বাতিল শিল্পী থেকে গিনেজ রেকর্ড: অজানা এক লতা মঙ্গেশকর
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

এই কিন্নরকন্ঠী মানুষটিকে ডাকা হতো 'নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া' নামে। সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবীকেই সুরের জাদুতে বুঁদ করে রেখেছিলেন তিনি। তিনি লতা মঙ্গেশকর। জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্রা করেছেন যিনি, সেই মানুষটির কিছু অজানা তথ্য নিয়েই আজকের নৈবেদ্য।
বাণী অর্চনায় নিয়ম মেনে গিয়েছিলাম। যুক্ত হয়েছিলাম সমবেত মানুষদের সাথে। রীতি মেনে সুরের দেবী সরস্বতীও এসেছিলেন মর্ত্যধামে। ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। শ্বেতশুভ্র দেবী হয়তো ভক্তদের দু'হাত ভরে বরও দিয়েছিলেন। কিন্তু কৈলাসে যাওয়ার সময় এই ভক্তদের মধ্যিখান থেকেই এমন একজনকে আচমকাই নিয়ে যাবেন সাথে, যাকে তিনি ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি, তা বোধহয় কারো বিন্দুমাত্র ধারণাতেই ছিলো না।
ঠিক সে কারণেই এই মানুষের আকস্মিক বিদায়-জনিত শোক হলো মারাত্মক। স্মৃতি অসার, মস্তিষ্কে বারবার ফিরে এলো শৈশবের টেপ রেকর্ডার। দুপুরবেলার ভাতঘুমের আগে আগে ভেসে আসা গান। আধেক তন্দ্রা, আধেক জাগরণে যেখানে বারবার আবির্ভাব অদ্ভুত সেই সুরেলা কন্ঠের। সে কিন্নরকন্ঠী মানুষটিকে ডাকা হতো 'নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া' নামে। সত্তর বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবীকেই সুরের জাদুতে বুঁদ করে রেখেছিলেন তিনি। তিনি লতা মঙ্গেশকর। জাগতিক পৃথিবী ছেড়ে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্রা করেছেন যিনি, সেই মানুষটির কিছু অজানা তথ্য নিয়েই আজকের নৈবেদ্য।
বাবার স্মৃতিতে গানের পথ
লতা মঙ্গেশকরের বংশ-লতিকার দিকে তাকালে সম্ভ্রমে মাথা নুয়ে আসবে যে কারোরই। তাঁর পুরো পরিবারের সবাই-ই স্ব স্ব ক্ষেত্রে গুণী মানুষ। বাবা ছিলেন সংগীতজ্ঞ এবং একটি থিয়েটার কোম্পানিও ছিলো তাঁর। ঠিক সে কারণেই ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতময় পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা দুই বোন, লতা-আশার। যদিও সঙ্গীত নিয়ে এগোবেন, সেটা বোধহয় ভাবেননি কখনোই। বাবার মৃত্যুর পরেই সঙ্গীত নিয়ে মনোযোগী হন লতা।
এর আগে অবশ্য ছোট্ট একটি ঘটনাও ঘটেছিলো। তাঁর বাবার কাছে কিছু শিষ্য গান শিখতে আসতো।নিয়মিত। একদিন তাদেরকে রেওয়াজ করতে দিয়ে তাঁর বাবা এক কাজে গিয়েছেন। এদিকে সেই শিষ্যদের মধ্যে একজন রেওয়াজে ভুল করলেন। ছোট্ট লতা আশেপাশেই ছিলো। সে হেলেদুলে এসে শিষ্যটির ভুল শুধরে দিলো। আচমকা এমন সময়েই ফিরলেন বাবা। এবং অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন- তার ছোট মেয়ে খুব যত্ন নিয়ে সুর ঠিক করে দিচ্ছেন তাঁর এক শিষ্যের। লতা'কে নিয়ে বাবার মুগ্ধতার তখন থেকেই শুরু।
প্রথম গান বিভ্রাট
'কিতি হাসাল' নামের এক মারাঠি সিনেমায় প্রথমবারের মতন গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই, সিনেমার ফাইনাল এডিটিং এর সময়ে এডিটরের নির্দয় ময়নাতদন্তে 'নাচু ইয়া গাড়ে' শিরোনামের এই গানটি বাতিল হয়ে যায়। এই গান আর এই সিনেমায় ব্যবহৃত হয়নি পরে।

গানে গানে অজ্ঞান
মিউজিক কম্পোজার নওশাদ এর একটি গান রেকর্ডিং এর সময়ে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তখন গ্রীষ্মকাল। সেদিন গরমটাও পড়েছে বেশ দরাজ। বিকেলবেলা। মুম্বাইয়ের বদ্ধ স্টুডিওতে রেকর্ডিং হচ্ছে। এয়ার কন্ডিশনারেরও বালাই নেই। ফাইনাল রেকর্ডিং এর সময়ে ফ্যানও বন্ধ। ফলশ্রুতিতে, গান গাইতে গাইতেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। লতা মঙ্গেশকরের ভাষ্যে-
বাস, ম্যায় বেহোশ হো গায়ি।
শুনবো না গান
লতা মঙ্গেশকরের বেশ অদ্ভুত এক সংস্কার ছিলো, তিনি তাঁর গাওয়া গান কখনোই শুনতেন না। তিনি মনে করতেন- নিজের গান শুনলে একগাদা ভুল বের করে ফেলবেন তিনি। খারাপ লাগবে। তাই নিজের গান শোনার সাহস তিনি কখনোই করেননি এই সুদীর্ঘ সঙ্গীত-জীবনে।

প্রিয় সঙ্গীত পরিচালক
লতা মঙ্গেশকরের প্রিয় সঙ্গীত পরিচালক কে, এ তথ্য অনেকের কাছেই অজানা। যদিও সাত দশকের এই বিস্তীর্ণ ক্যারিয়ারে অনেক সঙ্গীত পরিচালকের সাথেই কাজ করেছেন তিনি, তবুও তাঁর প্রিয় পরিচালক- মদন মোহন। এর পেছনে কারণও আছে। তিনি মনে করতেন- মদন মোহনের সাথে তার সম্পর্ক অনেকটাই বিশেষ, অনেকটা ভাই-বোনের সম্পর্কের মতন। দুইজনের কোলাবোরেশানের 'ও চুপ রাহে' গানটি লতা মুঙ্গেশকরের বিশেষ প্রিয়ও।
রাজনীতির ময়দানে
সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর, রাজনীতিতেও কিছু সময়ের জন্যে এসেছিলেন! রাজ্যসভায় ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এমপি হিসেবে আসীন ছিলেন তিনি। এরপর রাজনীতির পাট চুকিয়ে গানের জগতেই চলে আসেন আবার। ভাগ্যিস, চলে এসেছিলেন!
আন্তর্জাতিক লতা
লতা মঙ্গেশকরের খ্যাতি যে বৈশ্বিক, তা সবারই জানা। তবে যেটি অনেকেই জানেন না, লতা মঙ্গেশকরই প্রথম ভারতীয় যিনি লন্ডনের সম্মানজনক রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পারফর্ম করেছিলেন। তাছাড়াও ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব 'লিজিওন দি অনার' এ সম্মানিত করেছিলেন। যে খেতাবও খুব কম ভারতীয় পেয়েছেন এ পর্যন্ত।
গিনেজ রেকর্ড
লতা মঙ্গেশকরের নাম এসেছিলো গিনেজ বুকেও। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক রেকর্ডের অধিকারী শিল্পী হিসেবে 'গিনেজ বুক' তাদের ১৯৭৪ সালের এডিশনে যুক্ত করে লতা মঙ্গেশকরের নাম৷ যদিও খানিকটা বিতর্ক ছিলো এই ঘটনা নিয়ে। ভারতের আরেক বিখ্যাত শিল্পী মুহম্মদ রাফি তৎকালে দাবী করেছিলেন, সবচেয়ে বেশি রেকর্ডেড শিল্পী তিনি। এই বিতর্ক চলেছিলো বহুদিন।
গানের কত ভাষা!
লতা মঙ্গেশকর উপমহাদেশের সচল প্রায় সবগুলো ভাষাতে গান গেয়েছেন, এ তথ্য সর্বজনবিদিত। তবু প্রশ্ন আসে মনে, ঠিক কতগুলো ভাষায় গান গেয়েছেন তিনি? যদিও সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে কিছুটা, তবুও বলা হয়- প্রায় ৩৬টি ভাষায় গান গেয়েছেন এই মহান শিল্পী!
শেষ গান
লতা মঙ্গেশকর শারীরিক অসুস্থতার জন্যে গান গাননি বহুদিন। তাঁর শেষ পূর্নাঙ্গ অ্যালবাম যদিও 'বীর জারা', তবে ২০১৯ সালেও তাঁর গাওয়া একটি গান প্রকাশ পায়। 'সওগাদ মুঝে ইস মিট্টি কি' শিরোনামের এ গানটি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উৎসর্গ করে গেয়েছিলেন তিনি। ধরা হয়, এটিই তাঁর গাওয়া শেষ গান।
রূদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন-
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
'সুর-সম্রাজ্ঞী' এই মানুষটি যে চিরকালই রয়ে যাবেন সুরে, কন্ঠে, স্মৃতিতে, তাতে নেই তিলমাত্র সন্দেহ। তবুও নশ্বর দেহের বিদায়ে খানিকটা তড়পাতে হয়। খানিকটা ছলকে ওঠে দুঃখ। হয়তো এটুকু হওয়া উচিতও৷ 'সঙ্গীত' নামক মহাকাব্যের খুব ঝলমলে এক অধ্যায়ের পতনে যে বিষাদ, সেটুকু হওয়াটা স্বাভাবিকও। এ বিষন্ন বিষাদ কবে কাটবে জানা নেই। তবু মহাকালের নিয়ম মেনে মানতে হয় সব। হেলাল হাফিজের শব্দ ধরেই বেদনাকে চুপ করাতে হয়। বেঁচে থাকা আর প্রিয় মানুষদের হারানোর এ বিড়ম্বনা মেনে এগোতে হয়। শোক করতে হয়। সবকিছু ভুলে বুক বাঁধার আয়োজনও করতে হয়। এটাই কী জীবন? বোধ হয়।