'ফরেস্ট গাম্প' এর মতো সিনেমা, যে সিনেমা বহু মানুষ অজস্রবার দেখে ফেলেছে, যে সিনেমার 'লার্জার দ্যান লাইফ' অ্যাপ্রোচ কিংবা টম হ্যাঙ্কস এর অতিমানবীয় অভিনয় অথবা গল্পের বুনোট মানুষকে বিস্মিত করে আজও, সে সিনেমাকে যদি কেউ রিমেক করতে যাওয়ার সাহস দেখায়, সে সাহস যতটাই নিষ্পাপ হোক, যতটাই অপাপবিদ্ধ হোক, তা যে অনেকটা ডিঙ্গি নিয়ে সমুদ্র পার হওয়ার দুঃসাহসের সামিল হয়, তা আলাদা করে বোধহয় না বললেও চলে!

কয়দিন আগেই খবর চাউর হলো- বলিউড ক্ল্যাসিক 'আনন্দ' এর রিমেক হচ্ছে। এ খবর শুনে যতটা না অবাক হয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি হয়েছিলাম বিরক্ত। হবারই কথা। যে কালজয়ী সিনেমায় রাজেশ খান্না দিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স, যে সিনেমার মুগ্ধতার নানা দিক নিয়ে এখনো হয় বিস্তর আলোচনা, যে সিনেমাকে সিনেমাপ্রেমীরা এখনো রাখে 'প্রিয় সিনেমা'র শীর্ষ তালিকার অগ্রভাগে, সে সিনেমাকে 'রিমেক' করার দরকার পড়লো কেন, প্রশ্ন উঠেছিলো তা নিয়েও। এবং, এরকম প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিকও। আমাদের প্রত্যেকেরই 'ব্যক্তিগত তালিকা'য় এমন কিছু সিনেমা আছে, যেসব সিনেমা আবার নতুন করে তৈরী হোক, সেটা বোধহয় আমরা কেউই চাইনা। বিস্ময়কর ও অপার্থিব সব অনুষঙ্গের জোরে কিছু সিনেমা এমনই উচ্চতায় উঠেছে, সেসব সিনেমা নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতির সাথে এমনভাবেই মিশেছে, সেসব সিনেমার অনুকরণে যা-ই করা হোক না কেন, অর্থ-প্রযুক্তি কিংবা গ্ল্যামারের ঝনঝনানি যতই দেখানো হোক না কেন, দিনশেষে নতুন নির্মাণের পুরোটাই যে পণ্ডশ্রম হয়, তা আলাদা করে বোধহয় বলারও অপেক্ষা রাখেনা।

'ফরেস্ট গাম্প' এর মতো মাস্টারপিস রিমেক করার সিদ্ধান্ত অনেকটাই দুঃসাহস

ঠিক সেই প্রসঙ্গ বিবেচনাতেই, 'ফরেস্ট গাম্প' এর হিন্দি সংস্করণ 'লাল সিং চাড্ডা' বানানোর কোনো প্রয়োজন আসলেই ছিলো কি না, প্রশ্ন ছিলো। যারা সিনেমা নিয়ে ছিঁটেফোঁটা জ্ঞান রাখেন, তাদেরও সিংহভাগ 'ফরেস্ট গাম্প' দেখেছেন। যারা সিনেমাপ্রেমী, তারা হয়তো বহুবারই দেখে ফেলেছেন। এবং এরকম এক সিনেমা, যে সিনেমা বহু মানুষ অজস্রবার দেখে ফেলেছে, যে সিনেমার 'লার্জার দ্যান লাইফ' অ্যাপ্রোচ কিংবা টম হ্যাঙ্কস এর অতিমানবীয় অভিনয় অথবা গল্পের বুনোট মানুষকে বিস্মিত করে আজও, সে সিনেমাকে যদি কেউ রিমেক করতে যাওয়ার সাহস দেখায়, সে সাহস যতটাই নিষ্পাপ হোক, যতটাই অপাপবিদ্ধ হোক, তা যে অনেকটা ডিঙ্গি নিয়ে সমুদ্র পার হওয়ার দুঃসাহসের সামিল হয়, সেটা লেখাই বাহুল্য। সচেতনমাত্রেরই বুঝতে পারার কথা তা। 

যদিও 'লাল সিং চাড্ডা'র ট্রেলারে আমির খানের নানা টাইমফ্রেমের অবতার, নিপাট অভিনয়, সাদাসিধে পাঞ্জাবি অ্যাকসেন্ট... চোখ ফেরানোর সুযোগ দেয়নি। কিছু জায়গায় যদিও 'পিকে' কিংবা 'থ্রি ইডিয়টস' সিনেমার দ্যোতনা এসেছে, তবে তা মহাপাপ মনে হয়নি। সিনেমার ভিএফএক্স, সিনেম্যাটোগ্রাফী কিংবা কালার-গ্রেড লেগেছে ছিমছাম। সবমিলিয়ে, খুব বেশি আক্ষেপের জায়গা না রেখে ট্রেলারও মোটামুটি উতরে গেছে। 

হয়তো মূল সিনেমাও এভাবে উতরে যাবে। 'ফরেস্ট-জেনি'র যে লাভ-স্টোরি, সেখানে 'আমির-কারিনা' জুটি হয়তো জাস্টিসও করতে পারবে। বুব্বার চরিত্রে নাগা চৈতন্যও হয়তো করবে মনে রাখার মত অভিনয়। কিন্তু, তবুও... যে 'ফরেস্ট গাম্প' এর সাথে এতদিনের যাপিত জীবন, সেখানে এ সিনেমা দেখতে বসলে তুলনা আসবে, বারবার তুলনা আসবে। এবং সে তুলনাতেই 'লাল সিং চাড্ডা' অজস্র ইতিবাচক দিক থাকা সত্বেও খানিকটা ফিকে হয়ে যাবেই। মূলত, আক্ষেপ সেখানেই।

লাল-রূপা জুটি কি মুগ্ধ করবে?

তবে, এটাও ঠিক, মূল সিনেমা কেমন হবে, সে সিদ্ধান্তে এখনই যাওয়াটা বোকামো। কারণ, একজন। আমির খান। একাই এক হাতে সিনেমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার যে অদ্ভুত ক্ষমতা তার, সে ক্ষমতা যদি এখানেও ঠিকঠাক প্রয়োগ করেন তিনি, তাহলে কী চমৎকারিত্ব  হবে, তা মোটেও আগে বলা যায় না। তাছাড়া, আমির খান বাদেও, সিনেমার অন্যান্য দিকগুলোও দারুণ। সিনেমায় যে গানগুলো এলো, বেশ ভালো। সিনেমার প্রমোশনাল ক্যাম্পেইনগুলোও অন্যরকম, বুদ্ধিদীপ্ত। ট্রেলারও মোটামুটি। সেসবের মান রেখে এখন এই নির্মাণ ঠিকঠাক উতরে গেলেই স্বস্তি। 'রিমেক' এর নামে বলিউড যে আবর্জনা বানাচ্ছে... সেই ন্যারেটিভ থেকে যদি খানিকটা হলেও মুখশুদ্ধির সুযোগ দেয় এ সিনেমা, তাহলে বিষয়টা খোদ বলিউডের জন্যেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচার। স্বস্তি তাদেরও! 

একা আমির খানই কি গড়ে দেবে পার্থক্য?

সবারই মোটামুটি জানা, 'লাল সিং চাড্ডা'র জন্যে আমির খানসহ পুরো টিমের স্ট্রাগল চৌদ্দ বছরের৷ এরমধ্যে নয় বছরই লেগে গিয়েছিলো সিনেমার কপিরাইট পেতে। এরপর শুরু হয়েছে শুটিং। তখন আবার মহামারীর ধাক্কা। একের পর এক বিপত্তি এসেছে, আর সেসবের সাথে মোকাবেলা করেছে গোটা টিম। আর এভাবেই, সব ঝক্কি নিকেশ করে, শেষপর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে সিনেমা। যদিও এতসব বিপত্তির টানেল টপকে আবির্ভূত হলো যে সিনেমা, সে সিনেমা বক্সঅফিসে কিংবা ক্রিটিকদের কি-বোর্ডে কতটুকু সাড়া ফেলবে, তা জানা নেই কারো। 'লাল সিং' এর জীবন-আখ্যান 'গোলগাপ্পা' হয়ে মন ভরাতে পারবে কি না, সেও অজানা। ভেতরের অজ্ঞাত প্রকোষ্ঠে 'ফরেস্ট গাম্প' যেরকম স্থির, সেরকম সুযোগ 'লাল সিং চাড্ডা'র বরাতেও হবে কি না, সেটাও জানা না থাকলেও এটুকু ঠিক জানি, কোনো এক কালে 'ফরেস্ট' নামে একজন বলেছিলেন- 

Life is like a box of chocolates.You never know what you're gonna get.

আর, সেটুকু বিবেচনাতেই- 'লাল সিং চাড্ডা' নামের এ চকোলেট (বা গোলগাপ্পা) ভালো লাগবে কি না, তা আগেই বলা ঠিক হবে না৷ এবং, মূলত সেজন্যেই, সিনেমা মুক্তির জন্যে হাপিত্যেশ করা হবে যথাযথ। অপেক্ষা করাই হবে প্রাসঙ্গিক। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা