল্প। যেখানে কিছু তরুণের মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব আছে। যেখানে প্রেমসংক্রান্ত জটিলতা আছে। এক স্বাস্থ্যকর বন্ধুত্বের গল্পও আছে। এই সিনেমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, অডিয়েন্স সিনেমাটির সাথে কানেক্ট করতে পারছে। মূলত আমরা সিনেমা দেখতাম বা এখনও দেখি, অবাস্তব গল্প দেখে বাস্তবের গ্লানি ভোলার জন্যে। সে ন্যারেটিভে দাঁড়িয়ে এই সিনেমায় আমরা এমন সব চরিত্র দেখি, যারা মূলত আমাদেরকেই মনে করায়। যাদের দোটানা আমরা স্বাভাবিক জীবনে দেখেও অভ্যস্ত। যাদের জীবন আহামরি মনে হয় না। গড়পড়তা মনে হয়।

'দিল চাহতা হ্যায়' এর মতন ভিন্ন ঘরানার এক সিনেমা এরকম জনপ্রিয়তা পাবে, তাও ২০০১ সালের ঐ সময়ে, তা হয়তো কেউ আশাও করেনি। কিন্তু তবুও যা মঞ্চস্থ হয়, তা অভূতপূর্ব। এ সিনেমা শুধু জনপ্রিয়তাই পায় না, পাশাপাশি বলিউডি সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়েও এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বসে। হিন্দি সিনেমার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে পাল্টে দেয়ার পাশাপাশি 'দিল চাহতা হ্যায়' এর গল্প এমন এক স্বাদের অনুভূতি দেয় দর্শককে, যার গোটাটাই ছিলো অনাস্বাদিতপূর্ব। আকাশ, সমীর, সিডের এ গল্পের প্যাটার্ন কিংবা ফারহান আখতারের এ নির্মানশৈলী অনুসরণ করে এরপর অজস্র সিনেমা তৈরী হয়। যেসব সিনেমার নাম বলে লেখা দীর্ঘায়িত করছি না। মোদ্দা কথা এটাই, মেইনস্ট্রিম বলিউডি সিনেমার দেয়ালে ফাটল ধরায় 'দিল চাহতা হ্যায়।' যে ফাটল দিয়ে গলগল করে আসতে থাকে স্বকীয় ভাবনার একাধিক নির্মাণ!

'লগান' যদি মেইনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমার টিপিক্যাল এলিমেন্টস ব্যবহার করে দুর্দান্ত আর্ট বানানোর প্রধানতম উদাহরণ হয়, তাহলে, 'দিল চাহতা হ্যায়' হবে টিপিক্যাল বলিউডি ঘরানাকে পালটে দেয়া আর্টের প্রধানতম উদাহরণ। 'লগান' এর দেশপ্রেম ও খেলার মিশ্রনজাত আবেগের স্ট্রাকচারকে ব্যবহার করে অজস্র সিনেমার নজির যেমন দেখি বলিউডে, উপমহাদেশে, তেমনি 'দিল চাহতা হ্যায়' এর মডেল অনুসরণ করে সিনেমাও হয়েছে, হচ্ছে হরহামেশাই। এই দুই সিনেমাকে অনুপ্রেরণা মানেন করন জোহর, রাম মাধভানি, শকুন বাত্রার মতন নির্মাতারা। এই নির্মাতাদের বাইরেও একটা পুরো ফিল্ম-মেকার জেনারেশনই তৈরী হয়েছে এখন, যারা এই সিনেমা দুটিকে অনুপ্রেরণা মেনে বানিয়েছেন এবং বানাচ্ছেন দুর্দান্ত সব আর্টপিস। যদিও এই দুই সিনেমা ভাব-আবহ কিংবা চরিত্রবর্ণনে ছিঁটেফোঁটাও মিল রাখেনি নিজেদের মধ্যে, তবুও এই দুই বিপরীতমুখী সিনেমা মিলেই যেভাবে পালটে দিয়েছে বলিউডি সিনেমার কঙ্কাল, তা ভূয়সী প্রশংসার। বাহ্যিক মিল না থাকলেও, অন্তর্গতভাব বিচারে এই আঙ্গিকটিই এই সিনেমা দুটির মধ্যে প্রধান ও গভীরতম মিল!