সামান্য ক'জন কুশীলব এবং সীমিত গণ্ডির এই 'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন' এ যেভাবে ক্রমশ চললো কথার লড়াই, কথা যেভাবে শিল্প থেকে গোঁত্তা খেয়ে রাজনীতি, সেখান থেকে ধর্ম এবং ধীরে ধীরে প্রশাসনের দমনপীড়নকে ছুঁয়ে এগোলো ক্রমশ উত্তপ্ত একেক অঞ্চলে, মুগ্ধ হলাম!

উপমহাদেশের বিখ্যাত লেখক সাদাত হোসেন মান্টোর বিরুদ্ধে ছয়বার মামলা হয়েছিলো ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক কোর্টে। অভিযোগ একটাই- তিনি সাহিত্যের নামে নাকি ছড়াচ্ছেন অশ্লীলতা! যে অশ্লীলতা কোমলমতি শিশুদের মনোজগত বিগড়ে দিচ্ছে! এসব অপসাহিত্য পড়ে কিশোর-কিশোরীরা নাকি বিপথেও যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছিলো, মান্টোর বিরুদ্ধে উদীয়মান প্রগতিশীল সমাজের ক্ষোভ বাড়ছিলো, যাপিত সব অভিযোগ বাড়ছিলো। এসবের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানে মান্টোর নামই হয়ে যায় 'পর্ন রাইটার।' এই তুমুল আলোচিত সাদাত হোসেন মান্টোকে যখন দায়েরকৃত অভিযোগের বিপক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে একবার আদালতে ডাকা হয়, তখন মান্টো কাঠগড়ায় উঠে খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছিলেন- 

আমার গল্পে কোন বিষয়টি শ্লীল, আর কোন বিষয়টি অশ্লীল... তা কে নির্ধারণ করবে? 

মান্টো আরও প্রশ্ন করেছিলেন- 

আমার গল্প দিয়ে আমি কি বুঝিয়েছি, এ বিষয়ে শেষ কথা কে বলবে? আমি? নাকি, পাঠক?

বিতর্ক এখানেই। জলঘোলাও এখানে। একজন নির্মাতার যেকোনো কাজ দেখে কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগতেই পারে, শিল্পীর শিল্প দেখে প্রতিক্রিয়াশীল মহলের শরীরে জ্বালাপোড়াও হতে পারে। সেটাতে সমস্যাও নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা তখনই হয়, যখন, প্রতিক্রিয়াশীল মহলের প্রত্যক্ষ মদদে শিল্পীর সেই বিশেষ শিল্পকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সমস্যা তখনই হয়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র পিষে ফেলতে চায় নির্মাতা এবং নির্মাণকে। ঠিক এরকম ক্রান্তিকালে এসেই মান্টোর সেই বিশেষ প্রশ্ন আবার জেগে ওঠে হৃদয়ে- নির্মাতার নির্মাণের শেষ কথা কে বলবে? কে লিখবে লাইনের শেষ শব্দ? 

'চরকি'র 'জাগো বাহে' অ্যান্থোলজি সিরিজের দ্বিতীয় নির্মাণ 'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন' এর শুরুর কিছু অংশ দেখে সাদাত হোসেন মান্টোর বিড়ম্বনার কথাই ক্রমশ মনে আসছিলো। সে সাথে প্রশ্নগুলোও। চমকে উঠেছি যখন গল্পের শেষদিকে এসে কুশীলবের মুখেও মান্টোর প্রসঙ্গ শুনেছি। বুঝেছি, বিড়ম্বনা কিংবা হেনস্থার প্রসঙ্গে মান্টোর কথা কিংবা নাম আসবেই। কিংবা 'মান্টো'কে একটা রূপক হিসেবেই কল্পনা করি। যে লেখক তথাকথিত টিপিক্যাল ইমোশনস এর বাইরে গিয়ে সময়ের কথা কিংবা সমাজের কথা বলতে যাবেন, তাকেই স্তব্ধ করিয়ে দেয়া হবে। টুঁটি চেপে ধরা হবে। 

'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন' এর গল্প শুরু সেই উনিশশো সত্তরে৷ যে বছরের এপ্রিলে মুক্তি পায় এক বিশেষ সিনেমা। জীবন থেকে নেয়া। বাংলাদেশের সিনেমা-ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে যে নির্মাণকে অবলীলায় আখ্যায়িত করা যায়। সংসার, চাবির গোছা আর দুই বোনের মধ্যবর্তী টানাপোড়েন দিয়ে জহির রায়হান যেভাবে মেটাফোরিক্যালি এ সিনেমায় এনেছিলেন দুই পাকিস্তানের সংকট ও সংঘর্ষকে, তা স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগেনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার। ফলাফল- রাতারাতি সিনেমাটির প্রদর্শনী বন্ধ। সিনেমার রিল সরকারের দপ্তরে জিম্মি৷ যদিও একবার সেন্সর বোর্ড থেকে 'এনওসি' পেয়েছে এ সিনেমা, তবুও 'জীবন থেকে নেয়া'কে আবার নেয়া হয় সেন্সর বোর্ডের ময়নাতদন্তের টেবিলে। সেখানে আসেন 'জীবন থেকে নেয়া'র রচয়িতা জহির রায়হান এবং আমজাদ হোসেন। মুখোমুখি দু-পক্ষ। একদিকে সাম্প্রদায়িক সেন্সর বোর্ড। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক নির্মাতা। মাঝখানে নো ম্যানস ল্যান্ড। মৃদু আলো। রহস্যের আঁধার। এরকম এক জমাটি কুজ্ঝটিকার মধ্যিখানে মঞ্চস্থ হয় 'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন।' 

 মুখোমুখি শাসক ও লেখক! 

সামান্য ক'জন কুশীলব এবং সীমিত গণ্ডির এই গল্পে যেভাবে ক্রমশ চললো কথার লড়াই, কথা যেভাবে শিল্প থেকে গোঁত্তা খেয়ে রাজনীতি, সেখান থেকে ধর্ম এবং ধীরে ধীরে প্রশাসনের দমনপীড়নকে ছুঁয়ে এগোলো ক্রমশ উত্তপ্ত একেক অঞ্চলে, মুগ্ধ হলাম। এই নির্মাণের চিত্রনাট্য লিখেছেন, সুহান রিজওয়ান। কথা পরম্পরা যেভাবে তিনি সাজিয়েছেন, তৃপ্তি পেয়েছি। অবশ্য 'সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ'খ্যাত সুহান রিজওয়ান চিত্রনাট্য লিখলে যে এরকম কিছুই লিখবেন এবং তা যে দর্শককে বিস্মিত করবে, এটাই তো প্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি উল্লেখ্য, সৈয়দ আহমেদ শাওকির সেট ডিজাইন। সহজ আর সীমিত অনুষঙ্গেও যে ফুটিয়ে তোলা যায় ধ্রুপদি আবহ, এই নির্মাণ সেটাই বোঝালো আরেকবার। নির্মাতা সালেহ সোবহান অনীমের কথা বলাও প্রাসঙ্গিক। গল্পে খুব বেশি সাসপেন্স এলিমেন্টস না থাকা সত্বেও নির্মাতা যেভাবে বুনেছেন যাপিত সব উপাদান, দর্শকের আগ্রহ ধরে রেখেছেন শুরু থেকে শেষতক...এখানেই তার সার্থকতা। উৎকর্ষতা। 

'জহির রায়হান'রূপী মোস্তফা মন্ওয়ার আবারও দুর্দান্ত।প্রশাসনকে কখনো তাচ্ছিল্য, কখনো চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া কিংবা কখনো করা পরিহাস... গল্পের সিচুয়েশন এবং টেনশন বুঝে যেভাবে ওঠানামা করলো মোস্তফা মন্ওয়ারের অবয়ব এবং চোখের ভাষা, স্রেফ দুর্দান্ত। আঠাশ মিনিটের এ নির্মাণে সিনেম্যাটোগ্রাফীর বালাই নেই, গল্পেও একের পর এক চমক নেই। বোঝাই যাচ্ছিলো, এ যুদ্ধে মূল সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে স্ক্রিপ্ট ও অভিনেতাকে...সেটাই যেন দেখালেন মন্ওয়ার সহ বাকি অভিনেতারা। এবং আলাদাভাবে, ইন্তেখাব দিনারও। প্রশাসকের প্রতিনিধি হয়ে যেভাবে কপালে আঁটলেন ভ্রুকুটি ও আলগোছে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন নির্মাতার মেরুদণ্ড, এবং শেষের নয় মিনিটে দিনার ও মন্ওয়ারের মুখোমুখি ডুয়েল... অনবদ্য।

অনবদ্য মোস্তফা মন্ওয়ার! 

ইতিহাসবিদ ইউভাল নো হারারি সবসময়েই বলেন-

মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় দেশ।

যেকোনো দেশের প্রশাসনযন্ত্র তাই সবার আগে নিয়ন্ত্রণ নেয় মিডিয়ার। সিনেমা, সংবাদ, পত্রিকা সবকিছুকেই করতে চায় নিয়ন্ত্রণ। জর্জ অরওয়েলের 'নাইন্টিন এইটি ফোর' এর বিখ্যাত লাইন 'বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ'ও এ কথার পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়৷ মিডিয়াকে কন্ট্রোল করার সরকারের এ চাল ছিলো সত্তরেও। সেটাকেই কটাক্ষ করে এ নির্মাণ। একজন নির্মাতা যদি সাহসী হয়ে উড়তে চায়, তাহলে তার ডানা ভেঙ্গে দেয়ার যে আয়োজন...সেটাও উঠে আসে এই নির্মাণের নানা অংশে। পাশাপাশি 'সেন্সর বোর্ড' নামক প্রহসনের অসারতা এবং 'পাপেট'পনাকেও নগ্ন করে দেখিয়ে দেয় 'লাইটস, ক্যামেরা, অবজেকশন।' খুবই প্রাসঙ্গিক এ নির্মাণের শেষে এসে কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়- সত্তরের সেই উত্তাল ডামাডোল কি বর্তমানে একটুও নেই? প্রশাসনের ত্রাস কি খুব একটা পাল্টেছে? লঙ্কার রাবন পাল্টেছে, কিন্তু তান্ডব? গনমাধ্যমকে 'মগজধোলাই' করার সে আদিম প্রক্রিয়া কি থেমে গেছে পুরোপুরি? আগুনের দিন কি শেষ হয়েছে মোটেও? অজস্র প্রশ্ন। উত্তর? জানা নেই। 

শেষ করি, এই নির্মাণেরই একটা উক্তি দিয়ে- 

পাকিস্তানের ল অ্যান্ড অর্ডার এতই ঠুনকো, যে সামান্য একটা সিনেমা বানিয়ে, বা, গল্প বলে, বা, কার্টুন একে সেটাকে আঘাত করা যায়?

বিশেষ এ উক্তির 'পাকিস্তান' নামটিকে সরিয়ে যে কেউ আশেপাশের যেকোনো দেশের নাম বসালেও বাক্যটি তার আপেক্ষিকতা হারাবে না মোটেও। বরং আরো প্রাসঙ্গিকতা বাড়বে। এবং ঠিক এখানেই, মেটাফোর,  রূপক ও চোখে আঙুল দিয়ে অস্বস্তির মুখোমুখি করাতেই এই নির্মাণের সার্থকতা। গ্রহণযোগ্যতা। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা